ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

শিমুল বনে...

প্রকাশিত: ০৭:৩০, ২৩ মার্চ ২০১৮

শিমুল বনে...

ঘুম থেকে উঠেই ঝটপট তৈরি হয়ে বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছি মাফুজের অপেক্ষায়। আগের দিন মাফুজের কথা ছিল সাতসকাল আমরা রওনা দিব নতুন ভ্রমণ গন্তব্যে, কিন্তু আমার সঙ্গীর দেখা নেই। তবে ভোরের মিষ্টি হাওয়া তে দাঁড়িয়ে থাকতে মন্দ লাগছে না। কিছুক্ষণ পর দেখা মিলল মাফুজের। চোখ কচলাতে কচলাতে আমার সামনে এসে উপস্থিত। আমরা তিন চাকার মানব গাড়িতে উঠে যাত্রা শুরু করলাম। বন্দরবাজার থেকে চৌহাট্টা অভিমুখে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। চৌহাট্টা এসে দেখি কোন গাড়ির দেখা নেই। আমাদের ভ্রমণ গন্তব্যে যেতে হলে প্রথমে কার অথবা বাসে করে পৌঁছাতে হবে সুনামগঞ্জে। অনেক পড়ে একটি গাড়ির দেখা পেলাম কিন্তু আমরা দুইজন ছাড়া কোন যাত্রী নেই। এদিকে দ্রুতগতিতে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলছে। এদিকে মাফুজ বলল আমরা এখানে অপেক্ষা করছি। সময় বাঁচানোর পথ ধরে আমরা চললাম কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ডের দিকে। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখি একটি বাস আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কালক্ষেপণ না করে উঠে পরলাম বাসে। ও বলাই হলো না আমাদের আজকের ভ্রমণ গন্তব্য তাহিরপুরের শিমুলবন। ফেসবুকের কল্যাণে খোঁজ পেয়েছি শিমুলবনের। আমার আবার নতুন কোন গন্তব্যের খোঁজ পেলে তা না দেখার আগ পর্যন্ত মনে শান্তি পাই না। আমাদের বাস চলছে ছুটে গন্তব্য পানে। আমি জানালা দিয়ে দৃষ্টি সীমানায় যত টুকু দেখা যায় প্রকৃতির খেলা তা দেখতে থাকলাম। পথে রাস্তার কাজ চলছিল তাই বেশকিছু সময় নষ্ট হলো আমাদের। সকাল সাড়ে এগারোটার দিকে আমরা এসে পৌঁছলাম সুনামগঞ্জ শহরে। নতুন ব্রিজের কাছে এসে দেখতে পেলাম মোটরসাইকেলের লাইন। বলে রাখা ভাল সুনামগঞ্জ শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাবার মাধ্যম হলো মোটরবাইক তবে হিউম্যান হলার করে যেতে পরবেন তাহিরপুরের শিমুলবনে। আমি মাফুজ আর নাম না জানা মোটরসাইকেল চালক রওনা দিলাম। গ্রামের ধূলিময় রাস্তা, দম বন্ধ হয়ে আসে। তবু চারপাশের সৌন্দর্য দেখে আমরা থ। আমাদের পাইলট মহোদয় দ্রুত গতিতে ছুটে চললেন । আর আমি মোটরসাইকেলে বসেই ছবি তোলার চেষ্টা করলাম। লাউরের গড় বিজিবি ক্যাম্পের কাছে আসতেই দূরে দেখা গেল লাল টকটকে শিমুলবন সঙ্গে অপরূপ জাদুকাটা। যেন আগুন লেগেছে সে বনে। তবে তখনও পথ বেশ দূরের। আমাদের পাড়ি দিতে হবে জাদুকাটা নদী। নদীতে পানি কম, যতদূর চোখ যায় ধুধু বালুচর। প্রখর রোদ। আমরা মোটরসাইকেল থেকে নেমে জাদুকাটা নদীর শীতল পরশ বুলিয়ে নিলাম। নদীর ওপাশেই সবুজ বারিক টিলা। তারপর কুয়াশায় মোড়ানো মেঘালয় পাহাড়। বর্ষার দিনে সবুজ পাহাড়ের বুক চিড়ে এই নীল নদীটি বয়ে যায়। জাদুময় জাদুকাটা নদী দেখতে পর্যটকরা তখন ভিড় করেন। তবে ফাল্গুন মাসে নদীর তলঘেঁষে প্রায় এক মাইল হেঁটে আমরা পৌঁছলাম শিমুলবনে। টকটকে লাল শিমুল ফুলে ছেয়ে গেছে, পুরো বাগান। এক ডাল থেকে অন্য ডালে খুনসুটিতে ব্যস্ত, পাখিরা। বাসন্তি হাওয়ায়; নতুন প্রাণের স্পন্দনে প্রকৃতি। ১৪ বছর আগে ২ হাজার ৪০০ শতক জমিতে এই শিমুল বাগান গড়ে তোলেন, জয়নাল আবেদীন। মাত্র ১২ বছর বয়সে জয়নাল আবেদীন তার পরিবারের সবার সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ভৈরব থেকে সুনামগঞ্জ জেলার বিচ্ছিন্ন জনপদ বাদাঘাট ইউনিয়নের সোহালা গ্রামে এসে বসবাস শুরু“করেন। কিশোর বয়স থেকেই তিনি ছিলেন উদ্যমী। সংগ্রামমুখর জীবনে অল্প বয়সেই ইতি টানেন পড়ালেখার। নানা পেশা বদলে একসময় জড়িয়ে পড়েন মৎস্য ব্যবসায়। নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইনল্যান্ড ফিশারিজের মাধ্যমে ইজারা নেন টাঙ্গুয়ার