ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পপি দেবী থাপা

এক অদম্য নারী

প্রকাশিত: ০৭:২৯, ২৩ মার্চ ২০১৮

এক অদম্য নারী

শাহানাজ বেগম। জীবন সংগ্রামে বিজয়ী এক নারী। সংসার জীবনের অস্তমিত সূর্যকে নতুন দিনের উদয়মান সূর্যের আলোর আভায় আবারও করেছেন আলোকিত। বাল্যবিয়ে আর অকাল মাতৃত্ব দাবিয়ে রাখতে পারেনি তার জীবনকে। দুঃখ আর ভাগ্যের দোহাই দিয়ে নিজেকে ঠেলে দেননি হেরে যাওয়ার দলে। পরাজয়কে মেনে নেননি কখনই। বরং নিজের অদম্য সাহস আর পরিশ্রম দ্বারা হার মানিয়েছেন দুর্ভাগ্যকে। হোঁচট খেয়েছেন, আবারও উঠে দাঁড়িয়েছেন। নিজেকে তুলে ধরেছেন কাজের মধ্য দিয়েই। বার বার ভেঙ্গেপড়া জীবনকে টেনে তুলেছেন দৃঢ় মনোবল আর টিকে থাকার ইচ্ছাশক্তি দিয়ে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, মানসিক যন্ত্রণা, আর সামাজিক গঞ্জনা রুদ্ধ করতে পারেনি তার জীবন চলার গতিকে। যশোর জেলার অভয়নগর থানার সিদ্দিপাশা গ্রামের শাহনাজ বেগম। পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি। সদর্পে ইট, বালু আর কংক্রিটে গড়ে চলেছেন অন্যের ঘর। পড়ালেখা যৎসামান্য । শিকার হয়েছেন বাল্যবিয়ের। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, কুসংস্কারের কারণেই বাবা-মায়ের সংসার ছেড়ে ১৪ বছর বয়সেই তাকে যেতে হয়েছে স্বামীর সংসারে। বিয়ে হয়েছিল খুলনা জেলার আড়ংঘাটার এক ক্ষেতি দিন মুজুর পরিবারে। আর দশ- পাঁচটা মেয়ের মতোই সুখী হওয়ার চিন্তা নিয়ে সংসার শুরু করেছিলেন তিনি। বিয়ের পর এক বছর যেতেই এক কন্যাসন্তানের জননী হন। চলতে থাকে সংসার। এরই মধ্যে স্বামীর সঙ্গে সাংসারিক বিষয়াদি নিয়ে বিরোধ শুরু হয়। গর্ভে আসে তার দ্বিতীয় সন্তান। স্বামীর অত্যাচার বাড়তে থাকে। দ্বিতীয় সন্তান গর্ভে থাকার সময়েই তার স্বামী অন্যত্র আবার বিয়ে করে। শাহানাজ ফিরে আসে তার বাবার বাড়ি। জোড়জবরদস্তি আর কাড়াকাড়ির, তর্ক-বিতর্কে নিজেকে জড়াতে চাননি তিনি। নিজের এবং সন্তানের ভরণপোষণের দাবির কথা একবার জানিয়েছিলেন কিন্তু কোন উত্তর ফিরে আসেনি। তিনি তার ধারও ধারেননি। নিজ স্বামীর প্রসঙ্গে তিনি বলেন- ‘যে আমারে ছাইরা অন্য জায়গায় বিয়ে বইছে, আমার সন্তানগুলোরও কোন খবর নেয়নি, আমি ক্যান তার কাছে যাবো? প্রয়োজনে খাইটে খাবো।’ জন্ম হয় শাহানাজের দ্বিতীয় কন্যা সন্তানের। বাবা-মা আর ভাইয়ের সংসারে নিজেদের বোঝা না বানিয়ে সন্তানদের নিয়ে আলাদা বসবাস শুরু করেন। রাজমিস্ত্রির সঙ্গে হেলপারের কাজ করা শুরু করেণ ছোট সন্তানের বয়স যখন ৬ মাস তখন থেকেই। এভাবে ধীরে ধীরে রাজমিস্ত্রির কাজ শেখার শুরু। এক সময় ইট, বালু আর সিমেন্টের মিশ্রনের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলেন নিজেকে। আয়ের মাধ্যম হিসেবে আঁকরে ধরেন এ পেশাকেই । প্রথম দিকে অনেকে অনেক কিছু বলেছে। কিন্তু কারও ধমক, চোখ রাঙানিকে পাত্তা দেয়ার সময় নেই তার। শুকিয়ে যাওয়া নোনা অশ্রুর শুষ্ক চোখে এখন শুধুই টিকে থাকার স্বপ্ন। তিনটি জীবনের সৎ উপায়ে বেঁচে থাকার লড়াই। নিজ এবং দুই সন্তানের মুখের খাবারের জোগান দিতে ভোর না হতেই তিনি বেড়িয়ে পড়েন তার জীবিকার উদ্দেশ্যে। তার কথায়, ‘কথা তো সবাই কোথি পারে, না খাইয়ে থাকলি কেউ তো আর খাতি দেবে নানে।’ সারা দিনের কর্মের পর ঘরে ফিরে আবার সাংসারিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। স্বামী অন্যত্র বিয়ে করার পর দুই সন্তান নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়া শাহানাজ তার বাবা-মায়ের মতোই আর একটি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। খুবই অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছিলেন বড় মেয়েটাকে। নিয়তির নির্মম পরিহাসে সে মেয়েটিও এখন তার সঙ্গেই থাকে। এ নিয়ে তার মনে কষ্ট আছে কিন্তু নেই কোন আক্ষেপ। বরং না পড়িয়ে মেয়েটাকে অল্প বয়সে বিয়ে দেয়ার জন্য রয়েছে আপসোস। তবে তার ইচ্ছা ছোট মেয়েটাকে পড়ালেখা শিখিয়ে বড় করে তুলবে। নিজের আয় থেকে জমানো অর্থেই জমি কিনে নিজেই বাড়ি বানিয়েছেন তিনি। এখন সে বাড়িতেই তার বাস।
×