ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মতি লাল দেব রায়

চা শ্রমিকদের দুঃখ কথা

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২৩ মার্চ ২০১৮

চা শ্রমিকদের দুঃখ কথা

(বুধবারের পর) টি রিসোর্ট এটি হচ্ছে বাংলাদেশ চা বোর্ডের একটি বিরাট গেস্ট হাউস। যেখানে ভাড়া দিয়ে থাকার সুব্যবস্থা আছে। এখানে অনেক বাংলোও থাকার জন্য ভাড়া দেয়া হয়। আধুনিক সকল উপকরণ বা সুযোগ-সুবিধা এই গেস্ট হাউসে আছে। এটি চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের কাছাকাছি অবস্থিত। গেস্ট হাউসের এলাকায় সুইমিং পুল, গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থাসহ খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা আছে। ওয়ার্কশপ সেমিনার করার জন্য হলরুম আছে। এটি চা বোর্ডের একটি আয় সৃষ্টিকারী প্রকল্প। ভবিষ্যতে এটিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা যায় কি-না তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। এই টি রিসোর্টে একজন ম্যানেজারসহ অফিস ক্লার্ক ও অন্যান্য কর্মচারীর কর্মসংস্থান হয়েছে। এখানে গেট কিপার/দারোয়ান হিসেবে মাঝে মধ্যে চা শ্রমিকের দেখা মিলে। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন ১৬৫টি চা বাগানের মধ্যে ৯০টি চা বাগান মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত। চা বাগানের শ্রমিকদের দাবি আদায়ের জন্য এই ইউনিয়ন গঠিত। মেইন বাগানসহ ফাঁড়ি বাগান মিলে ২৪০টি চা বাগানে ৫-২২ জন সদস্যবিশিষ্ট ২৪০টি চা শ্রমিক পঞ্চায়েত আছে। একটি বাগানের পঞ্চায়েতে কতজন সদস্য থাকবে তা নির্ভর করে মূলত বাগানের শ্রমিকদের সংখ্যা ও বাগানের আয়তনের ওপর। চা শ্রমিক ইউনিয়নের ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি কেন্দ্রীয় কমিটি ২ বছর মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হয়। প্রতি শ্রমিক মাসে ১০ টাকা হারে ঐ ইউনিয়ন ফান্ডে জমা করে যাহা শ্রমিকদের কল্যাণে ব্যয় হয়। ইদানীং ঐ জমাকৃত টাকা নিয়ে তাদের মধ্যে অসন্তুষ্টি আছে। তারা মনে করেন ঐ টাকা সত্যিকারভাবে তাদের উন্নয়নে ব্যয় হচ্ছে না। এই শ্রমিক ইউনিয়নকে অনেকে ট্রেড ইউনিয়ন বলে আখ্যায়িত করেন। এটাই চা শ্রমিকদের একমাত্র দরকষাকষির সংগঠন, এর কেন্দ্রীয় অফিস শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত। ইউনিয়ন করার স্বাধীনতা ১৯৪৮ সাল থেকে সরকার কর্তৃক স্বীকৃত। বর্তমানে এই ইউনিয়নে ৮৭৫৩৫ জন রেজিস্টার্ড সদস্য আছেন। এ সংগঠনের অধিক হারে মহিলা শ্রমিকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন চা শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষণ করা এবং সমস্যা সমাধানের জন্য চেষ্টা চালোনোর কথা কিন্তু বাস্তবে তারা মালিক পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণে বেশি ব্যস্ত থাকেন বলে শ্রমিকরা অভিযোগ করেন। তাই তারা এখন আর চা শ্রমিক ইউনিয়নের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না তাদের এখন কোন রকম সহযোগিতা করেন না। বাংলাদেশ টি স্টেট স্টাফ এ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ টি স্টেট স্টাফ এ্যাসোসিয়েশনের সদস্যগণ বাগানের স্টাফদের ভোটে ২ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। তারা স্টাফদের সমস্যা, দাবি-দাওয়া ইত্যাদি মালিকপক্ষের কাছে তুলে ধরেন, এই এ্যাসোসিয়েশনের অফিস শ্রীমঙ্গল শহরে অবস্থিত। বাবুদের অবসরে যাওয়ার পর তাদের অবসর ভাতা ইত্যাদি আদায়ে যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা রাখেন। এই সংগঠন একটি ফান্ড সংরক্ষণ করে যা দ্বারা স্টাফ মেম্বারদের কোন সমস্যা হলে সমাধানের চেষ্টা করা হয়। প্রয়োজনে আইনী সহায়তায় এই ফান্ড ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশ চা সংসদ বাংলাদেশ চা সংসদ হচ্ছে চা বাগান মালিক পক্ষের একটি সংগঠন। এটি মালিকদের এবং শ্রমিকদের মধ্যে সমস্যা সমাধানের জন্য গঠিত। বাস্তবে তারা শ্রমিকদের কোন সমস্যা মনোযোগের সঙ্গে দেখেন না তারা মালিকপক্ষের স্বার্থ কিভাবে রক্ষা করা যায় তাই বেশি দেখেন। দেশী-বিদেশী সকল পর্যায়ের মালিকগণ সমাজের খুব উঁচুপদ মর্যাদার মানুষ তাই শ্রমিকদের সাধারণ সমস্যা তাদের কাছে পৌঁছায় না। অধিকাংশ বাগানের মালিক বাগানে থাকেন না তাই মাঝে মাঝে চা বাগানের ছোট খাটো দাবি-দাওয়া নিয়ে অসন্তোষ দেখা দেয়Ñ যা অনেক সময় ভয়ানক হয়ে ওঠে। টি ব্রোকার্স এ্যাসোসিয়েশন টি ব্রোকার্স এ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ টি-বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত। এই এ্যাসোসিয়েশনের দায়িত্ব হচ্ছে দেশে এবং বিদেশে চা বিক্রির ব্যবস্থা করা। টি ব্রোকার্স এ্যাসোসিয়েশন মালিকপক্ষ এবং চা ক্রেতার মধ্যে একটি মিডিয়া সেন্টার হিসেবে কাজ করে। এই ব্রোকার্সরা মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ও চায়ের গুণগতমান দেখে কেজি প্রতি চায়ের দাম নির্ধারণ করেন। ব্রোকার্সরা শতকরা ১ টাকা কমিশন নেন। বাংলাদেশে টি বোর্ড কর্র্তৃক অনুমোদিত ৬টি ব্রোকার্স আছে (১) প্রডিউচ ব্রোকার্স (২) ন্যাশনাল ব্রোকার্স (৩) বাংলা দেশ টি ব্রোকার্স (৪) পূর্ববাংলা ব্রোকার্স (৫) প্রগ্রেসিভ ব্রোকার্স (৬) ইউনিটি ব্রোকার্স। সবকটি ব্রোকার্স এর অফিস চট্টগ্রামে অবস্থিত। টি ব্রোকার্স এ্যাসোসিয়েশন হচ্ছে টি ব্রোকার্সদের সরকার অনুমোদিত একটি এ্যাসোসিয়েশন। এখানে ও চা শ্রমিকদের কোন অংশগ্রহণ নেই যা কল্পনা করাও অবাস্তব। টি অকশন বিডার্স টি অকশন বিডার্স হচ্ছে চা বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত ব্যবসায়ী হাউস। যারা চট্টগ্রামে অকশনে অংশ গ্রহণ করে চা কিনতে পারেন। তারা চা বোর্ড কর্তৃক দেয়া লাইসেন্সপ্রাপ্ত। সাধারণ চা বিক্রেতা পাইকারী চা ক্রয় এবং বিক্রয় করতে পারেন কিন্তু অকশনে বিডার্সের মত অকশনে অংশগ্রহণ করতে পারেন। চা শ্রমিক অথবা এ জনগোষ্ঠীর একজনকে চা বিক্রেতা হিসেবে পাওয়া গিয়েছে কিন্তু অকশন বিডার্স হিসেবে কোন চা শ্রমিক বা নেতার অংশগ্রহণ নেই। টি ট্রেডার্স এ্যাসোসিয়েশন টি ট্রেডার্স এ্যাসোসিয়েশন হচ্ছে ১২০টি অকশন বিডার্স নিয়ে গঠিত সংগঠন। টি বিজনেস হাউস দেখাশুনা করা টি ট্রেডার্স এ্যাসোসিয়েশন এর কাজ। এখানেও চা জনগোষ্ঠী অনুপস্থিত। বাডস রেসিডেন্সিয়েল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ, শ্রীমঙ্গল ১৯৭৪ সালে প্ল্যান্টারসদের ছেলে মেয়েদেরকে ইংরেজি ভাষাতে লেখাপড়া শেখানোর জন্য বাডস রেসিডেন্সিয়েল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ নামক এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি চা বাগান কর্তৃপক্ষের সহায়তায় স্থাপিত হয়। সেখানে প্রধানত বাগান ব্যবস্থাপকদের ছেলে-মেয়েদেরকে পড়াশোনার কথা। চা বাগান থেকে অনেক দূরে শহরের এক কোণায় তৈরি করা হয় এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কোন চা শ্রমিকের ছেলে মেয়েদের পক্ষে এ স্কুলে যাওয়া ও আসার কোন সুযোগ সুবিধা নেই। চা বাগানের শ্রমিকের ছেলে মেয়েদের সাথে বাবু, ম্যানেজারদের ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া করবে এ কেমন কথা, এত সাহস কারও নেই। তাছাড়া সাহেব বাবুদের ছেলে মেয়েদের মেধা এবং অপুষ্টির শিকার চা শ্রমিকের ছেলে মেয়েদের মেধার মধ্যে রয়েছে রাত ও দিনের মত তফাৎ সুতরাং এখানে এদের ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে না। ইদানিং প্রাথমিক শাখাকে সরকারী বিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এখানেও আসল চা জনগোষ্ঠীর কোন রকম অংশীদারিত্ব নেই যা এ শতাব্দীতে ভাবতেও অবাগ লাগে। একই এলাকায় থেকে একই শিল্পে কর্মরত শ্রমিক এবং ম্যানেজমেন্টের মধ্যে কি পরিমাণ বিভাজন তা স্পষ্ট হয়ে উঠে। চা শ্রমিকরা উপনিবেশিক শাসন আমলে প্রচলিত দাস প্রথার এক নব্য সংস্করণ, এদেরকে অঘোষিত কৃতদাস করে নির্দিষ্ট সীমানায় শিকলহীনভাবে বন্দী করে রাখা হয়েছে। এই বন্দিত্বের বেড়া জাল থেকে এদেরকে কেউ কোন দিন বের করে আনতে পারবে না, যদি না এ শিকল তারা খোলতে পারে। শিক্ষাই একমাত্র উপায় যার মাধ্যমে তারা এ অবস্থার পরিবর্তন আনতে পারবে। চলবে...
×