ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এইচএসসি পরীক্ষা ॥ প্রশ্নপত্র ফাঁস ও শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী এবং পিতা মাতার দায় -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২২ মার্চ ২০১৮

এইচএসসি পরীক্ষা ॥ প্রশ্নপত্র ফাঁস ও শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী এবং পিতা মাতার দায় -স্বদেশ রায়

আমি শিক্ষক নই। অতিথি হিসেবে ছাড়া কখনও ছাত্রদের সামনে দাঁড়াইনি। তাই ছাত্রছাত্রী বা অভিভাবকদের প্রতি আমার কিছু বলা শোভন কিনা বা এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে কিনা, তা জানি না। তবে সন্তান মনে করে ছাত্রছাত্রীদের প্রতি আর ভাই-বোন মনে করে অভিভাবকদের প্রতি হয়ত কিছু বলতে পারি। তাতে নিশ্চয়ই কেউ আমাকে দোষ দেবেন না। আগামী ২ এপ্রিল এইচএসসি পরীক্ষা। ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের প্রতি অনুরোধ, আপনারা নিজ চেষ্টায় পরীক্ষাকে পরীক্ষা করে তুলুন। পরীক্ষার অর্থই তো হলো নিজেকে যাচাই করা। এখন নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে আমি যদি উত্তর না পাই যে, এই পরীক্ষার মাধ্যমে সঠিকভাবে নিজেকে যাচাই করতে পেরেছি, তাহলে সেটা আর যাই হোক পরীক্ষা হলো না। বিবেকের পাশাপাশি একটা নির্মম সত্য হলো, কোন এক ফাঁকির মাধ্যমে পরীক্ষা দিয়ে হয়ত সাময়িক একটা ভাল রেজাল্ট করা যায়, কিন্তু দীর্ঘ জীবনের কর্মক্ষেত্রে তার কোন সুফল পাওয়া যায় না। মানুষের জীবনে কাজের ক্ষেত্রটি অনেক দীর্ঘ। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় দুটো বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখতে হয়- এক. জীবনে কখনই তড়িঘড়ি করে সাফল্য লাভ করা যায় না। দুই. সঠিক যোগ্যতা ছাড়া কখনই সাফল্য আসে না। মানুষের ইতিহাসে ব্যতিক্রমী কিছু ঘটনা ঘটে, অনেক সময় অনেক অযোগ্য লোক কোন বড় স্থানে অধিষ্ঠিত হয়। কালের পরিক্রমায় সেটা আবার সংশোধিত হয়ে পুনরায় সিংহ থেকে ইঁদুরের আকৃতিতে চলে আসে। এটাই পৃথিবীর বাস্তবতা। তাছাড়া চরম সত্যটি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাঁর দ্বিতীয় ভাগে বলে গেছেন। ‘যোগ্যতার বিকল্প নেই’Ñ একটি শিশু মনে এই চরম সত্যটি গেঁথে দেয়ার জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তার দ্বিতীয় ভাগেই এটা লিখেছিলেন। পাকিস্তান হওয়ার পরে স্কুল পাঠ্য থেকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাদ দেয়া হয়েছে। এর পরে আর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ফিরে আসেননি আমাদের পাঠ্যে। তার বিপরীতে যে শিশু পাঠ্য বা স্কুল পাঠ্যবই আমরা এখন পড়াই, এ নিয়ে কথা বলতে গেলে লেখার বিষয় অন্য দিকে চলে যাবে। তবে যোগ্যতা ছাড়া কী হয় তার উদাহরণ বড়ই নির্মম। সত্যি অর্থে বলতে কী, এই বেকারে ভর্তি দেশে আমরা চাকরি দিতে চেয়েও চাকরি দিতে পারি না। