ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ মোহ ভ্রান্তি আঁধার পেরুবো কবে?

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ২৫ মার্চ ২০১৮

সিডনির মেলব্যাগ ॥ মোহ ভ্রান্তি আঁধার পেরুবো কবে?

ক্রিকেটে আমাদের পরাজয় যেমন কাঁদিয়েছে তেমনি জয়ও সারাদেশ ও দেশের বাইরের বাংলাদেশীদের নতুন করে উজ্জীবিত করে গেছে। লংকা পিষে ঝাল খাবার আনন্দে মাতোয়ারা আমাদের জাতিকে একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- জয় কোন আকস্মিক বিষয় না। ধারাবাহিক বিজয় এখন আমাদের কাম্য। অনেককাল ধরে খেলার পর পরাজয় যেমন অপ্রত্যাশিত না তেমনি জয়ও হোক প্রত্যাশিত। কথাটা বললাম এই কারণে আমরা কোনকিছুই ধারাবাহিকভাবে লালন করতে পারছি না। হুট-হাট করে একটা দুটো স্যালো ঘটনার পর পর নেমে আসে আঁধার। সে আঁধার এত জটিল আর এত মারাত্মক তখন আমাদের অস্তিত্ব ও টাল খেয়ে যায়। কেন এমন হয়? বা এটাই আমাদের নিয়তি কি না সেটা এখন ভেবে দেখার পাশাপাশি এ বিষয়ে যতœবান হবারও দরকার পড়েছে। ক’দিন পর আমরা মহাউৎসাহে স্বাধীনতা দিবস পালন করব। করার কারণ আছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার এ দিবসটিও অবির্কিত রাখিনি আমরা। একদল বলেন স্বাধীনতা দিবস আরেক দলের কাছে স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। নামে কিছু আসে যায় না বটে তবে পেছনে অসৎ বা অনৈতিক উদ্দেশ্য থাকলে তখন আসবে যাবে বৈকি। সম্ভবত দুনিয়ার একমাত্র দেশ আমরা যাদের জীবন ও ইতিহাসে অবিকৃত বলে কিছু নেই। পতাকা মাটি আর সঙ্গীতটা আপাতত বাদ রাখলেও নিরাপদ না। নিরাপদ যে না তার বড় প্রমাণ জাফর ইকবালের ওপর নির্লজ্জ আক্রমণ। আমি যেটা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলাম ভদ্রলোক তাঁর নামের সঙ্গে মুহাম্মদ শব্দটি যতেœর সঙ্গে ধরে আছেন। লালন করেন। সেই তাঁকে ধর্মহীনতার নামে কুপিয়ে দিল নিজের নামে তেমন কিছু ধারণ না করা এক যুবক। ভাবতে হবে কেন? এই যুবক জীবনে তাঁর কোন লেখা পড়েছেন বলে মনে হয় না। এ নিয়ে এত কথা এত লেখা তাই কিছু বলতে চাই না। শুধু মনে করিয়ে দিতে চাই দেশে বা দেশের বাইরে স্বাধীনতা যখন প্রাপ্তবয়স্ক বা আরও পরিণত হতে চলেছে এমন যুবসমাজ বিরাজ করছে আমাদের ভেতরে। এই যুবকটি কি বিকৃত না আসলে উদ্দেশ্য প্রণোদিত এর উত্তরও পাব না আমরা। এই যে রাখ রাখ ঢাক ঢাক এখানেই আমাদের সর্বনাশ। আমরা এখন এমন এক রাজনীতিতে বসবাস করি বা বাইরে থেকে দেখি যার ভেতর উন্নয়ন ও সামনে যাওয়া থাকলেও জবাবদিহিতা নেই। না থাকার কারণে কে দুশমন কে মিত্র সেটা বোঝাও মুশকিল। স্বাধীনতার দোহাই দেয়া রাজনীতিতে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ মানুষগুলো ভয়ঙ্কর। তাদের বিশ্বাস নেই। তারা আজকে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে মুখে ফেনা তুললেও বিপদের সময় তাদের পাওয়া যাবে না। এটা যে মুখের কথা না সেটা প্রমাণেরও দরকার পড়ে না। বলছিলেম এমন একটা সমাজে বসবাস করছি আমরা যেখানে সততা একটা বিরল উদাহরণ। পাশের দেশ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের সহজ জীবন ও টাকা পয়সার প্রতি ঝোঁকহীনতা নিয়ে কী উচ্ছ্বাস আর আবেগ। অথচ কে না জানে পশ্চিমবঙ্গের বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব বসুর অবস্থাও তাই। তাদের নেতা জ্যোতি বসুও বড়লোক ছিলেন না। তার মানে এই না যে, ভারতে বড়লোক বা ধনী নেতা নেই। একটু দূরের বিহারের লালু যাদব এখন কারাগারে। সাউথে নর্থে একেক নেতাদের আলিশান বাড়িঘর বা ব্যবসাবাণিজ্য দেখলে টাসকি খায় বিদেশীরা। দুর্নীতিতে ভারত কম কিছু না। কিন্তু মানিক সরকার বা তেমন কেউ পয়দা হয় দলীয় আদর্শে। বিশ্বাসের পায়ে ভর দিয়ে। সে আদর্শ আছে আমাদের? এরশাদ আমলে ত্রিপুরার আরেক নেতা নৃপেন বাবু এসেছিলেন বাংলাদেশে। রাষ্ট্রীয় অতিথিশালায় এসে তো হতবাক। এত