ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাশার খান

খাকি পোশাক দেখলেই তেড়ে আসেন খোদেজা

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ২৩ মার্চ ২০১৮

খাকি পোশাক দেখলেই তেড়ে আসেন খোদেজা

নাম তার খোদেজা খাতুন। কঙ্কালসার দেহ। চোখে উ™£ান্ত দৃষ্টি। মানসিক ভারসাম্যহীন প্রায় সত্তর বছর বয়সী এই নারী প্রতিদিন হাঁটেন মাইলের পরম মাইল। কেউ খেয়াল করলে মনে হবে উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটছেন খোদেজা । হঠাৎ থামেন। কথা বলেন নিজের সঙ্গে নিজে। আবার হাঁটেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ স্বামীর লাশ পথে পথে এভাবেই আজও খোঁজেন খোদেজা। খোদেজাকে কেউ কেউ খোদেজা পাগলী বলেও ডাকে। কেউ ডাকেন ফিরোজা নামে। কেউ আবার কোন নাম ধরেই ডাকে না। ‘এই, তুই’ বলে সম্বোধন করে। ফিরোজা মানসিক ভারসাম্যহীন হলেও কারও ক্ষতি করেন না। কিন্তু খাকি পোশাকের কাউকে দেখলে আর রক্ষা নেই। বিডিআর [বর্তমান বিজিবি] বা পুলিশ দেখলে খেপে যান। সামনে যা পান তাই ছুড়ে মারেন। গত ৪৬ বছর ধরে প্রতিদিনই সকালে ঘর থেকে বের হয়ে যান। ফেরেন সন্ধ্যায়। এখনও স্বামীর লাশ খোঁজেন পথেঘাটে ও স্থানীয় বাজারে। খোদেজার বাড়ি কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রামের জগন্নাথ দীঘি ইউনিয়নের সোনাপুর গ্রামে। স্বামী শহীদ বাচ্চু মিয়া ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের ইনফরমার। স্থানীয় আনসার কমান্ডার আব্দুল মান্নান জানান, ‘একাত্তরের রমজান মাস। আমরা মসজিদে তারাবি নামাজ পড়ছিলাম। এ সময় স্থানীয় একজন রাজাকারের ওপর গ্রেনেড চার্জ করে মুক্তিযোদ্ধারা। সেই রাজাকার আমাদের মসজিদে এসে আশ্রয় নেয়। মসজিদে ঢুকে পড়ায় মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের অভিযান দীর্ঘায়িত না করে চলে যান সে রাতে। প্রাণে বেঁচে যায় রাজাকারটি। সকালে শুনতে পাই, সোনাপুরের বাচ্চু মিয়া ও ফজল মিয়াকে শেষ রাতে হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে গেছে এবং হত্যা করেছে। তাঁদের লাশও পাওয়া যাচ্ছে না। দেশ স্বাধীন হলে বাচ্চু মিয়ার স্ত্রী খোদেজার মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। যাকে সামনে পায়, তাকেই গালি দিতে শুরু করেন। বলেন, ‘আর স্বামী মারি হালাইছস, বাইন্ধ লই গেছস। গাড়ি দেখলে চিৎকার করে ঢিল মারে আর বলেন, ‘আর ফুতেরে লই যায় গৈ, আর ফুতেরে লই যায় গৈ।’ পাশেই জগন্নাথ দীঘি বিডিআর [বর্তমান বিজিবি] ক্যাম্প। সেখানে খাকি পোশাক পরা কাউকে দেখলেই খেপে যান। পাথর ছুড়ে মারেন। পুলিশ দেখলেও চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেন। পাথর মারেন। গত ৪৬ বছর ধরে এভাবে চলছে খোদেজার দিনকাল। জানা যায়, স্বামী বাচ্চুকে ধরে নেয়ার রাতে পাকিস্তানী আর্মির দ্বারা খোদেজা ও ওই বাড়ির আরেকজন নারী পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। স্থানীয় জগন্নাথ দীঘি ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেন বলেন, বাচ্চু ও তাঁর জেঠাত ভাই ফজল আমাদের ইনফরমার ছিল। ছদ্মবেশে রাজাকার ও পাকিস্তান আর্মির কাছাকাছি থাকতো তারা এবং আমাদের কাছে শত্রুর গতিবিধি ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করতো। এ কারণেই রমজান মাসে একদিন গভীর রাতে তাঁদের দু’জনকে ধরিয়ে দেয় রাজাকাররা। পরে আমরা প্রতিশোধ নিতে কয়েকবার অভিযান চালাই। দেশ স্বাধীন হলে রাজাকারটিকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এলাকা ছেড়ে চলে যায় সে। স্বামী হারানো ও নিজের ওপর চালানো পাশবিক র্নিযাতনের শোকে খোদেজা একসময় পাগল হয়ে যায়। খাকি পোশাক তার শত্রু। দেখলেই গালি শুরু করেন। খোদেজার এই ঘটনা এলাকার হাজার হাজার মানুষ জানে। খোদেজার ছেলে মাহবুব বর্তমানে গ্রামের চায়ের দোকানদার। তিনি জানান, ‘একাত্তরে আমার বয়স ছিল ১০ বছর। ভারতের বটতলা ক্যাম্পে কমান্ডার জসিম