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতা বিভাগে পাস করে সাংবাদিকতা করার জন্য আসে অনেক ছাত্রছাত্রী। তাদের কচি মুখ দেখে চাকরি দিতে ইচ্ছে করে, কিন্তু যখন দেখি সে পাঁচ লাইন বাংলা বা ইংরেজী শুদ্ধ করে লিখতে পারে নাÑ তখন তাকে আর চাকরিটি দেয়া সম্ভব হয় না। তাই প্রতিটি ছাত্রকে মনে রাখতে হবে, পরীক্ষার ভাল রেজাল্টের থেকেও কাজের ক্ষেত্রে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন অনেক বেশি জরুরী। মনে রাখা দরকার, আগামী দিনে সরকারী চাকরির ক্ষেত্রে পরীক্ষা নেয়া থেকে শুরু করে সবই যখন টেকনোলজিনির্ভর হয়ে যাবে, তখন ভাল পড়াশোনার বিকল্প নেই। তাছাড়া ফাঁকি দিয়ে কখনই কোন ভাল সরকারী কর্মকর্তা হওয়া যায় না। বরং অনেক লজ্জিত অবস্থায় চাকরি করতে হয়। কর্মক্ষেত্রে নিজের অবস্থানের শতভাগ যোগ্য যদি না হওয়া যায়, তাহলে তার থেকে লজ্জার আর কিছু নেই। বর্তমানের ছাত্রদের আরও একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, আজ হয়ত ফাঁকি দিয়ে, সহজ পথে অর্থ উপার্জন করে অনেকে অনেক কিছু করছে। তবে এই সুযোগ বেশি দিন থাকবে না। বিশেষ করে আজ যারা এইচএসসি পরীক্ষা দিতে যাচ্ছ তোমরা যখন কাজের ক্ষেত্রে আসবে ততদিনে দেশের অনেক পরিবর্তন হয়ে যাবে। দেশ শুধু বিশ্ব সড়কেই পা দেয়নি, পৃথিবীও তোমার কাছে এগিয়ে এসেছে। তাই আগামী পাঁচ বছর পরে দেখা যাবে সম্পূর্ণ নতুন এক বাংলাদেশ। সে বাংলাদেশের তখন মান নির্ধারণ হবে বিশ্বমানের পাল্লায় মেপে। সেখানে এই প্রশ্নপত্র ফঁাঁস হওয়া পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে বা মাদ্রাসায় এক শ’ মার্কের ভেতর পঞ্চাশ পাওয়ার যোগ্য যে নয় সে নব্বই পেয়ে পাস করেছে, এমন রেজাল্ট দিয়ে টেকা যাবে না। এই মুহূর্তে আমাদের দেশের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাচ্ছি, অনেক বহুজাতিক কোম্পানিতে শুধু নয়, বড় বড় দেশীয় কোম্পানিতেও বিদেশীরা বড় বড় পদে চাকরি করছেন। এর অন্যতম কারণ হলো আমাদের শিক্ষার মান। আমাদের ছেলেমেয়েরা ওই পদের ঠিক যোগ্য হতে পারছে না শিক্ষার অভাবে। ওই সব বড় বড় পদে দেশী বা বিদেশী যারা যে যেখানে কাজ করছেন, আমাদের ছেলেমেয়েরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারবেন ওঁরা কেউই ছোটবেলা থেকে শুধু কারিকুলামের পড়া পড়ে বড় হননি। তাঁরা পড়ার বাইরে অনেক পড়েছেন, অনেক বিষয়ে আগ্রহী হয়ে সে সব যোগ্যতা অর্জন করেছেন। আর সেগুলোই তাদের মনোজগতকে বহুমাত্রিক করেছে। যে কারণে তাঁরা দু’হাতে হাজারটি দায়িত্ব শুধু সামলাচ্ছেন না, প্রতিদিন কর্মক্ষেত্রকে কিছু না কিছু উদ্ভাবনী পথ খুলে দিচ্ছেন। ভাষাজ্ঞানের বিষয়টিও এখানে কাজ করে। আমাদের ভুল শিক্ষানীতির কারণে মাতৃভাষাটিও যেমন আমরা ভালভাবে জানি না, তেমনি দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাষাও ভালভাবে জানি না। তৃতীয় ভাষা তো দূরে থাক, দ্বিতীয় ভাষা জ্ঞানও