ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সামনে বৈশাখী মেলা মোরগ তেজি করার প্রস্তুতি গ্রামে গ্রামে

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ২৪ মার্চ ২০১৮

সামনে বৈশাখী মেলা মোরগ তেজি করার প্রস্তুতি গ্রামে গ্রামে

সমুদ্র হক ॥ লড়াইয়ের জন্য মোরগকে তেজি করে তোলার প্রস্তুতি এখন চলছে গ্রামগুলোতে। লক্ষ্য-সমুখে বৈশাখের ময়দান। এবার বেশ আগেভাগেই বৈশাখ বরণের পালা শুরু হয়েছে। উৎসবের স্রোতধারা বইছে চারদিকে। বৈশাখী মেলা না হলে তো উৎসব জমবেই না। মেলার অন্যতম আকর্ষণ মোরগ লড়াই। এখনকার এই সময়টায় মেলার আয়োজকরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে তেজি মোরগ খুঁজছে। মোরগ দেখার পর তার সাইজ ও শারীরিক গঠন পরখ করা হয়। মোরগ কতটা তেজি তারও প্রাথমিক পরীক্ষা করা হয়। তারপর মেলায় অংশগ্রহণের জন্য আগাম বায়না করা হয়। মোরগের শক্তি সঞ্চয় ও নাদুস-নুদুস করে তোলার দায়িত্ব নেয় বায়নাকারীরা। কারণ দর্শক মজা না পেলে বৃথা যাবে সব আয়োজন। সবচেয়ে মজার বিষয় মেলায় লড়াই শুরু হলে দর্শকরা দুই মোরগের পক্ষ নিয়ে দুই ভাগ হয়ে যায়। প্রতিযোগিতায় করতালি এবং মুখে নানা ধরনের শব্দ করে উৎসাহ দেয়। কেউ আবার বাজি ধরে। যার মোরগ বিজয়ী হয় তার জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকে। কুক্কুড়ুক কুউউ ডাক দিয়ে প্রকৃতিতে প্রত্যুষের ঘোষণা দেয় মোরগ। গ্রামীণ জীবনে আজও মোরগের এই ডাকে ঘুম ভাঙ্গে। এই ডাক ভোরের নীরবতা ভেঙ্গে দেয়। মোরগ মুরগি নিয়ে পুরাণে কতই না কথা আছে। গ্রিক মাইথোলজিসহ অনেক মিথে মোরগকে দেবতার আসনে বসানো হয়েছে। লাল মোরগ অরুণ রাগ ও সাদা মোরগ উদিত সূর্যের প্রতীক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সূর্য দেবতা এ্যাপোলোর প্রিয় পাখি মোরগ। জাপানের ইসিতে (ওসাকা নগরীর কাছে) সূর্যদেবী এ্যামেতারেসুর মন্দিরের বেদিতে মোরগ রাখা হয়েছে। ভারতের অসমের একটি উপজাতির বিশ্বাস মোরগ বুবু করে ডাকলে সূর্য ওঠে নক্ নক্ করে ডাকলে সূর্য অস্ত যায়। পুরাণে মোরগকূলকে নিয়ে যাই বলা থাক এই মোরগ বাঙালীর শেকড়ের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ করতেও অবদান রাখছে। বাঙালীর ঐতিহ্যের সংস্কৃতির ঋতু বৈচিত্র্যের অনুসঙ্গে সুস্থ বিনোদনের অধ্যায় হয়ে আছে সেই আদিকালে। খিলাড়ীরা গ্রাম থেকে নগরীর কোন মেলায় মোরগ নিয়ে যায়। অনেক গৃহস্থ ও কৃষক প্রতিযোগিতার জন্য মোরগকে পোষ মানিয়ে প্রশিক্ষণ দেয়। যমুনা তীরের বাসেত আলী বললেন, উন্নত জাতের এই মোরগ ঘরে