ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পটিয়ার জনসভা রূপ নেয় জনসমুদ্রে;###;৪২ উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর ;###;আওয়ামী লীগ মানেই উন্নয়ন

উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আবারও নৌকায় ভোট দিন ॥ শেখ হাসিনা

প্রকাশিত: ০১:৪৯, ২১ মার্চ ২০১৮

উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আবারও নৌকায় ভোট দিন ॥ শেখ হাসিনা

হাসান নাসির/ বিকাশ চৌধুরী, পটিয়া থেকে ॥ পটিয়ায় এসে পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামকে নাড়িয়ে গেলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুধবার বিকেলে চট্টগ্রামের পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের জনসভা রূপ নেয় বিশাল এক নির্বাচনী সমাবেশে। লাখো মানুষের সমুদ্রে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী বললেন, আওয়ামী লীগ মানেই উন্নয়ন। এই আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ভোট দিয়ে আপনারা স্বাধীনতা পেয়েছিলেন। এই আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে দেশের উন্নয়ন হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও বাংলা ভাইয়ের দেশ হিসেবে পরিচিত করিয়েছিল। আমরা শান্তি চাই, উন্নয়ন চাই। সমাবেশে তিনি উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে এবং মানুষের সুন্দর জীবন নিশ্চিত করতে আবারো নৌকা প্রতীকে ভোট প্রত্যাশা করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামসহ সারা দেশে পরিচালিত উন্নয়ন কর্মকান্ডের চিত্র তুলে ধরে বলেন, বর্তমান সরকারের সময়ে এমন কোন এলাকা নেই, যেখানে উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালিত হচ্ছে না। আমাদের কেউ আর দরিদ্র বলে উপেক্ষা করতে পারবে না। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ। এই দেশের মানুষ মাথা উচুঁ করে চলবে। মানুষের আর্থসামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের প্রধান মহাসড়কগুলোকে চার লাইনে উন্নীত করেছি এবং করছি। চট্টগ্রামে মেরিন ড্রাইভ সড়ক করে দিচ্ছি। চট্টগ্রামে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করছি, এলএনজি টার্মিনাল করছি। দেশে ১০০টি ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠা করছি। সেখানে শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে, মানুষ চাকরি পাবে, বেকার সমস্যা সমাধান হবে। বিএনপি-জামায়াতের অপশাসনের উল্লেখ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের সময়ে চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র এসেছিল। এর সঙ্গে ছিলেন খালেদা জিয়ার দুই ছেলে। দূর্নীতির মামলায় আদালতের রায়ে তার সাজা হয়েছে। তারা জনগনের অর্থ আত্মসাত করে বিদেশে পাচার করেছিল। আমাদের সরকার সিঙ্গাপুর থেকে জনগনের অর্থ ফিরিয়ে এনেছে। বেগম খালেদা জিয়ার সাজার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি (খালেদা) এতিমের সম্পদ লুট করেছেন। একটি টাকাও এতিমখানায় দেননি। পুরোটাই আত্মসাত করেছেন। এই মামলা আওয়ামী লীগ দেয়নি। মামলাটি দায়ের হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে। তখন ছিল ফখরুদ্দিন-মঈদ্দিনের সরকার। ওনারা তাদেরই (বিএনপি) লোক ছিলেন। কোর্ট বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে এই রায় দিয়েছে। তারা আইন মানবেন না, কিছুই করবেন না। আন্দোলনের নামে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। বিএনপি-জামায়াত যতবার ক্ষমতায় ছিল প্রতিবারেই মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে। যানবাহনে অগ্নিসংযোগে চালক ও হেলপার পুড়ে অঙ্গার হয়েছে। তাদের সময়ে দেশে জঙ্গি সৃষ্টি হয়েছে। অথচ বর্তমান সরকার দুই দুইবার ক্ষমতায় থেকে দেশব্যাপী দৃশ্যমান উন্নয়ন কাজ করেছে। আমরা মানুষের কল্যাণে সরকার কাজ করে