ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোশারফ হোসাইন

বাল্যবিয়ে থামাতে পারেনি তার জীবন

প্রকাশিত: ০৭:২৯, ২৩ মার্চ ২০১৮

বাল্যবিয়ে থামাতে পারেনি তার জীবন

একজন শাপলা, ভাল নাম সাবিহা জামান। একাধারে শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মী, সাংবাদিক ও একজন মহিলা উদ্যোক্তা। এই নারীর আজকের এ অবস্থানে আসতে পাড়ি দিতে হয়েছে কঠিন জীবন সংগ্রামের পথ। জীবনের পেছনের দিনগুলো যেন এক একটা রূপকথার রাক্ষস বধের গল্প। সীমাহীন কষ্ট পায়ে মাড়িয়ে আজকের এ পথচলা। বলছি ২০১৭ সালে মহিলাবিষয়ক অধিদফতরের ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ’ শীর্ষক কার্যক্রমের আওতায় শেরপুর জেলায় শিক্ষা ও চাকরি ক্ষেত্রে জয়িতা নির্বাচিত হওয়া সাবিহা জামান শাপলার কথা। একান্ত আলাপচারিতায় তিনি জানিয়েছেন তার বাল্যবিয়ে হলেও কিভাবে সব বাধা কাটিয়ে হয়েছেন আজকের জয়িতা। জন্ম জেলার সদর উপজেলার চরমোচারিয়া ইউনিয়নের নলবাইদ গ্রামে নিম্ন মধ্যবিত্ত শিক্ষক পরিবারে। বাবা সুরুজ্জামান, মা মোমেনা খাতুন। চার ভাইবোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়। বাবা স্কুলশিক্ষক হওয়ার সুবাধে পড়াশোনার হাতেখড়ি বাবার স্কুলেই। কখনও বাবার সঙ্গে সাইকেলে চড়ে আবার কখনও বা তিন কিলোমিটার হেঁটে একই স্কুলে পড়ুয়া বড় বোনের সঙ্গে যাতায়াত করা সত্যিই কষ্টকর ব্যাপার ছিল। এ যেন জীবন সংগ্রামের প্রথম ধাপ। এভাবে পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে ওই ইউনিয়ন থেকে বৃত্তি লাভ করায় ও সাংস্কৃতিক প্রতিভার কথা বিবেচনা করে এবং অন্যান্য সন্তানদের সুন্দর আগামী গড়ে তুলার স্বপ্ন নিয়ে ছোট ছোট ৪ ভাইবোন নিয়ে শেরপুর শহরে ভাড়া বাসায় উঠেন স্বল্প আয়ের শিক্ষক বাবা। ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে স্কুলে ভর্তি করে পাশাপাশি নৃত্য শেখাতে ভর্তি করা হয় শিল্পকলা একাডেমিতে। নৃত্য শিক্ষক কমলকান্তি পালের দীক্ষায় চলে তার নৃত্যের প্রশিক্ষণ। এখানেও নৃত্য ভাল করায় হয়ে উঠেন পরিচিত মুখ। ডাক পড়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রতিযোগিতা করার কিন্তু ভাল কোন শাড়ি গহনা না থাকায় প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ধার করে চলতে থাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ। সাফল্যের পালকে যোগ হতে থাকে প্রথম-দ্বিতীয় হওয়ার পুরস্কার। এদিকে প্রতিবেশী সমালোচকদের নানা টিপ্পনিতে হঠাৎ করেই নৃত্য করা বন্ধ করে দেন ধর্মিক মা মোমেনা খাতুন। এ যেন স্বপ্ন ভঙ্গের আরেক ধাপ। কিছুদিন বন্ধ থাকার পরে কখনও মাকে বুঝিয়ে আবার কখনও বাবার অনুমতি নিয়ে মায়ের অজান্তে লুকিয়ে লুকিয়ে চলতে থাকে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ। ১৯৯৩ সাল, নাচ করার পাশাপাশি যখন দশম শ্রেণীর ছাত্রী, এসএসসি পরীক্ষার দুই মাস আগে, ঠিক তখন হঠাৎ করেই পারিবারিক সিদ্ধান্তে বিয়ে হয়ে যায় বিদেশ ফেরত এক যুবকের সঙ্গে অনেকটা জোর করেই। তখনকার সমাজে বাল্যবিয়ে রোধে আজকের মতো এত আওয়াজ ছিল না। একদিকে এসএসসি পরীক্ষার বাকি দুই মাস, অন্যদিকে শ্বশুরবাড়ি থেকে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে সংসার ধর্মে মন দেয়ার তাগাদা অন্যদিকে বিয়ের এক মাস পরই স্বামীর আবার বিদেশ চলে যাওয়া। সবকিছু মিলে যেন দিশেহারা করে দিয়েছিল আমাকে। সারা দিনই শুধু কান্না করতাম। কিন্তু আমার ফেরেশতাতুল্য শ্বশুর যিনি একজন ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধের অন্যতম সংগঠক আবুল কাশেম, উনার সরাসরি হস্তক্ষেপে আমি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি পেয়ে যাই, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ৭২৩ নম্বর পেয়ে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হই। স্বামী বিদেশ থাকায় কলেজে ভর্তি হওয়া যাবে না বলে কঠোর হুঁশিয়ারি শ্বশুরবাড়ি তথা শাশুড়ির। আবারও শ্বশুর মহাশয়ের সাহায্য প্রার্থনা, তার সুপারিশে বোরকা পড়ে শতভাগ পর্দা মেনে কলেজে যেতে হবে এমন শর্তে ভর্তি হলাম কলেজে। একদিকে সংসারের চাপ অন্যদিকে পড়াশোনা। মাঝে স্বামী বিদেশ থেকে দেশে এলে কিছুটা স্বস্তি মিললেও অনেকটা সংগ্রাম করেই ১৯৯৫ সালে ইন্টারমিডিয়েট ও ১৯৯৭ সালে বিএ সেকেন্ড ডিভিশনে পাস করলাম। এর মধ্যেই কোলজুড়ে এলো আমার বড় ছেলে। সন্তান, সংসার সব ঝামেলা মাথায় নিয়েও সিদ্ধান্ত নিলাম মাস্টার্স করার, যেই সিদ্ধান্ত সেই