খুব কম লোকের আছে। আমাদের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রশাসনের সংস্কারের জন্য একটি রিপোর্ট তৈরি করেছিলেন। তার সামান্য অংশ একটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সেখান থেকে জানা যায়, বিদেশী কোন প্রতিনিধি দলের মিটিং থাকলে আমাদের প্রতিনিধি দলের অনেকে সেদিন অসুস্থতার কথা বলে আসেন না। এর মূল কারণ দ্বিতীয় ভাষা জ্ঞান না থাকা। এ কারণেই অযোগ্যতাকে সঙ্গে রেখে, ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র দেখে প্রস্তুতি নিয়ে জিপিএ ফাইভ পেয়ে লাভ কী? বরং প্রতিটি ছাত্রকে নিজের মনকে নিজেই উদ্বুদ্ধ করতে হবে, জিপিএ ফাইভ নয়, আমি লেখাপড়া শিখব। আমি প্রকৃত জ্ঞানী হব। বর্তমান বিশ্বের সব থেকে বড় সম্পদ নলেজ এবং ইনফরমেশন। এ দুটোতে সম্পদশালী হতে হলে প্রকৃত শিক্ষা ছাড়া বিকল্প নেই। শিক্ষকদের কিছু বলার যোগ্যতা আমি রাখি না। কারণ তাঁরা শিক্ষক। তাঁরা জ্ঞানী। তবে তার পরেও বলব, শিক্ষকদেরও জানতে হবে বর্তমান পৃথিবীকে। শুধু কারিকুলামের প্রশ্ন পড়াতে পারলেই একজন শিক্ষক হন না। শিক্ষক তিনিই যিনি তাঁর ছাত্রছাত্রীকে হাত ধরে নিয়ে যান জ্ঞানের রাজ্যের দরজায়। শিক্ষককে যে শেখাতে হবে তাও নয়, শিখবে ছাত্র নিজেÑ শিক্ষক শুধু তার ছাত্রছাত্রীকে জানিয়ে দেবেন ওই খানে, ওই ভাবে তুমি শিখতে পারবে। কথাটা এভাবেও বলা যায়, শিক্ষার্থী যেন বলতে পারে, আমার গুরু সেই গুরু যিনি কেবল গান শেখান না, আমাকে গানের রাজ্যে নিয়ে যান। আমাদের শিক্ষকদের ধীরে ধীরে অনেক বেতন বাড়াচ্ছে বর্তমান সরকার। সরকারের আরও বেতন বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে। তাই শিক্ষকদেরও উচিত হবে আর চাকরি করা নয়, নিজেকে শিক্ষকে পরিণত করা। একটি দেশের কয়েকজন শিক্ষকই বদলে দিতে পারেন জাতীয় চরিত্র। আজকের এই ছাত্রদের নৈতিক অধঃপতন, অর্থাৎ ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র খেঁাঁজাÑ এর জন্য শুধু অভিভাবকরাই দায়ী নন, শিক্ষকরাও দায়ী। তাই তাঁদেরও সেখান থেকে বের হয়ে আসতে হবে। ছাত্রকে নিজের সন্তান মনে করতে হবে। যে শিক্ষক তাঁর ছাত্রকে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের পেছনে ছুটতে বলেন, তাঁকে অন্তত একবার মনে করতে হবে, তিনি কি তার সন্তানকে চুরি করতে শেখাবেন? সর্বোপরি অভিভাবক অর্থাৎ পিতা-মাতা। ছোটবেলায় পড়েছি, পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম। অর্থাৎ পিতার ভেতরই সন্তানের বেহেশত বা স্বর্গ আর পিতাই অনুকরণীয় বা ধর্ম। অন্যদিকে মা সম্পর্কে জেনেছি, জন্মভূমি ও স্বর্গের থেকে বড় জননী। যে দেশমাতার জন্য আমরা প্রাণ উৎসর্গ করি ওই দেশমাতা এবং যে স্বর্গ আমরা কল্পনা করি বা পৃথিবীতে যে স্বর্গীয় সুখ গড়তে চাই, তার থেকেও বড় মা। সন্তানের কাছে বাবা ও মায়ের অবস্থান এটাই। সেখানে বাবা ও মা যদি সন্তানকে অনৈতিকতা শেখান তাহলে ওই সন্তান তো পৃথিবীকে