যাচ্ছি। শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সেবামূলক কর্মকান্ডের বর্ণনা তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মায়েদের জন্য আমরা কমিউনিটি ক্লিনিক করে দিয়েছি। দেশে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে ৩০ ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে পাওয়া যাচ্ছে। শিক্ষার উন্নয়নে আমরা উপবৃত্তি চালু করেছি। দেশের ১ কোটি ৩০ লাখ মায়ের কাছে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে উপবৃত্তির টাকা চলে যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত ২ কোটি ২ লাখ ছাত্র-ছাত্রীকে বৃত্তি দিচ্ছি। অর্থের অভাবে যেন কারো লেখাপড়া বন্ধ না হয়ে যায়, সেজন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণে কথা জানিয়ে তিনি বলেন, মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বছরের প্রথম দিন ৩৫ কোটির অধিক বই বিনামূল্যে প্রদান করা হচ্ছে। শ্রেণী কক্ষে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের ব্যবস্থা করেছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ করার ঘোষণা দিয়েছিলাম। তা বাস্তবায়ন করেছি। সকলের হাতে হাতে এখন মোবাইল ফোন। দেশে ৫ হাজার ২৭৫টি ডিজিটাল সেন্টার করে দিয়েছি। আগে বছরের পর বছর সন্তানদের সাথে মায়ের দেখা হতো না। আজ মোবাইল ফোনে কথা বলতে পারেন, সন্তানের চেহারা দেখতে পারেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ সুবিধার বিষয়ে বর্তমান সরকারের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা যুদ্ধ না করলে এদেশ স্বাধীন হতো না, উন্নয়ন হতো না। সে কারণে তাদের ছেলে মেয়ে এবং নাতি-পুতিদের জন্যও চাকরির ব্যবস্থা রাখছি। পাশাপাশি তিনি দেশের সকল মেধাবী সন্তানদের চাকরির বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় আছে বলে উল্লেখ করেন। বিএনপি-জামায়াতের স্বাধীনতাবিরোধী ভুমিকা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা গ্রামের পর গ্রাম পুড়ে ছারখার করে দিয়েছিল তাদের বিচার হচ্ছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তারা ক্ষমতায় এসে সেই স্বাধীনতাবিরোধীদের ক্ষমতায় বসিয়ে ছিলেন। এটা আমাদের জন্য লজ্জার। যারা স্বাধীনতা চায়নি তারাই জাতির জনককে হত্যা করে দেশকে পিছিয়ে দেয়। ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। দেশের উন্নয়ন হয়েছে। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারেনি, দেশ আবার পিছিয়েছে। বিএনপি ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। দেশকে উন্নত এবং দারিদ্রমুক্ত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, আমাদের সরকার দরিদ্র, বিধবা, বয়স্ক সকলের জন্য ভাতা এবং সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেছে। বাংলাদেশে কেউ দরিদ্র থাকবে না। কোন মানুষ কুঁড়েঘরে বসবাস করবে না। যাদের ঘর নেই তাদের আমরা ঘর করে দেব। যাদের জমি নেই তাদের খাস জমি দেব। যাদের জায়গা আছে কিন্তু ঘর করার মত অবস্থা নেই তাদের টাকা দিয়ে সাহায্য করব। এই চট্টগ্রাম থেকে আশ্রয়ন প্রকল্প শুরু হয়েছিল। দারিদ্র বিমোচনে পদক্ষেপ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা অনেকগুলো ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার করেছি, চাকরি নিয়ে বিদেশে যাওয়ার জন্য ব্যাংক ঋনের ব্যবস্থা করেছি। বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋন দেওয়ার সুযোগ রেখেছি। কয়েকজন মিলে একটি ব্যবসা দাঁড় করালে সেখানে আরও ১০জনের চাকরি হতে পারে। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক করেছি। দরিদ্র মায়েদের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতা করে স্মরন করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা মানুষ পুড়ে হত্যা করেছে। এই চট্টগ্রামের বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিনকে তারাই অপহরণ করে হত্যা করেছিল। বিএনপি শুধু আওয়ামী লীগকে নয়, তাদের লোককেও ছাড়েনি। জঙ্গিবাদ বিষয়ে সর্তক করে দিয়ে অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনাদের সন্তান কাদের সঙ্গে মেশে, কিভাবে চলাফেরা করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, কোন ছাত্র দিনের পর দিন অনুপস্থিত রয়েছে কিনা খোঁজ নিন। তিনি বলেন, নির্যাতন ও মানুষ হত্যা করে কেউ বেহেস্তে যেতে পারে না। মানুষ হত্যা করে দোজখে যেতে হবে। নিরীহ মানুষ হত্যার কথা কোন ধর্ম বলেনি। বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে উন্নয়নের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে তখন বিদ্যুতের উৎপাদন ছিল ১৬শ মেগাওয়াট। আমরা ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছি। ২০০১ সালে গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে। আমরা আবার ক্ষমতায় আসার পর ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছি। চট্টগ্রামের উন্নয়নে তাঁর সরকারের ভুমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশের সার্বিক উন্নয়ন কর্মকা-ের আওতায় দক্ষিণ চট্টগ্রাম এবং পুরো চট্টগ্রাম বিভাগে উন্নয়ন হয়েছে। আজ ১৪টি উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন এবং ২৮টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছি। জাতির পিতাকে হত্যার পর জীবন শংকায় থাকার প্রসঙ্গে এনে তিনি বলেন, আমি আমার বাবা-মাকে হারিয়েছি। ভাই-ভাইয়ের বউ ও ফুফা-ফুফিকে হারিয়েছে। আমি এবং আমার বোন রেহেনা দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছি। ৬ বছর আমরা দেশে ফিরতে পারিনি। ১৯৮১ সালে আমাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি করার পর জনগণের সমর্থনে আমি দেশে ফিরে এসেছি। আমার চাওয়া পাওয়া কিছু নেই। আমি চাই এদেশের মানুষের সুন্দর জীবন। জনগণ যাতে সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে সেটি আমার চাওয়া। নৌকা প্রতীকে ভোট চেয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনাদের ভোটে আবার যদি ক্ষমতায় আসি তাহলে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকবে। নৌকা মার্কায় ভোট দেবেন, দেশ উন্নত হবে। এসময় তিনি আগামী নির্বাচনে নৌকায় ভোট দিয়ে আবারও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনবেন কিনা জানতে চাইলে হাত উঁচিয়ে সমর্থন জানায় লাখো জনতা। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোসলেম উদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আরও বক্তৃতা করেন দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ, প্রচার সম্পাদক ড. হাসান মাহমুদ এমপি, ভুমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এমপি, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আলম চৌধুরী, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, পটিয়ার সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরী, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এমএ ছালাম, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ চৌধুরী এমপি, মহিবুল হাসান নওফেল, এনামুল হক শামীম, কেন্দ্রীয় নেতা আমিনুল ইসলাম আমিন, পটিয়া উপজেলা আ’লীগ সাধারণ সম্পাদক পৌর মেয়র অধ্যাপক হারুনুর রশিদ প্রমুখ। উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রী পরিষদ সদস্য, মাঈনুদ্দিন খান বাদল এমপি, এমএ লতিফ এমপি, নজরুল ইসলাম চৌধুরী এমপি, ড. আবু রেজা মো. নদভী এমপি, মোস্তাফিজুর রহমান এমপি। এই জনসভায় পটিয়া, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা, বোয়ালখালী ও নবসৃষ্ট কর্ণফুলী উপজেলা ছাড়াও চট্টগ্রাম মহানগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে হাজার হাজার নেতাকর্মী মিছিল নিয়ে জনসভায় যোগ দেন।
×