শান-শওকত এত জৌলুস? সবচেয়ে মজার ছিল রাতে যখন তাঁর ঘরের সামনে দু’জন মানুষ হাতে কলম আর কাগজ নিয়ে দাঁড়িয়ে তিনি জাতে চাইলেন এরা কারা? কি চায়? জানানো হলো এরা অতিথিদের খাবারের অর্ডার নেয়। তিনি কি খাবেন জানার জন্য খাতা কলম নিয়ে এসেছে। বিস্মিত করে দিয়ে বলেছিলেন কি আবার? তিন চারটে রুটি ডাল সবজি আর একটু ফল। খুব মনখারাপ করে বিস্মিত নয়নে বিদায় নিয়েছিল অর্ডার গ্রহণকারীরা। আমাদের জাতীয় স্বভাব হচ্ছে, পারি আর না পারি অর্ডারেই বুঝিয়ে দেব আমরা কেউ একজন। যে যা তা খায় না। যার খাবারের মেন্যুও বিচিত্র আর ভারি। অথচ এমন ছিলাম না আমরা। স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর ভিডিও দেখুন। ছোট সাধারণ এক টেবিলে বাড়ির সবাইকে নিয়ে ব্রেকফাস্টে পাউরুটি চিবাচ্ছেন। তাজউদ্দীন থেকে মওলানা ভাসানী কিংবা মনি সিংহ থেকে হাজী দানেশ সে এক ছবি। আর আজ? আমরা ধরে নিয়েছি স্বাধীনতা মানে ইচ্ছেমতো ভোগ। এই ভোগের কবলে পড়ে দেশের এমন হাল কেউ স্বর্গের লোভে কেউ বাস্তবতার চাপে কেউ এমনি এমনি মারছে মরছে আর খাচ্ছে। খেতে খেতে এমন এক জায়গায় পৌঁছে গেছি আমরা ঘুষ বা তেমন কুখাদ্যও এখন খাবার তালিকায় জায়েজ হয়ে গেছে। বলছিলাম একটা জাতীয় ঐক্য বা বিশ্বাস না থাকলে কোন জাতি কি আসলে সামনে যেতে পারে? এক ভয়াবহ বাস্তবতায় উন্নয়ন অবিশ্বাস্য হলেও কিন্তু তরতর করে এগুচ্ছে দেশ। এই অগ্রযাত্রা চলমান রাখতে কিংবা তাকে আরও এগিয়ে নিতে এখন যেটা দরকার তার নাম সহিষ্ণুতা। ধৈর্য। সেটা নেই। নেই বলেই আমরা ক্রিকেটে একবার এমন জয় আনি যা অকল্পনীয় আশা জাগানো সেই বিজয় পরের বার ডুবে যায় চরম অপমানে। হঠাৎ এমন এমন সব কান্ড ঘটে দুনিয়াসহ চমকে যায়। তারপর আবার দেই তিমির রাত্রি। বিশ্বাসের ভিত্তি রাজনীতি এমনভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে দলের লোকেরা একে অপরকে বিশ্বাস করে না। হিন্দু বৌদ্ধকে বিশ্বাস করেন। খ্রীস্টানরা মুসলমানকে অবিশ্বাস করে। এমন কি জেলা ভেদেও কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। এই অনৈক্য আর বিভেদের ভেতর দিয়ে কতটা যেতে পারব আমরা? আজ মানে ১২/৩ বিবিসি বলছে মিয়ানমার রাখাইনে সামরিকায়নের শেষ ধাপে। মানে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়াটা আইওয়াশ। চোখ ধুয়ে চোখ কচলিয়ে দেখা যাবে আসলে তাদের বেশিরভাগই থেকে গেছে। এখন ইস্যুটা এমন কেউ আর মাথাও ঘামায় না। বরং সবাই বলছে এর পেছনে নাকি চীন ভারতসহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বা ঘাঁটির ব্যাপারও আছে। যত দিন যাচ্ছে তত তো সেটাই মনে হচ্ছে সত্যি। আমাদের উন্নয়নের গুড় পিঁপড়ে খাবার আগেই সাবধান হতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত যে জাতীয় ঐক্য আর দেশপ্রেম সেটা ফিরিয়ে আনা। কাজটা সহজ না। শেখ হাসিনা একা দুর্গ সামলাচ্ছেন। অন্যদিকে বিএনপির হাল খারাপ। বাকিরা মাঠে থাকা না থাকা সমান। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশের প্রাণ ভোমরা যে সংস্কৃতি ও সৃজন তার ভূমিকাও নমনীয় বলেই ঘরে বাইরে উগ্র আর জঙ্গী নামের দানবের বিচরণ। সংস্কৃতি মানে যে দু একটা পদক পুরস্কার বা বই না এটা বুঝতে হবে। মানতে হবে বহুকাল আমরা দিকনির্দেশনামূলক কিছু পাচ্ছি না। সাধারণের পাশাপাশি অসাধারণরাও পড়াশোনা বাদ দিয়ে দিয়েছেন আজকাল। অথচ এক মায়াময় সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। বেশিদূর না কলকাতা গেলেই আপনার ফিরে আসার জন্য মন আকুল হয়ে উঠবে। আমরা যারা হাজার হাজার মাইল দূরে থাকি আমাদেরও বাঁচিয়ে রাখে এই দেশ। স্বাধীনতার এত বছর পর যখন তারে পালে হাওয়া মুখে রূপশ্রী- আসুন সবাই মিলে এই দেশ এ দেশের মানুষকে প্রাধান্য দেই। রাজনীতি দিতে না চাইলে তাকেও বাধ্য করি। তবেই না আমি তোমায় ভালোবাসি বলাটা সার্থক হবে। [email protected]
×