কাজ, ভর্তি হলাম আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহে। চলতে থাকল পড়াশোনা, সন্তান লালনপালন ও সংসার সামলানো। এবার গর্ভে এলো আমার ছোট ছেলে। ছোট ছেলেকে ৮ মাসের গর্ভে রেখেই ঝুঁকি নিয়ে শেরপুর থেকে ময়মনসিংহ যাতায়াত করে অংশগ্রহণ করি মাস্টার্স পরীক্ষায়। এবারও সফল হই, সেকেন্ড ডিভিশনে পাস করি মাস্টার্স পরীক্ষায়। বাবা শিক্ষক থাকায় ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখতাম বাবার মতো আদর্শ শিক্ষক হব। সেই চিন্তা থেকেই ২০০৩ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিএড প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। সেই সঙ্গে যুব উন্নয়ন থেকে গ্রহণ করি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ। টানাপোড়েন সংসারে স্বামীকে সহযোগিতা করার জন্য শহরের একটি কিন্ডার গার্টেন স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নেই। সেই সঙ্গে খ-কালীন বাংলাদেশ শিশু একাডেমির, শিশু কিশোর সংগঠন পাতাবাহারের নৃত্য প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। পাশাপাশি সিনিয়র সাংবাদিকদের সহযোগিতায় শুরু করি সাংবাদিকতা, অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আমি বর্তমানে দৈনিক আমাদের সময়ের শেরপুর জেলা প্রতিনিধি ও দুই মেয়াদের শেরপুর প্রেসক্লাবের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। সাংবাদিকতা, নৃত্য এবং সামাজিক কার্যক্রম আমার আত্মার ক্ষুধা তথা সামাজিক সুনাম বৃদ্ধি করলেও সংসারের অসচ্ছলতা থেকেই যায়। চিন্তা শুরু করি কিভাবে এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া যায়। হাত খরচ বাঁচিয়ে জমানো কিছু টাকা ও বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে ঢাকা থেকে গ্রহণ করি পার্লারের প্রশিক্ষণ। সেই প্রশিক্ষণ কাজে লাগাতে একটি লেডিস পার্লার প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নিলাম কিন্তু এবার বাধা হয়ে দাঁড়ালেন জন্মদাতা বাবাই। তার সহজ কথা মাস্টার্স শেষ একটি মেয়ের পার্লারের ব্যবসা করা যাবে না। সত্যি বললে পার্লার ব্যবসাকে তখন সমাজের মানুষগুলো ভাল চোখে দেখত না। বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধেই নিউমার্কেটে ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠা করলাম প্রিয়াঙ্গন হারবাল বিউটি পার্লার, শুরু হলো জীবন সংগ্রামের আরও একধাপ। শুরুর দিকে হাতেগোনা দুই-একটি পার্লার শেরপুরে থাকলেও আমি দেয়ার পর শেরপুরেই শুরু করি পার্লারের প্রশিক্ষণ। এখন সেই প্রশিক্ষণ নিয়ে শেরপুরে কমবেশি পার্লার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অর্ধশতাধিক। অন্যদিকে আমার নিজের প্রতিষ্ঠানেও কর্মরত আছে ৭-৮ জন বিউটিশিয়ান। পার্লার প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমার সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা ফিরতে শুরু করে। নিজে যেহেতু পার্লারে শুধু দেখভাল করি তাই হাতে প্রচুর সময় থাকায় এবং শিক্ষক বাবার সন্তান হওয়ায় শিক্ষকতা করার প্রবল ইচ্ছে থাকায় যোগদান করি এমপিওভুক্ত একটি ফাজিল মাদ্রাসায় মাধ্যমিক স্তরে সহকারী শিক্ষক হিসেবে সেখানেই কর্মরত আছি বলে জানান। সেই সঙ্গে শেরপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন, জেলার প্রথম অনলাইন সংবাদপত্র শেরপুর টাইমস ডটকমের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন শেরপুর জেলা শাখার মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা হিসেবে দায়িত্বপালন। মহিলা উদ্যোগতা হিসেবে শেরপুর চেম্বার অব কমার্সের সদস্যপদ গ্রহণসহ নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত আছেন। ব্যক্তিগত জীবনে এখন ব্যবসায়ী স্বামী সাইফুল ইসলাম ও দুই ছেলের মধ্যে বড় ছেলে সাকিব উল ইসলাম ঢাকার বিজিএমইএ এর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী, ছোট ছেলে সিফাত-উল-ইসলাম সদ্য জেএসসি পরীক্ষা শেষ করেছে তাদের নিয়ে সৃষ্টিকর্তার অসীম দোয়ায় খুব ভাল আছেন। স্বপ্ন দেখেন নিজের শ্রম, মেধা, কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে সমাজের অসহায় নারীদের উন্নয়নে কাজ করার। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের পথ ধরে এগিয়ে যেতে চাই সাবিহা জামান শাপলা। সহযোগিতা চাই সমাজের সর্বস্তরের গণমানুষের। তবে সাবিহা জামান শাপলার জীবনের সংগ্রাম থেকে আগামী প্রজন্মের অনুপ্রেরণা পাওয়া উচিত।
×