পালন করা হয়। এরপর মোরগকে প্রশিক্ষণ দিয়ে লড়াকু বানানো হয়। নির্দিষ্ট সময়ে এদের খাওয়ানো হয়। আহারেও বাছ বিচার আছে। সবই খেতে দিলে মোরগ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে। শরীর ভারি হলে লড়াইয়ে টিকতে পারবে না। লড়াকু মোরগকেও সময় মেনে গোসল করানো হয়। চিকিৎসাও দিতে হয়। অনেকে মনে করে মোরগ মুরগির বুদ্ধি নেই। এদের বুদ্ধি অনেক পাখির চেয়েও বেশি। রূপ লাবণ্য আছে। মোরগ গলা পেখম ঠোঁট ও পা লড়াইয়ে এক সঙ্গে ব্যবহার করে। চিত্ত বিনোদনের এই খেলায় উভয় পক্ষের লড়াকু মোরগ প্রথমেই ঝুঁটি ফুলিয়ে প্রস্তুত হয়। এরপর উড়িয়ে আক্রমণ করার দৃশ্য হৃদয় ভরে দেয়। শিশু কিশোরদের একটি খেলার নাম ইংরেজীতে ‘কক ফাইট’-যার অর্থ মোরগ লড়াই। ১০/১২ জন ছেলে বৃত্তকায় দাঁড়িয়ে বাম হাতে পা গুটিয়ে গোড়ালি ধরে রাখে। অথবা দুই হাত পরস্পরে বুকে গুটিয়ে নিয়ে এক পা ভাঁজ করে আরেক পায়ে প্রতিপক্ষের দিকে এগিয়ে যায়। তারপর সুযোগ বুঝে ডানা দিয়ে আঘাত করে। নির্দিষ্ট বেষ্টনীর মধ্যে উভয় পক্ষের আক্রমণে বিপর্যস্ত হওয়ার পর যার ভঙ্গি অটুট থাকে সেই হয় বিজয়ী। মোরগের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেশি। আর যে মোরগটি লড়তে পারে তার কদর তো আলাদা। লড়াকু মোরগ দেখলেই লোকজন বাহবা দেয়। এবারের বৈশাখী আয়োজনে মাঠপর্যায়ে অন্যতম আকর্ষণ হতে চলেছে মোরগ লড়াই। বগুড়া থিয়েটার প্রতিবছর নগরীর এ্যাডওয়ার্ড পার্কের একাংশে বৈশাখী মেলার আয়োজন করে। সেখানে বাঙালীর শেকড়ের সংস্কৃতির সব অনুসঙ্গ থাকে। যার মধ্যে মোরগ লড়াই অন্যতম। বগুড়া সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ও বগুড়া থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক তৌফিক হাসান ময়না জানালেন, এবারও লড়াইয়ের মোরগ খুঁজে প্রস্তুত রাখা হচ্ছে। প্রশিক্ষিত মোরগকেও যত্ন করে খাঁচায় ভরে আনা হয়। মোরগ লড়াই বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, গ্রীস, তুরস্ক, হল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, চীন, রাশিয়াতেও জনপ্রিয়। এই লড়াইকে ঘিরে অনেক জায়গায় বাজিকরও আছে। একটা সময় দেশের হাওড় বাঁওড় বিল অঞ্চলে মোরগ লড়াইয়ের আয়োজন করা হতো। দুর্দান্ত এই লড়াইয়ে ভারত থেকে সৌখিন মোরগওয়ালারা রং বেরঙের লড়াকু মোরগ নিয়ে আসতেন। গেল শতকের ৯০’র দশকে ঢাকায় জাতীয় মোরগ লড়াই প্রতিযোগিতা হয়েছিল। তারপর মোরগ লড়াইয়ের আর কোন উদ্যোগ নেই। যুগে যুগে মোরগ মুরগিকে নিয়ে কত কিই না রচিত হয়েছে।
×