ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শাহরিয়ার কবির

বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনে বাধা কোথায়

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ২৫ মার্চ ২০১৮

বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনে বাধা কোথায়

গত বছর জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতভাবে ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্তকে আমরা অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। এ বছর সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে ২৫ মার্চ গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবিতে রাত ৯টা ১ মিনিট নিপ্রদীপ ও নিরবতা পালন করা হবে। এই মর্মে গত ২৩ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটি ঘোষণাও দিয়েছেন। আমরা অবশ্যই শহীদদের স্মরণে এ কর্মসূচী পালন করব, তবে ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের সুযোগ বাংলাদেশ ২০১৫ সালেই হারিয়ে ফেলেছে। এখন আমাদের প্রয়োজন ’৭১-এর নয় মাসের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হলোকস্টের পর সবচেয়ে নৃশংস ও পরিকল্পিত গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১৯৭১ সালে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় সহযোগীরা ৩০ লাখ নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। সরকারী হিসাবে ২ লক্ষ, বেসরকারী হিসাবে ৫ লাখেরও অধিক নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন করা হয়েছে। সর্বস্বহারা ১ কোটি মানুষ ভিটেমাটি ত্যাগ করে প্রতিবেশী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। প্রায় ৩ কোটি মানুষকে দেশের অভ্যন্তরে বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য করা হয়েছিল। ’৭১-এর গণহত্যা ও নারী নির্যাতনসহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে পাকিস্তানের অখন্ডতা ও ইসলাম রক্ষার দোহাই দিয়ে। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানী সামরিক জান্তার প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে রাজধানী ঢাকা মহানগরে প্রায় ১ লাখ মেশিনগান, ট্যাঙ্ক, মর্টার ও রাইফেলের গুলিতে এবং দরিদ্র মানুষের আবাসস্থলে অগ্নিসংযোগ করে নারী, শিশু, বৃদ্ধ নির্বিশেষে প্রায় ১ লাখ, নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করেছে, যা ঘাতকরা পরে অস্বীকার করেছে। ১৯৭৫ সালে স্বাধীন বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর প্রধান সহযোগী, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান করেছেন, ’৭২-এর অনন্যসাধারণ সংবিধান রচনা করেছেন, তাঁদের নৃশংস হত্যাকান্ডের পর অধিকাংশ সময় বাংলাদেশে বৈধ বা অবৈধভাবে ক্ষমতায় ছিল পাকিস্তানপন্থী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা মুছে ফেলার পাশাপাশি তারা ’৭১-এর গণহত্যার ঘটনাও মুছে ফেলতে চেয়েছে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বিএনপিপ্রধান খালেদা জিয়া পর্যন্ত বলেছিলেন, ’৭১-এ ৩০ লাখ নিহতের সংখ্যা নাকি বিতর্কিত। তারা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের দেশপ্রেম নিয়েও কটাক্ষ করেছিলেন। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উদ্যোগে আমরা ১৯৯৩ সাল থেকে প্রতি বছর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ২৫ মার্চ গণহত্যার কালরাত্রিতে ৩০ লাখ শহীদদের স্মরণে সমাবেশ ও আলোর মিছিলের আয়োজন করছি এবং সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস ঘোষণার জন্য। ২০০৭ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ২৫ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ পালনের জন্য আমরা জাতিসংঘের ইউনেস্কো এবং গণহত্যার ভিকটিম বিভিন্ন দেশে চিঠি লিখেছি, আইন প্রণেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি, আমাদের প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছি। ২০১৫ সালের মার্চে আমাদের আর্মেনীয় বন্ধুরা জাতিসংঘে প্রদত্ত আমাদের আবেদন সম্পর্কে জানতে চেয়ে প্রশ্ন করেছিলেনÑ বাংলাদেশে ২৫ মার্চ সরকারীভাবে গণহত্যা দিবস ঘোষণা করা হয়েছে কিনা। আমাদের উত্তর ছিল নেতিবাচক। তাঁরা বলেছেন যে দিবস বাংলাদেশ জাতীয়ভাবে পালন করে না সেটি জাতিসংঘ কেন আন্তর্জাতিকভাবে পালনের কথা বলবে? ২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৯তম অধিবেশনে আর্মেনিয়ার প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ (International Day of Commemoration and Dignity of the Victims of Crime of Genocide and of the Prevention of this Crime) ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশসহ ১৯৩টি সদস্য দেশের উপস্থিতিতে জাতিসংঘের এ ঘোষণা সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে। এ কারণে ২৫ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ ঘোষণার কোন সুযোগ নেই। আমাদের ২৪ বছরের দাবির প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ১১ মার্চ বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ২৫ মার্চ ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। যে কারণে আমরা বিষয়টি গত বছর ১৫ ফেব্রুয়ারির (২০১৭) জাতীয় সংসদে প্রথম উত্থাপনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ, ১১ মার্চ প্রস্তাব উত্থাপনকারী জাসদের সাংসদ শিরীন আখতার এবং সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাসহ সকল সংসদ সদস্যকে উষ্ণ অভিবাদন জানিয়েছিলাম। ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের সরকারী সিদ্ধান্তে শেষ অংশ কিছুটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে- যেখানে বলা হয়েছে ‘এ দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির উদ্যোগ নেয়া হবে।’ এ বিভ্রান্তি লক্ষ করে আমরা গত বছর ১৪ মার্চ (২০১৭) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিব ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি এবং লিখিত প্রস্তাবেও বলেছি- ২০১৫ সালের আগে সরকার উদ্যোগ নিলে ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণার সম্ভাবনা ছিল, যা ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের পর সম্পূর্ণ তিরোহিত হয়ে গিয়েছে। এখন আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশের নয় মাসের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তখন জানিয়েছিলাম এ স্বীকৃতি অর্জনের পদ্ধতি ও কৌশল কী হবে। আমাদের ৩টি প্রস্তাব ছিল- ১. বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এবং অন্যান্য গবেষকরা যা লিখেছেন সেগুলোসহ এতদ্সংক্রান্ত আলোকচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র বাংলাদেশের সকল কূটনৈতিক মিশন, বিদেশে আমাদের সকল দূতাবাস, বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ সম্পর্কে আগ্রহী আইনপ্রণেতা, গবেষক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মানবাধিকার সংগঠন এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন দফতরে পাঠানো প্রয়োজন। ২. বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য বিভিন্ন দেশের সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানাতে হবে, যাতে তারা তাদের পার্লামেন্টে এই মর্মে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। ভারত, নেপাল, ভুটান, রাশিয়া এবং পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোসহ যেসব দেশ ’৭১-এ বাংলাদেশের গণহত্যার প্রতিবাদ ও নিন্দা করেছিল তাদের অনুরোধ করা হলেই এ বিষয়ে তারা পার্লামেন্টে প্রস্তাব গ্রহণে সম্মত হবে বলে আমারা বিশ্বাস করি। এ ছাড়া ইউরোপ, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশে বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রবাসী বাঙালী এবং নির্মূল কমিটির মতো সংগঠনসমূহের সহযোগিতা চাইতে পারে। ৩. আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের বিস্মৃতপ্রায় গণহত্যা সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে আগ্রহী করার জন্য দেশে ও বিদেশে গণহত্যা বিশেষজ্ঞ, আইনপ্রণেতা, বুদ্ধিজীবী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে নিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্মেলন নিয়মিতভাবে আয়োজন করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে নির্মূল কমিটি উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে পারে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এ পর্যন্ত কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। গত বছর ৯ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ পালন উপলক্ষে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সুইজারল্যান্ড শাখা জেনেভায় এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করেছিল যেখানে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের গণহত্যা বিশেষজ্ঞ এবং মানবাধিকার আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ যোগ দিয়েছিলেন। এর পরপরই আমরা সুইডিশ পার্লামেন্টের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপ-কমিটির সদস্যদের সঙ্গে এ বিষয়ে মতবিনিময় করেছি। সুইডিশ আইনপ্রণেতারা আমাদের আহ্বানের সঙ্গে সহমত পোষণ করে জানতে চেয়েছেন- এ বিষয়ে বাংলাদেশে সরকার কি সুইডিশ সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও অনুরোধ করেছে? আমরা এর উত্তর দিতে পারিনি। গত বছর ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যার কালরাত্রি পালন ছাড়াও দিনে আমরা বঙ্গভবনে মহামান্য রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতে ৩০ লক্ষ শহীদের স্মরণে ২৫টি বৃক্ষরোপণ করেছিলাম। এই অনুষ্ঠানে আমরা বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির আহ্বান জানালে উপস্থিত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বলেছিলেন, বাংলাদেশ যেদিন চাইবে সেদিনই এই স্বীকৃতি দেয়া হবে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, সুইডেনের মতো দেশ দূরে থাক, মুক্তিযুদ্ধের পরীক্ষিত বন্ধু ভারতকেও গত এক বছরে ’৭১-এর বাঙালী গণহত্যার স্বীকৃতির জন্য সরকারীভাবে কোন অনুরোধ জানানো হয়নি। আর্মেনিয়া, রুয়ান্ডা, সিয়েরালিওনের মতো ছোট ছোট দেশ যদি তাদের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করতে পারে, আমাদের সরকার আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে নয় মাসের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অবশ্যই পাওয়া যাবে। তবে এর জন্য কূটনৈতিকভাবে অত্যন্ত কৌশলী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কারণ এ স্বীকৃতি অর্জন ২১ ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের মতো অত সহজ হবে না। প্রতিপক্ষ শুধু পাকিস্তান নয়, আমেরিকা ও চীনের মতো দেশকেও আমাদের কূটনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে। গত বছর আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলেছি এ স্বীকৃতি অর্জনের জন্য পাকিস্তানে আমাদের যেমন জনমত সংগঠিত করতে হবে, বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল প্রবাসী ভারতীয় ও পাকিস্তানীদের সহযোগিতাও আমাদের প্রয়োজন হবে। এ কাজে নির্মূল কমিটি সরকারকে সহযোগিতা করতে চাইলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমাদের প্রস্তাবের প্রতি এ পর্যন্ত কর্ণপাত করেনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় না চাইলে কস্মিনকালেও বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন সম্ভব হবে না। ২৪ মার্চ ২০১৮
×