স্বর্গের বদলে দোজখে পরিণত করবে। আর সেই দোজখের আগুন থেকে ওই বাবা-মাও রক্ষা পাবেন না। পার্থিব জীবনটা সুখী করতে গেলে গোটা পরিবারজুড়ে একটা নৈতিকতা দরকার। এ তো গেল শুধু নৈতিকতার দিক। তাছাড়া নিজের সন্তানকে যদি যোগ্য করে গড়ে তোলা না যায়, তাহলে তার ভবিষ্যত কখনই ভাল হবে না। যোগ্য না হলে যত চেষ্টাই সে করুক পৃথিবীর মঞ্চে ভাল কোথাও সে পৌঁছাতে পারবে না। বাবা ও মায়েরা তো দেখতেই পাচ্ছেন হাজার হাজার জিপিএ ফাইভ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজীতে ফেল করছে। আর তাদের ভবিষ্যতের কাজের ক্ষেত্রগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে সহ¯্রগুণ প্রতিযোগিতার। সেখানে যে, তাদের পাস করা কত কঠিন বাবা-মায়েদের এখন থেকেই সেটা বোঝা উচিত। যে বাবা-মা সন্তানকে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র দিচ্ছেন, তিনি নিজের হাতেই নিজের সন্তানকে বিষ তুলে দিচ্ছেন। তাই অতীতে যে যাই করেছেন, এখন সন্তানকে সন্তান হিসেবে দেখুন। কেবল জিপিএ ফাইভের রেসের ঘোড়া মনে করবেন না। আমাদের শিক্ষামন্ত্রীকে নিয়ে এই কলামে আমি আগে লিখেছি। এবার এইচএসসি পরীক্ষা সামনে রেখে বলি- তাঁর কাছে জাতি আর কিছুই আশা করে না। তিনি যে কিছুই দিতে পারেন না ও পারবেন না, সেটা প্রমাণিত। তাই এ দেশে যা হয়েছে সেটাই এখন বাস্তবতা হিসেবে বলতে হবে, সকল মুশকিল আসানের দায় একজনের। তিনি শেখ হাসিনা। তিনি প্রধানমন্ত্রী। প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে তাঁকেই এখন উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ তিনি শুধু একজন সফল রাজনীতিক, সফল প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি একজন সফল মা। দেশের অন্য সন্তানরা যাতে তার সন্তানের মতো সৎ ও যোগ্য হয়, সে কাজের ভার এই বয়সেও তাঁকেই বহন করতে হবে। অন্যরা গাড়ি, বাড়ি আর পতাকার সুখ নিয়ে থাকুন। তাদের সুখ-দুঃখে জাতির কারও কিছু যায় আসে না। তাদের দেনা তারা সময় মতো শোধ করতে বাধ্য হবেন। অন্যদিকে শেখ হাসিনা যেহেতু তাঁর পিতার মতো আমাদের দুঃখ রাতের রাজা, তাই তাঁকেই তো সব দুয়ারে আঘাত হেনে দুয়ার খুলতে বলতে হবে। তাঁর কাছেই আশা করি- তিনি এবার নিজের থেকে নজর দিয়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি প্রশাসনিকভাবে ঠেকানোর চেষ্টা করবেন। তবে আবারও বলি, এখানে দায়টা পিতা-মাতার, শিক্ষার্থীর, শিক্ষকের সব থেকে বেশি। আর এ দায়বোধটি আনতে হবে বুকের ভেতর থেকে। একজন শিক্ষার্থী যদি জোর গলায় বলে, আমার সামনে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পড়ে থাকলেও আমি দেখব না- এই আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে এবার চলা শুরু হওয়া দরকার। যদিও সে একলা শুরু করবে- তবে ভবিষ্যতে পথের শেষে দেখা যাবেÑ তার পথের সাথীর সারি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। [email protected]
×