ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভয়াল স্মৃতিবহ কালরাত ॥ আজ ২৫ মার্চ

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ২৫ মার্চ ২০১৮

ভয়াল স্মৃতিবহ কালরাত ॥ আজ ২৫ মার্চ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ‘অবিনাশী আগুনে পোড়ে হায়রে শোকার্ত স্বদেশ/ দুখিনী মায়ের অশ্রু জমা হয় নিভৃত পাঁজরে/ যে যাবে যুদ্ধে এখনি সে উঠুক উঠুক ঝলসে/ যে যাবে যুদ্ধে সবকিছু ভাঙুক সে....।’ উত্তাল দিন শেষে নেমেছে সন্ধ্যা। গভীর হতে শুরু করেছে রাত। একাত্তর সালের ২৫ মার্চ কৃষ্ণপক্ষের রাত। তখনও কেউ জানে না কী ভয়ঙ্কর, নৃশংস ও বিভীষিকাময় রাত আসছে বাঙালী জাতির জীবনে। ব্যস্ত শহর ঢাকা প্রস্তুতি নিচ্ছে ঘুমের। ঘরে ঘরে অনেকে ঘুমিয়েও পড়েছে। হঠাৎই যেন খুলে গেল নরকের সবক’টি দরজা। রাত সাড়ে এগারোটায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হলো হনন-উদ্যত নরঘাতক কাপুরুষ পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ছড়িয়ে পড়ল শহরময়। ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ এ নামে মৃত্যুক্ষুধা নিয়ে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক নেমে এলো ঢাকার রাস্তায়। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে গর্জে উঠল অত্যাধুনিক রাইফেল, মেশিনগান ও মর্টার। নিরীহ মানুষের আর্তনাদে ভারি হলো রাতের বাতাস। মানব ইতিহাসের পাতায় রচিত হলো কালিমালিপ্ত আরেকটি অধ্যায়। নিরস্ত্র, ঘুমন্ত মানুষকে এমন বর্বরোচিত হত্যার ঘটনায় স্তম্ভিত হলো বিশ্ববিবেক। আজ সেই ভয়াল ও বীভৎস কালরাত্রির স্মৃতিবাহী ২৫ মার্চ। মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত হত্যাযজ্ঞের দিন। বাঙালী জাতির ইতিহাসে এক নৃশংস, ভয়ঙ্কর ও বিভীষিকাময় কালরাত্রি। তবে এবার জাতির সামনে এই ভয়াল দিনটি এসেছে একটু ভিন্ন মাত্রা নিয়ে। দীর্ঘদিন পরে হলেও স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এবং একুশে ফেব্রুয়ারির মতোই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ঘটানো গণহত্যাকা-ের দিনটি জাতীয়ভাবে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। স্বাধীনতার প্রায় ৪৬ বছর পর গত বছরের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে এ প্রস্তাব পাস হয়। মাত্র এক রাতে এমন নির্বিচারে গণহত্যার ঘটনা বিশ্বে নজিরবিহীন। তাই ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ে সরকার থেকে জাতিসংঘে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সমর্থন আদায়ে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। ৯ ডিসেম্বরের পরিবর্তে ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিকভাবে কেন গণহত্যা দিবস পালন করা উচিত, এর পেছনে সমস্ত তথ্য উপাত্ত, যুক্তি উপস্থাপনে ডকুমেন্টস তৈরি করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন দূতাবাসের মাধ্যমে এসব তথ্য-উপাত্ত বিভিন্ন দেশ বা সংশ্লিষ্টদের কাছে পৌঁছানো হচ্ছে। আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস ঘোষণার দাবিতে আজ রবিবার এক মিনিট নীরবতা পালনের কর্মসূচী নিয়েছে সরকার। রাত নয়টা থেকে নয়টা ৯টা ১ মিনিট পর্যন্ত দাঁড়িয়ে সব আলো নিভিয়ে (ব্লাক আউট) সারা দেশের মানুষ একসঙ্গে নীরবতা পালন করবে। সারা বিশ্বে ৯ আগস্ট গণহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হলেও সেটি পাল্টে ২৫ মার্চ করতে চায় বাংলাদেশ। জাতিসংঘসহ সারাবিশ্বের সামনে পাকিস্তানের নৃশংস সেই গণহত্যার সমস্ত তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে স্বীকৃতি আদায়ে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। ২৫ মার্চ সেই রক্তাক্ত রাতের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো আগুনের শিখা আকাশকে বিদ্ধ করেছিল। এক সময় অগ্নিবর্ণের শোকার্ত ধূম্রকু-লী ছড়িয়ে পড়ল, কিন্তু পরমুহূর্তেই সেটাকে ছাপিয়ে উঠল আগুনের লকলকে লেলিহান। উত্তাল দিন শেষে নেমেছে সন্ধ্যা। গভীর হতে শুরু করেছে রাত। তখনও কেউ জানে না কী ভয়ঙ্কর, নৃশংস ও বিভীষিকাময় রাত আসছে বাঙালীর জীবনে। রাত সাড়ে এগারোটায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হলো হনন-উদ্যত নরঘাতক কাপুরুষ পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ছড়িয়ে পড়ল শহরময়। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে গর্জে উঠল অত্যাধুনিক রাইফেল, মেশিন গান ও মর্টার। হতচকিত বাঙালী কিছু বুঝে উঠার আগেই ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বাংলাদেশের ভূখন্ডে হিটলারের গেস্টাপো বাহিনীর কায়দায় রাতের অন্ধকারে পাক জল্লাদ বাহিনী এক দানবীয় নিষ্ঠুরতায় ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত বাঙালীর ওপর। চলল বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ আর ধ্বংসের উন্মত্ত তান্ডব। শহরের রাজপথ, অলিগলি, ফুটপাত, খেলার মাঠ, ক্যাম্পাস সর্বত্রই মৃত্যু তার রেখে গেছে করাল স্বাক্ষর। মানুষের কান্না ভারি হয়ে এলো শহরের আকাশ। সে কান্না ছাপিয়ে তখন আকাশে কেবলই মুহুর্মুহু আগুনের লেলিহান। মধ্যরাতে ঢাকা হয়ে উঠল লাশের শহর। একাত্তরের অগ্নিঝরা এদিনে বাঙালী জাতি তথা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছিল ইতিহাসের বিভীষিকাময় ভয়াল ও নৃশংসতম বর্বরতা। একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে গণহত্যার নীলনক্সা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পাকিস্তানী দানবরা মেতে উঠেছিল নির্বিচারে স্বাধীনতাকামী বাঙালী নিধনযজ্ঞে। ঢাকাসহ দেশের অনেকস্থানেই মাত্র এক রাতেই হানাদাররা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল প্রায় লক্ষাধিক ঘুমন্ত বাঙালীকে। অস্ট্রেলিয়ার ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ পত্রিকার ভাষ্যমতে শুধু ২৫ মার্চ রাতেই বাংলাদেশের প্রায় এক লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, যা গণহত্যার ইতিহাসে এক জঘন্যতম ভয়াবহ ঘটনা। পাইকারি এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তানি সরকার মুক্তিযুদ্ধকালে প্রকাশ করেছিল তাতে বলা হয়, ‘১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষষের জীবননাশ হয়েছিল।’ বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে নিষ্ঠুর, নির্মম ও বর্বরোচিত গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা। একাত্তরের এ দিনে চির আকাক্সিক্ষত ও প্রিয় স্বাধীনতার জন্য উন্মাতাল লাখো বাঙালীর রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল বাংলার সোঁদা মাটি। ঘুমন্ত শিশু, বধু, বৃদ্ধার রক্তে কলঙ্কিত হয়েছিল মানব ইতিহাস। সেই নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতা চেঙ্গিস খান- হালাকু খানদের নৃশংস নির্মমতাকেও হার মানায়। এই রাত একদিকে যেমন বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম মুহূর্তটি প্রত্যক্ষ করেছিল, তেমনি অন্যদিকে এ রাতেই সূচিত হয়েছিল জঘন্যতম গণহত্যার, যা ন’মাসে স্বাধীনতার জন্য মূল্য দিতে হয়েছিল ৩০ লাখ মানুষকে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল তাদের এদেশীয় দোসর ঘাতক দালাল রাজাকার-আলবদর-আল শামস বাহিনীর সদস্যরা। স্বাধীনতার জন্য সম্ভ্রম হারাতে হয়েছিল অসংখ্য মান-বোনকে। মাত্র ন’মাসে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ হত্যা ও নারী নিগ্রহের নজির বিশ্ব ইতিহাসে আর নেই। স্তম্ভিত বিশ্ব অবাক হয়ে দেখেছে বর্বর পাকসেনাদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ। শুধু নিষ্ঠুর ও বীভৎস্য হত্যাকা-ই নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকা গণমাধ্যমও সেদিন রেহাই পাননি জল্লাদ ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা থেকে। শহরময় হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে শক্তহাতে কলম ধরার কারণে প্রথমেই তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের (বর্তমান শেরাটন হোটেল) সামনে সাকুরার পেছনের গলিতে থাকা পিপলস ডেইলি ও গণবাংলা অফিসে হামলা চালিয়ে পেট্রোল ছিটিয়ে জ্বালিয়ে দেয় পাক হানাদাররা। এরপর একে একে দৈনিক সংবাদ, ইত্তেফাক, জাতীয় প্রেসক্লাবেও অগ্নিসংযোগ, মর্টার সেল ছুঁড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে পাক হানাদাররা। এ হামলায় জীবন দিতে হয় বেশ ক’জন গণমাধ্যম কর্মীকেও। জাতির জীবনে ভয়াল ২৫ মার্চ কালরাত এসেছে এক অন্যরকম আবহে। একাত্তরে এদেশীয় যেসব রাজাকার-আলবদর-আলশামস ওই রাতে গণহত্যা চালাতে পাকহানাদারদের সহযোগিতা করেছিল, মুক্তিযুদ্ধের ন’মাস নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ, মা-বোনের সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েছিল, লুটপাট-ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল- সেই নরঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বেশিরভাগ শিরোমনিকেই ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছে। কার্যকর হয়েছে মৃত্যুদন্ডের রায়। বেশ ক’জন যুদ্ধাপরাধী কারাগারের ফাঁসির কাষ্টে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। কী ঘটেছিল সর্বনাশা সেই ভয়াল রাতে ॥ সূর্য ডুবল। পাঁচটা বেজে চুয়াল্লিশ। ঠিক এক মিনিট পরেই ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে জেনারেল ইয়াহিয়া সোজা এয়ারপোর্ট চলে গেলেন। এর আগেই বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া সিরিজ বৈঠক ব্যর্থ হয়ে যায়। পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট বিমান করে করাচি পাড়ি দিলেন। শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ এড়িয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বাঙালী হত্যার নীলনক্সা বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়ে পালালেন। একাত্তর সালের ২৫ মার্চ কৃষ্ণপক্ষের রাত। সারাদিন ধরে রোদে পোড়া নগরী চৈত্রের বিখ্যাত হাওয়ায় জুড়িয়ে আসছিল। তারপর দু’ঘণ্টাও যায়নি। ক্যান্টনমেন্ট থেকে জিপ, ট্রাক বোঝাই দিয়ে সৈন্য ট্যাঙ্কসহ অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র নিয়ে সারা শহরে ছড়িয়ে পড়ছে। তারা ছক অনুযায়ী পজিশন নিচ্ছে। গোলান্দাজ, সাঁজোয়া, পদাতিক- তিন বাহিনী থেকে বাছাই তিন ব্যাটালিয়ন ঘাতক। রাত ১০টা ৩৫। নর্থ ঢাকায় সৈন্যরা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল ঘিরে ফেলেছে। রিসেপসনে কালো বোর্ডে চকখড়ি দিয়ে একজন বাচ্চা ক্যাপ্টেন লিখে দিল- বাইরে বেরুলেই গুলি। বিদেশী সাংবাদিকরা বেরোতে না পেরে রেডিও ধরলেন। কারফিউর কোন ঘোষণা নেই। বাইরে ট্যাংকের শব্দ। ছুটে সবাই ১২ তলায় উঠলেন। মেশিনগানের গুলিতে কানপাতা দায়। ভুট্টোর ঘরের দরজায় গিয়ে সবাই থমকে দাঁড়ালেন। কড়া পাহারা। কাঁচা ঘুম জাগানো বারণ। ঢাকা-করাচি টেলিপ্রিন্টার লাইনও কেটে দেয়া হয়েছে। বাইরে পৃথিবী থেকে ঢাকা বিচ্ছিন্ন। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বেতারের প্রচার। কেউ জানতেই পারেনি ততক্ষণে খুলে গেছে নরকের দরজা। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে হানাদার বাহিনীর সেই বর্বরোচিত হামলায় সবাই হতবাক হয়ে যায়। মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে মার্কিন ট্যাংক, সঙ্গে সেনাবোঝাই লরি। ইকবাল হল (বর্তমানে জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হলে মধ্যযুগীয় কায়দায় চলে পাকিস্তানী হানাদারদের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ। রক্তের হোলি খেলায় মেতে উঠে মানুষরূপী নরপিশাচরা। অসহায় নারী-পুরুষের মর্মান্তিক আর্তনাদ। চলল বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ আর ধ্বংসের উন্মত্ত তান্ডব। প্রতিটি রুমে ঢুকে পড়ে ঘুমন্ত ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করে পাক জল্লাদরা। একে একে গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে জগন্নাথ হলের ১০৩ জন হিন্দু ছাত্রকে। হলের কর্মচারীদের কোয়ার্টারে ঢুকে তাদের স্ত্রী-বাচ্চাসহ পুরো পরিবারকে একে একে নির্মমভাবে হত্যা করে। ওই রাতে মানুষরূপী ক্ষুধার্থ শকুনেরা শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি। পাক জান্তারা সেই রাতে বাবার সামনে মেয়েকে আর ছেলের সামনে মাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে। কাউকে কাউকে তারা সেদিন বাঁচিয়ে রেখেছিল নিহতদের কবর খোঁড়ার কাজ করতে। মাথায় বন্দুকের নল ঠেকিয়ে তাদের বাধ্য করে প্রিয়জনের কবর খুঁড়তে। তাদের দিয়েই একে একে সহপাঠীদের লাশ টানিয়ে এনে মাটি চাপা দিয়েছিল পাক সেনারা। তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি। কাজ শেষে তাদের লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করা হয়। সেদিন রাতে একযোগে জগন্নাথ হল ছাড়াও ইকবাল হল, রোকেয়া হলে শকুনীর দল একে একে দানবের মতো হিংস্র থাবায় তছনছ করে দিয়েছিল। পাক জান্তাদের কালো থাবা থেকে রক্ষা পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও। ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য. ড. মনিরুজ্জামানসহ বিভিন্ন বিভাগের নয়জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। হানাদারেরা চলার পথে রাস্তার দুই পাশে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলে অসংখ্য নিরীহ, গরিব মানুষকে। মেডিক্যাল কলেজ ও ছাত্রাবাসে গোলার পর গোলা ছুড়ে হত্যা করা হয় অজস্র মানুষকে। চারদিক রক্ত আর রক্ত, সারি সারি শহীদের লাশ। সেদিন হিংস্র শ্বাপদ পাক বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পেতে রোকেয়া হলের ছাদ থেকে প্রায় ৫০ জন ছাত্রী ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়েছিল। নরপশুরা সেদিন হত্যার পাশাপাশি ধর্ষণ, লুট, জ্বালাও-পোড়াও প্রত্যক্ষ করেছিল শহরের সব জায়গায়। সেই রাতে রাজারবাগ পুলিশের সদর দফতরে পাকসেনাদের সাঁড়াশি অভিযানের মুখেও বাঙালী পুলিশ সদস্যরা আত্মসমর্পণের বদলে রাইফেল তাক করে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। কিন্তু শত্রুর ট্যাংক আর ভারী মেশিনগানের ক্রমাগত গুলির মুখে মুহূর্তেই গুঁড়িয়ে যায় সমস্ত ব্যারিকেড। গ্যাসোলিন ছিটিয়ে আগুনে ভস্মীভূত করা হয় পুলিশের সদর দফতর। সে রাতে ১১শ’ বাঙালী পুলিশের রক্ত ঝরিয়ে তারা ক্ষান্ত হয়নি। গুঁড়িয়ে দিয়েছিল পুরো ব্যারাক, জ্বালিয়ে দিয়েছিল সবকিছু। অন্যদিকে নগরজুড়েও রাতভর চলেছে বর্বরোচিত নিধনযজ্ঞ ও ধ্বংসের তান্ডব। হতচকিত বাঙালী কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঢলে পড়েছে মৃত্যুর কোলে। দানবীয় বাহিনীর আক্রমণের বিভীষিকায় নিমজ্জিত হয় ঢাকা। কেঁদে ওঠে শহরের রাজপথ, অলিগলি, ফুটপাত, খেলার মাঠ, ক্যাম্পাস। মানুষের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে আকাশ। সে কান্না ছাপিয়ে তখন আকাশে কেবলই মুহুমুর্হু আগুনের লেলিহান শিখা। চারদিকে কেবল প্রজ্বলিত অগ্নিকা-, ধ্বংস আর মর্মন্তুদ চিৎকার। মধ্যরাতেই ঢাকা তখন লাশের শহর। দেশের বড় বড় শহরগুলোতেও একইভাবে অতর্কিতে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাক সেনারা। অবশ্য এই পরিস্থিতিতেও বাঙালী ছাত্র-জনতা রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ঢাকার ফার্মগেট থেকে শুরু করে বিশ^বিদ্যালয় এলাকার চারপাশে সর্বত্র এই প্রতিরোধ ছিল। প্রতিরোধ ছিল চট্টগ্রামেও। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংস বর্বরতার মুখে সেদিন কিছুই করতে পারেননি অকুতোভয় বাঙালীরা। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ॥ ঢাকার পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকলে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর শুভাকাক্সক্ষীরা বাসা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়ার অনুরোধ করেন। তাঁর জন্য হেলিকপ্টারও প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। কিন্তু বাঙালীদের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু জানতেন পাকিস্তানী বাহিনী তাঁকে না পেলে একজন বাঙালীকেও বাঁচতে দেবে না। সে রাতে তাঁকে না পেলে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তছনছ করে দেয়া হতো পুরো শহর। ওইদিন জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে ইয়াহিয়া বললেন- ‘মুজিব দেশের অখন্ডতা ও নিরাপত্তার ওপর আঘাত হেনেছেন। এ অপরাধের জন্য তাকে শাস্তি পেতেই হবে। দেশের এই ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্য আজ আমি দেশব্যাপী রাজনৈতিক কর্মকা- নিষিদ্ধ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ এরপর গণহত্যার নির্দেশ দিয়ে করাচির পথে ঢাকা ত্যাগ করেন জল্লাদ ইয়াহিয়া। ২৫ মার্চ সন্ধ্যা রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেন- ‘ইয়াহিয়া খান সমস্যা সমাধানের জন্য সামরিক ব্যবস্থা বেছে নিলেন আর এখানেই পাকিস্তানের সমাপ্তি হলো’। রাত সোয়া একটার দিকে ট্যাংক সাঁজোয়া গাড়ি ও এক লরি সৈন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। তখন বাঙালীর নেতা বঙ্গবন্ধু বীর বাঙালীর মতোই নিজেরই দোতলার ঝুল বারান্দায় এসে দাঁড়ান। রাত ১টা ২৫ মিনিটের দিকে এ বাড়ির টেলিফোনের লাইন কেটে দেয়া হয়। আর বাঙালীর স্বাধীনতার স্বপ্নকে চিরতরে নিভিয়ে দেয়ার জন্য বাঙালী জাতির নেতা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পাকি হায়েনার দল। ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে গ্রেফতার হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু তৎকালীন ইপিআরের ওয়ারলেসের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেন। ইপিআরের ওয়ারলেসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। এই ওয়্যারলেস বার্তা চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দফতরে পৌঁছায়। চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙ্গর করা একটি বিদেশী জাহাজও এই মেসেজ গ্রহণ করে। চট্টগ্রামে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বাণী সেই রাতেই সাইক্লোস্টাইল করে শহরবাসীর মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন। বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ঘোষণার ভিত্তিতেই ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালিত হয়। এদিকে চট্টগ্রামে তৎকালীন ক্যাপ্টেন রফিকের (সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব) রফিকুল হক বীর উত্তম এমপি) নেতৃত্বে ষোলশহর এলাকায় গড়ে তোলা হয় প্রতিরোধ ব্যূহ। সারাদেশেই যখন বাঙালীর প্রতিরোধের আগুন, তখন ২৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে বাঙালীর মধ্যে চট্টগ্রামে কর্মরত সিনিয়র অফিসার মেজর জিয়া তার কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল জানজুয়ার নির্দেশে এমভি সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে রওনা হন। পথে অনেক স্থানের বাঙালীর দেয়া ব্যারিকেড সরিয়ে তিনি এগিয়ে যেতে থাকেন। এদিকে রাত ৯টার দিকেই পাক হানাদাররা ঝাঁপিয়ে পড়ে সেনানিবাসে বাঙালীদের ওপর। নির্বিচারে হত্যা করা হয় সহস্রাধিক বাঙালী সেনা ও তাদের পরিবারের সদস্যকে। ক্যাপ্টেন রফিকের প্রতিরোধের সংবাদ এবং সেনানিবাসে হামলার ঘটনা শুনে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান যখন মেজর জিয়ার সঙ্গে রাস্তায় ব্যারিকেড সরানো অবস্থায় দেখে ঘটনা খুলে বলেন, তখন মেজর জিয়া তাদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়ে তিনি তার নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মেজর জিয়া যখন রাত ১টার দিকে ক্যাপ্টেন অলি আহমদ, ক্যাপ্টেন মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন শমসের মবিনসহ অন্যদের মাঝে ফিরে আসেন ততক্ষণে পাক সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ প্রায় শেষ। ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বে প্রতিরোধ যুদ্ধও ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে। এদিকে গাজীপুরেও শফিউল্লাহর নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয় তীব্র প্রতিরোধ। এরপর আর বীর বাঙালীকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এক সাগর রক্তের ঢেউ পেরিয়ে অভ্যুদয় ঘটে বাঙালীর হাজার বছরের স্বপ্নসাধ ও আকাক্সক্ষার ফসল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ, সোনার বাংলা। কর্মসূচি ॥ জাতীয় গণহত্যা দিবস উপলক্ষে জাতি আজ গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে ২৫ মার্চের সেই কালরাতে নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার বীর বাঙালীদের। রাজধানীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃৃতিক সংগঠন ‘কালরাত্রি’ স্মরণে নানা কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। শোকাবহ জাতি ঘৃণা ও ধিক্কার জানাবে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশী দোসর কুলাঙ্গার রাজাকার, আল-বদর ও আল-শামসদের। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক পত্রে বলা হয়েছে, আজ ২৫ মার্চ রাত ৯টা থেকে ৯টা ১ মিনিট সারাদেশে প্রতীকী ব্লাক আউট কর্মসূচী পালিত হবে। জাতীয় গণহত্যা দিবসের অংশ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় আজ সকাল ১০টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘রক্তাক্ত ২৫ মার্চ গণহত্যার ইতিহাস’ শীর্ষক শিরোনামে আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। সারাদেশে সভা, সমাবেশ, র‌্যালি, আলোকচিত্র প্রদশর্নীসহ বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে যথাযথ মর্যাদায় আজ গণহত্যা দিবস পালন করবে আওয়ামী লীগ। দিবসটি উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আজ বিকেলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। এতে সভাপতিত্ব করবেন দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণহত্যা দিবসে আজ বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাব এক সেমিনারের আয়োজন করেছে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গত ২৪ বছরের ন্যায় এবারও ভয়াল সেই কালরাত্রি স্মরণে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে আলোর মিছিল বের করবে। স্বাধীনতা ও গণহত্যার ৪৭তম বার্ষিকীতে আজ রাত ৮টায় ৪৭টি মশাল প্রজ্বলন ও আলোর মিছিলে নেতৃত্ব দেবেন মহান মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়করা, মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ পরিবারের সদস্যরা। গণহত্যার কালরাত্রি উপলক্ষে আলোচনা সভায় সূচনা বক্তব্য রাখবেন নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি লেখক-সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির। সভাপতিত্ব করবেন সংগঠনের অন্যতম উপদেষ্টা মুক্তিযোদ্ধা বিচারপতি শামসুল হুদা। আলোচনা সভার পর স্বাধীনতার ৪৭তম বার্ষিকী উপলক্ষে ৪৭ জন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা মশাল জ্বালিয়ে আলোর মিছিলের সূচনা করবেন। শহীদ মিনার থেকে আলোর মিছিলটি জগন্নাথ হলের বধ্যভূমিতে শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মাধ্যমে শেষ হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির যৌথ উদ্যোগে জাতীয় গণহত্যা দিবস পালন করা হবে। এ উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি চিরন্তন চত্বরে আয়োজন করা হয়েছে নানা অনুষ্ঠানের। এর মধ্যে রয়েছে- সন্ধ্যা ৭টায় স্মৃতি চিরন্তরে মোমবাতি প্রজ্বলন, ডকুমেন্টারি প্রদর্শন, আলোচনা সভা। এছাড়া বাদ জোহর মসজিদুল জামিয়ায় ২৫ মার্চের রাতে নিহতদের স্মরণে বিশেষ মোনাজাত এবং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। জগন্নাথ হলও এ উপলক্ষে বিস্তারিত কর্মসূচী গ্রহণ করেছে।
×