ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

চীন এক ব্যক্তির শাসনে ফিরে যাচ্ছে!

প্রকাশিত: ০৬:৫২, ২১ মার্চ ২০১৮

চীন এক ব্যক্তির শাসনে ফিরে যাচ্ছে!

বিবৃতিটা ছিল মাত্র ৩৬ শব্দের। কিন্তু ওতেই বোমা ফাটানোর কাজটা হয়ে গিয়েছিল এবং সেই আওয়াজ সারা বিশ্বে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ওই বিবৃতির মধ্য দিয়ে চীনের শাসক দল কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) প্রেসিডেন্ট পদে দুটি পাঁচ বছরের মেয়াদের সময়সীমা তুলে দেয়। এর অর্থ হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যতদিন ইচ্ছা দেশটির প্রেসিডেন্ট পদে থাকতে পারবেন। অর্থাৎ এশিয়ার এই পরাশক্তি আবার একনায়কতন্ত্রে ফিরে যাচ্ছে। চীনকে এক ব্যক্তির শাসনের দিকে নিয়ে যাওয়ার পথে এ এক অতি তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ। চীন তথা বিশ্বের ভবিষ্যতের জন্য এটা এতই বড় ঘটনা যে একে খাটো করে দেখার উপায় নেই। চল্লিশ বছর ধরে সিসিপি দেশের স্বৈরাচারী শাসনকে প্রাতিষ্ঠানিকতার মোড়কে রেখে দিয়েছিল। কোন এক ব্যক্তি বা পরিবারের নয় বরং পার্টির হাতেই ছিল দেশের ১৪০ কোটি লোকের ভাল-মন্দের ভার। প্রেসিডেন্টের বয়স ও কার্যকরের ওপর সীমারেখা কঠোরভাবে অনুসরণ করে চলার জন্য পার্টির শাসন বৈধতা লাভ করেছিল। কিন্তু ২০১৩ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে শি জিনপিং এসব রক্ষা করা থেকে সরে আসতে থাকেন। সেন্সরশিপ কঠোর করা হয়। আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীকে কাউকে আটকানো হয়। নিজেও তিনি প্রচারণায় গা ভাসান। তার রাজনৈতিক দর্শন গত বছর দেশের সংবিধানে বিধৃত হয়। এ সময় তিনি দেশের সর্বোচ্চ সংস্থায় প্রটোকল অনুযায়ী তার সম্ভাব্য উত্তরসূরিদের নিয়োগ দেয়ার ব্যবস্থা থাকলেও তা দেননি। অতএব প্রেসিডেন্ট পদের সময়সীমা ছিল পরবর্তী যৌক্তিক পদক্ষেপ। বিশ্বের ২নং অর্থনীতির দেশটিতে এক ব্যক্তি এখন শাসন করছেন। মৃত্যু না হওয়া, পদত্যাগ না করা কিংবা বহিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকে যাওয়া সাম্প্রতিককালে স্বৈরাচারী রাজনৈতিক ব্যবস্থায় যে কত স্বাভাবিক রূপ ধারণ করেছে এ ঘটনা তার এক সুস্পষ্ট অভিপ্রকাশ। রাশিয়ার ভøাদিমির পুতিন, ফিলিপিন্সের রদ্রিগো দুতের্তে ও তুরস্কের রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য গণতান্ত্রিক ভিন্নমত দমন করেছেন। এর পেছনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রচ্ছন্ন সমর্থন আছে। শি জিনপিংয়ের পদক্ষেপ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি সারাহ স্যান্ডার্স মন্তব্য করেন, ‘ওটা তো চীনের সিদ্ধান্ত।’ হয়ত তাই। তবে এর প্রভাব চীনের বাইরেও বহু দূর পর্যন্ত অনুভূত হতে পারে। স্বদেশে আপন ক্ষমতা সুসংহত করায় শি বিশ্বমঞ্চে আরও বেশি সরব হয়ে উঠেছেন। প্রাচীন সিল্ক রুট ধরে তার বেল্ট এ্যান্ড বোর্ড উদ্যোগ তথা বাণিজ্য ও অবকাঠামো নেটওয়ার্কের সুবাদে চীনের ভূরাজনৈতিক প্রভাব ব্যাপক পরিসরে বৃদ্ধি পাবে। তিনি বেজিংয়ে একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং জিবুতিতে চালু করেছেন চীনের প্রথম বৈদেশিক সামরিক ঘাঁটি। দক্ষিণ চীন সাগরে বাণিজ্য ও ভূখ-গত ইস্যু নিয়ে তাকে এখন আরও উচ্চকিত ভূমিকায় দেখা যাবে। বর্তমানে শি জিনপিংয়ের প্রতি অভ্যন্তরীণ বিরোধিতা তেমন একটা নেই। তবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা দেখা দিলে বা কোন একটা সঙ্কট ঠিকমতো সামাল দিতে না পারলে অসন্তোষ দানা বাঁধবে ও তার বহির্প্রকাশ ঘটবে। নিজের অবস্থান নিয়ে নার্ভাস বোধ করলে শি আরও বৃহত্তর পরিসরে দমন-নির্যাতন ও রাজনৈতিক শুদ্ধি অভিযান চালাতে পারেন। স্বৈরাচারের পতন যে অতি দ্রুত হয় সেটা শি’য়ের চাইতে ভাল আর কেউ জানেন না। তার পিতাকে পার্টির নেতা মাও সেতুংয়ের হাতে বার বার হেনস্তা হতে হয়েছিল। ১৯৬৬-৭৬ এর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় শি’কে আরও লাখ লাখ লোকের মতো গ্রামাঞ্চলে নির্বাসিত করা হয়। আরেক মাংয়ের মতো ব্যক্তির যাতে আবির্ভাব ঘটতে না পারে তার জন্য দেং জিয়াও পিংয়ের আমলে পার্টি নেতৃবৃন্দ পার্টি নির্বাহীকে ঘিরে সামষ্টিক নেতৃত্ব কায়েম করেছিলেন এবং নেতৃত্বের সুষ্ঠু উত্তরণ সুনিশ্চিত করার জন্য প্রেসিডেন্ট পদের মেয়াদ সীমিত করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রটোকলগুলো শি জিনপিং ভেঙ্গেচুরে শেষ করে দেয়ায় চীনে উত্তরাধিকার সঙ্কটের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে বলে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা। সূত্র : টাইম
×