ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রাজধানীতে ডিবি পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার ঘটনায় চাঞ্চল্য

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২১ মার্চ ২০১৮

রাজধানীতে ডিবি পুলিশ কর্মকর্তা হত্যার ঘটনায় চাঞ্চল্য

গাফফার খান চৌধুরী ॥ খোদ রাজধানীতে গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তাকে গুলি চালিয়ে হত্যার ঘটনা রীতিমত চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। পুলিশ কর্মকর্তার মাথায় দুইটি গুলি লেগেছিল। গুলিতে মাথার মগজ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে বলে চিকিৎসকরা জানান। পুলিশের তরফ থেকে এটিকে সন্ত্রাসী হামলা বলা হচ্ছে। তবে এমন নিখুঁতভাবে মাথায় গুলি চালিয়ে পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা করা নানা রহস্যের জন্ম দিয়েছে। সাধারণ সন্ত্রাসীদের পক্ষে এমন কাজ করা সম্ভব কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠেছে। এক পুলিশ সার্জেন্টের অস্ত্র পরিকল্পিতভাবে চুরি করে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে গেলে এমন ঘটনা ঘটে। যা জঙ্গীদের কাজ হতে পারে বলে গোয়েন্দাদের ধারণা। দায়িত্বশীল তদন্তকারী সংস্থাগুলো বলছে, স্বাধীনতাবিরোধী ও জঙ্গীদের অন্যতম টার্গেট পুলিশ। সেই টার্গেটের অংশ হিসেবে জঙ্গীরাও ঘটনাটি ঘটিয়েছে কিনা তা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। ঘটনার সূত্রপাত চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি। মিরপুর মডেল থানার ওসি নজরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর পুলিশের ট্রাফিক পশ্চিম বিভাগের সার্জেন্ট মামুনুর রশীদ ও সার্জেন্ট সোহেল মিরপুর থানায় তাদের সরকারী পিস্তল খোয়া গেছে বলে দুইটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় বলা হয়, সার্জেন্ট মামুন ও সোহেল রাজধানীর মিরপুর মডেল থানাধীন ঝিলপাড়ের একটি বহুতল বাড়িতে ভাড়ায় বসবাস করছিলেন। তারা গত ১১ জানুয়ারি তাদের অস্ত্র বাসায় রেখে স্ত্রী সন্তানসহ সকালে বাইরে যান। দুপুর আড়াইটার দিকে তারা কাজের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার সময় অস্ত্রের সন্ধান করেন। দেখেন অস্ত্র নেই। বাসার জানালার গ্রিল কেটে অন্যান্য মালামালের সঙ্গে অস্ত্র দুইটি চুরি হয়ে গেছে। দুই সার্জেন্টকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। অস্ত্র খোয়া যাওয়ার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা দুইটি পরবর্তীতে উচ্চতর তদন্তের জন্য ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পশ্চিম বিভাগের কাছে হস্তান্তরিত হয়। মামলা দুইটির তদন্ত শুরু করে ডিবি পুলিশ। সোমবার দিবাগত গভীর রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ডিবির পশ্চিম বিভাগের সিনিয়র সহকারী কমিশনার শাহাদাত হোসেনের নেতৃত্বে ডিবির একটি দল দুই সার্জেন্টের অস্ত্র চুরির সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করতে মিরপুর মডেল থানাধীন মধ্য পীরেরবাগের আলিম উদ্দিন স্কুলের পাশে ১০৫/এ/১ নম্বর আড়াইতলা বাড়িতে অভিযান চালায়। অভিযানে মিরপুর থানা পুলিশ ও পুলিশের বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সোয়াটও অংশ নেয়। তারা পুরো বাড়িটি ঘিরে ফেলে। ঘিরে ফেলার পর বাড়িটিতে পুলিশ জঙ্গী আস্তানার সন্ধান পেয়েছে বলে এলাকায় প্রচার পায়। রাতেই বাড়িতে তল্লাশি চালানোর চেষ্টা করে। এ সময় বাড়িতে থাকা সন্ত্রাসীরা বাড়িটির ছাদে অবস্থান নেয়। ডিবি পুলিশের সদস্যরা তৃতীয় তলায় ওঠার সময় সন্ত্রাসীরা তাদের ওপর গুলি চালাতে থাকে। এ সময় সন্ত্রাসীদের পরপর দুইটি বুলেট পরিদর্শক জালাল উদ্দিন ওরফে জাহাঙ্গীরের মাথায় বিদ্ধ হয়। পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। এ সময় সন্ত্রাসীরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে বাসার পেছন দিয়ে পালিয়ে যায়। ওই বাসা থেকে নারীসহ সন্ত্রাসীদের কয়েক স্বজনকে আটক করা হয়েছে। জালাল উদ্দিনকে দ্রুত রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যান ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়াসহ উর্ধতন কর্মকর্তারা। রাত দুইটার দিকে স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসকরা পরিদর্শক জালাল উদ্দিনকে মৃত ঘোষণা করেন। এদিকে বাড়ির সামনে