মিয়া ও শামসুল হক মজুমদারের নেতৃত্বে কাজ করতেন আমার বাবা বাচ্চু মিয়া। তাদের নিয়মিত খবরাখবর দিতেন। রাতে গোপনে মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের বাড়িতে আসতেন। এই কারণেই বাবাকে পাকিস্তানী আর্মি দিয়ে হত্যা করানো হয়। যেদিন বাবা ও আমার জেঠাকে ধরে নিয়ে যায় হানাদার বাহিনী, তার কিছুক্ষণ আগে বাবা ঘরে এসেছিলেন। বাবা ঘরে আসার পর পরই আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে হানাদার বাহিনী। আমার বাবাকে নিশ্চয়ই স্থানীয় কেউ ফলো করেছিল। গভীর রাতে বাবা বাড়িতে এসেছেন, এই খবর পাকিস্তানী আর্মির জানার কথা নয়। পরে সবই শুনছি, কে মারাইছে বাবাকে।’ মায়ের কথা জানতে চাইলে মাহবুব বলেন, ‘এই শোকেই মা মানসিক ভারসাম্য হারান। সকালে বেলা মন চাইলে কিছু খান, না চাইলে খান না। বেরিয়ে পড়েন। হাঁটেন মাইলের পর মাইল। জগন্নাথ দীঘির পাড়ে বসে থাকেন। ১৯৭১ সালে ওখানে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। অনেক লোক সেখানে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। প্রথম দিকে জোর করে মাকে আটকে রাখার চেষ্টা করতাম। কিন্তু রাখা যেত না। এখন আর কিছু বলি না। কী করব। বিডিআর ক্যাম্পে গিয়ে ঢিল মারে। প্রথম দিকে বিডিআররা খেপে যেত। পরে এলাকাবাসীর কাছে সব ঘটনা জানার পর এখন আর মাকে কিছু বলে না তারা। ঢিল মারতে গেলে বুঝিয়ে শুনিয়ে রুটি বা কলা দেয়। সন্ধ্যা হলে ফিরে আসেন মা। আবার সকালে চলে যান। এভাবেই চলছে মার জীবন।’ সরেজমিন সোনাপুর গ্রামে গিয়ে এই তথ্য নেয়ার দিন [১২ মার্চ ২০১৮] মাহবুবের মা খোদেজা কোথায় আছেনÑ সেই খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। সেদিন বিকেলে মোটরসাইকেল ও সাইকেলযোগে কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে খোদেজার অবস্থান জানার চেষ্টা করা হয়। এরপর দেখা যায়, চৌদ্দগ্রামের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক সংলগ্ন জগন্নাথ দীঘি পুরনো ডাকবাংলোর পাশে একাকী বসে আছেন খোদেজা। কিছুক্ষণ পর উঠে হাঁটা শুরু করেন। তাঁকে অনুসরণ করা হয়। এভাবে মাইলখানেক হাঁটার পর একটি বাড়িতে প্রবেশ করেন খোদেজা। বাড়ির লোকজনও তাঁকে চেনে এবং জানে। বাড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গে খোদেজা মাঝেমধ্যে কথা বললেও অপরিচিত হওয়ায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কোন কথা বলতে চাচ্ছিলেন না। পরে বাড়ির লোকজনের সহযোগিতায় খোদেজাকে কথা বলানোর চেষ্টা করা হয়। ভাগ্য সুপ্রসন্ন যে খোজেদা এ সময় কয়েকটি বাক্য বলেন যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘আর স্বামীরে সংগ্রামের সময় মারাই হালাইছে।’ [অর্থাৎ কেউ হত্যা করিয়েছে।] তারপর আবার বলেন, ‘আর স্বামীরে মারাই হালাইছে। নাম কইলে ভেজাল।’ এরপর বলেন, ‘লাশটা ফরতেক দিন আই টোয়াইতাম যাই (খুঁজতে যাই)। হাইনো। আরে দেখলে দরজা-জানালা বেক বন্ধ করি হালায় হেতারা।’ এ কথা বলতে বলতে বাড়ির ভেতরে চলে যান খোদেজা । দেশ স্বাধীন হয়েছে ৪৬ বছর। অনেক শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবার সরকারী সহযোগিতা পেয়েছেন। নিয়মিত এখনও অনেকেই পাচ্ছেন। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে খোদেজার ছেলে মাহবুব জানান, বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে কিছু শুকনো খাবার পেয়েছিলাম। এরপর আর কিছু পাইনি। খেয়ে না খেয়ে জীবন কাটে আমাদের। বাবা যে মুক্তিবাহিনীর ইনফরমার ছিলÑ এই কথা এলাকার সবার মুখে মুখে ফেরে। কিন্তু আমরা মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সনদ পাইনি আজও। আর মায়ের কথা কী বলব। কবে কোথায় মরে পড়ে থাকে কে জানে। স্বাধীনতার পর আমার ছোট ভাইটা ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়। সে এখন প্রতিবন্ধী। আমাদের দুঃখের শেষ নেই।’ লেখক : মুক্তিযুদ্ধ গবেষক [email protected]
×