হাওর। আবার বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন। কিন্তু শুধু ব্যবসা বাণিজ্যে মন ভরল না তার, ইচ্ছা আরও কিছু করার। যা মানুষের কল্যাণে আসবে। গাছপালার প্রতি ছিল তার অপরিসীম মমতা। গাছ লাগাতেই তিনি বেশি পছন্দ করতেন। তার এই পছন্দের সঙ্গে একাত্ম হলো তাহিরপুরের সাধারণ মানুষের ভাবনা। হাওড়াঞ্চলের মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছিলেন কয়েকটি গুরুতর সমস্যায়। বর্ষা এলেই আমূল বদলে যায় এখানকার দৃশ্যপট। ঢেউয়ের তোড়ে প্রতিনিয়ত ভাঙতে থাকে পাড়। হাওড়ের আশপাশে যে ক’টি বাড়িঘর আছে সেগুলোও ঢেউয়ের তোড়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত। এমন গুরুতর সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? শেষ পর্যন্ত গ্রামের মানুষরাই ঠিক করে নিলেন তাদের করণীয়। শক্ত শিকড় বাকড়ের জলসহিষ্ণু গাছপালাই এর একমাত্র সমাধান। সংখ্যায় কম হলেও এমন দু’একটি প্রজাতি সেখানে আগে থেকেই ছিল। যার অন্যতম হিজল এবং করচ। গলা সমান পানিতেও এরা দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে। কিছু দিন পর স্থানীয়দের এই ভাবনার সঙ্গে যুক্ত হলো আরেকটি নতুন মাত্রা। এসব গাছের একাধিক উপযোগিতার মধ্যে তারা জ্বালানি সংগ্রহের গুরুত্বও উপলব্ধি করতে পারলেন। শুধু হিজল ও করচ লাগালেই একসঙ্গে অনেকগুলো সমস্যার সমাধান মিলবে। কিন্তু এই বিশাল কর্মযজ্ঞের শুরুটা কিভাবে, আর করবেই বা কে? স্থানীয় মানুষ যখন এসব নিয়ে ভাবছিলেন তখন অনেকটা পরিত্রাতা হিসেবেই আবির্ভূত হলেন বাদাঘাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন। তিনি ১৯৮৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত মোট ১৩ বছর টাঙ্গুয়ার হাওড় এলাকায় ৯০ হাজার করচ গাছ লাগিয়েছেন। পাশাপাশি হিজল গাছও লাগিয়েছিলেন বেশকিছু। চারাগুলো সংগ্রহ করেছিলেন স্থানীয়ভাবেই। শুধু গাছ লাগিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি। গাছের পুরো যতœ আত্তির দায়িত্বও নিজের কাঁধে নেন। শুকনো মৌসুমে নিজেই গাছে পানি দিতেন। একটানা ১৩ বছর তিনি সত্যিকার অর্থেই অসাধ্য সাধন করেছেন। টাঙ্গুয়ার হাওড় যেতে দু’পাশে চোখে রাখলে যে কারও মনে প্রশ্ন জাগবে, এমন বিচ্ছিন্ন জনপদে কোথা থেকে এলো এত গাছ? কিন্তু তিনি আজ নেই। পৃথিবীর মোহমায়া ছেড়ে অনেক আগেই চলে গেছেন জয়নাল আবেদীন। কিন্তু রয়ে গেছে তার অনন্য কীর্তি। সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ টাঙ্গুয়ার হাওড়জুড়ে তার সন্তানসম বৃক্ষগুলো এখন একদিকে যেমন প্রকৃতিপ্রেমীদের চোখের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে, অন্যদিকে বাড়িয়েছে হাওড়ের সৌন্দর্য। আবার হাওড়ের মাটি সুরক্ষায়ও রাখছে বিরাট ভূমিকা। বলছিলেন ওই এলাকার প্রবীণ শেখর দাস। আমি আর মাফুজ পুরো এলাকা ঘুরে বেড়ালাম পদব্রজে। অসাধারণ পরিবেশ। এ যেন কল্পনার রঙে সাজানো এক শিমুলের প্রান্তর। ওপারে ভারতের মেঘালয় পাহাড়, মাঝে যাদুকাটা নদী আর এপাড়ে শিমুল বন। সব মিলেমিশে গড়ে তুলেছে প্রকৃতির এক অনবদ্য কাব্য। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। শিমুলবন তার সৌন্দর্যের ডালি মেলে ধরে তখন। সোনালি আলোতে লাল টকটকে ফুল এক মোহনীয় আবেশ তৈরি করে। যেভাবে যাবেন : ঢাকা থেকে বাস চলে যান সুনামগঞ্জ। অথবা ট্রেনে যেতে চাইলে প্রথমে ট্রেনে করে সিলেট যেতে হবে সেখান থেকে বাস অথবা গাড়িভাড়া করে সুনামগঞ্জ শহরে। সুনামগঞ্জের নতুন ব্রিজের গোড়া থেকে বাইক অথবা লেগুনায় সরাসরি লাউড়ের গড় চলে যেতে পারবেন। বাইকে জনপ্রতি ভাড়া পড়বে ২০০ টাকা ও লেগুনায় ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা রিজার্ভ। চাইলে প্রাইভেট গাড়ি নিয়েও চলে যেতে পারেন লাউড়ের গড়। তারপর বালুচর দিয়ে হেঁটে চলে যান শিমুল। গাড়ির জন্যÑ গন্তব্য ০১৭৩৫০২৪২০৫, ০১৬১৭৬৭৪৩১০ ছবি : লেখক
×