অবস্থান নেয়া পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের গোলাগুলি হয়। আধাঘণ্টা পর আর কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে পুলিশ ওই বাড়িতে তল্লাশী চালিয়ে কোন অস্ত্রগোলাবারুদ পায়নি। বাড়ি থেকে মহিলাসহ কয়েকজনকে আটক করে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ডিবির যুগ্ম-কমিশনার আব্দুল বাতেন জনকণ্ঠকে বলেন, ঘটনাটি সন্ত্রাসী ঘটনা বলে ধারণা করা হচ্ছে। হামলাকারীরা জঙ্গী কিনা সে বিষয়টিও মাথায় রেখে তদন্ত করা হচ্ছে। পরে জালাল উদ্দিনের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য স্কয়ার হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। মঙ্গলবার জালাল উদ্দিনের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক প্রদীপ কুমার বিশ্বাস জানান, জালাল উদ্দিনের মাথায় দুইটি বুলেট বিদ্ধ হয়েছে। একটি বুলেট বাঁ কানের ঠিক ওপর দিয়ে গিয়ে ব্রেনের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। প্রচ- গতির কারণে বুলেটের আঘাতে ব্রেন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। আরেকটি গুলি মাথার পাশ দিয়ে লেগে মাথার একপাশ ভেদ করে বাইরে চলে গেছে। ভেতর থেকে একটি বুলেট বের করা হয়েছে। মঙ্গলবার বেলা দেড়টার দিকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ সংলগ্ন মাঠের পাশে জালাল উদ্দিনের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে অংশ নেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দীন, পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলামসহ উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তাসহ সকল স্তরের কর্মকর্তা কর্মচারী। জানাজা শেষে মরহুমের রুহের মাগফিরাত কামনা করে সকলে দোয়া করেন। ডিএমপি’র একদল চৌকস পুলিশ সদস্য নিহত জালাল উদ্দিনকে রাষ্ট্রীয় সালাম প্রদান করেন। এরপর একে একে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন স্বরাষ্ট্র সচিব, আইজিপি, ডিএমপি কমিশনার, বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস এ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন স্তরের পুলিশ সদস্যরা। পরে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয় নিহতের স্মরণে। পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাভেদ পাটোয়ারী বলেন, সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে তার পরিবারকে সমবেদনা জানান তিনি। পুলিশের তরফ থেকে জালাল উদ্দিনের পরিবারকে সবধরনের সুবিধা দেয়া হবে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, দুই সার্জেন্টের খোয়া যাওয়া অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে গেলে ঘটনাটি ঘটে। অপরাধীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তবে উল্লেখযোগ্য কেউ আটক বা গ্রেফতার হয়নি। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের স্পেশাল এ্যাকশন গ্রুপের উপকমিশনার প্রলয় কুমার জোয়ার্দার জানান, বাড়িটির ছাদ থেকে সন্ত্রাসীরা গুলি চালায়। তাতেই নিহত হন জালাল উদ্দিন। ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান জানান, নিহতের মরদেহ ডিএমপি’র লাশবাহী ফ্রিজার ভ্যানে করে তার গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। লাশের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদেরও আলাদা গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয়। নিহত জালাল উদ্দিনের (৪৮) বাড়ি ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ থানা এলাকায়। তার স্কুল পড়ুয়া দুই মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস তৃপ্তি ও ফারহানা আফরোজ তুর্যা এবং স্ত্রী বীনা পারভীনকে নিয়ে তিনি ঢাকার বাসাবোর সবুজবাগ এলাকায় বসবাস করতেন। কনস্টেবল হিসেবে ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ পুলিশে যোগ দিয়েছিলেন। দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠার জন্য ২০১৩ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পিপিএম পদক পেয়েছিলেন। সর্বশেষ তিনি ২০১৭ সালে পদোন্নতি পেয়ে পরিদর্শক হন। রাজারবাগে জানাজা শেষে তার মরদেহ পুলিশের সার্বিক ব্যবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয় কালীগঞ্জে গ্রামের বাড়িতে। মঙ্গলবার বিকেলে সেখানেই তার নামাজে জানাজা শেষে দাফন সম্পন্ন হয়।
×