ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মহাসমাবেশে ঘোষণা ॥ বললেন সরকার শুধু রুটিন কাজ করবে, নির্বাচন করবে ইসি

এবার এরশাদ দিলেন নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা

প্রকাশিত: ০৪:৫০, ২৫ মার্চ ২০১৮

এবার এরশাদ দিলেন নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সংসদের প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের সমন্বয়ে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। শনিবার দুপুরে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় পার্টির (জাপা) নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত জাতীয় জোটের মহাসমাবেশে তিনি এই প্রস্তাব দেন। নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা তুলে ধরে সাবেক স্বৈরশাসক এরশাদ বলেন, ‘সাংবিধানিক পদ্ধতির অধীনে নির্বাচনকালীন সংসদের প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তীকালীন একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সংসদ সদস্যদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভা গঠনের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে এর বিকল্প নেই। এই সরকার শুধু রুটিন মাফিক রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনা করবে। নির্বাচনে এই অন্তর্বর্তী সরকারের কোন ভূমিকা থাকবে না। নির্বাচন পরিচালনা করবে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন। এরশাদ বলেন, অনেকেই আমার কাছে জানতে চান আগামী নির্বাচন কেমন হবে, নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা কী? উত্তরে আমি বলতে চাই, আমরা জাতীয় পার্টি সুষ্ঠু নির্বাচন চাই। নির্বাচনের সময় জাতীয় সংসদ সদস্যদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করতে হবে। আমরা সাধারণ কাজকর্ম করব। নির্বাচন করবে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন স্বাধীন থাকবে এবং একে (নির্বাচন কমিশন) পূর্ণ ক্ষমতা দিতে হবে। ইনশা আল্লাহ, সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে বাধ্য থাকবে। জাতীয় পার্টি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করার মতো শক্তি অর্জন করেছে বলেও এরশাদের দাবি। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এরশাদ তার বক্তব্যের প্রথম ২৮ বার্তার শেষ দিকে বলেছেন, আমরা কোন কেয়ারটেকার, সহায়ক কিংবা কোন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় বিশ্বাস করি না। এর কারণও জানিয়েছেন তিনি। তার অভিযোগ কোন তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাতীয় পার্টির প্রতি সুবিচার করেনি। এরশাদের ভাষ্য, সেই কলঙ্কিত ব্যবস্থা সংবিধান থেকে মুছে গেছে। আমরা সাংবিধানিক ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে চাই। বক্তব্যে সরকারের সমালোচনা করেন এই সাবেক রাষ্ট্রপতি। একইসঙ্গে নিজের ক্ষমতাকালীন অবস্থার চিত্র তুলে ধরেন তিনি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির নেতিবাচক দিক তুলে ধরে দল দুটির নিন্দা করেন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই বিশেষ দূত। হরতাল-অবরোধ নিষিদ্ধ চেয়ে এরশাদ বলেন, আমি দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করে জনগণের কল্যাণে ১৮ দফা কর্মসূচী প্রণয়ন করেছিলাম। আজ আবারও নতুনভাবে ১৮ দফা প্রণয়ন করছি। ১৮ দফার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রাদেশিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করা, নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার করে আনুপাতিক হারে ভোটের ভিত্তিতে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচন, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূলবৃদ্ধি না করা, ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধ করা, কৃষকদের ভর্তুকি প্রদান, খাদ্যে ভেজাল নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষা পদ্ধতি সংস্কার, স্বাস্থ্যসেবা খাতের উন্নয়ন, হরতাল-অবরোধ নিষিদ্ধকরণ, দ্রুততম সময়ের মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ বাস্তবায়ন এবং সারাদেশে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা। এরশাদের মন্তব্য, দেশে এখন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি চলছে। পত্রিকার পাতা খুললেই খুন, হত্যা, ধর্ষণের খবর। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে সম্মিলিত জাতীয় জোটকে ভোট দিয়ে দুটি দলের কাছ থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে। সকাল নয়টায় শুরু হয় সমাবেশ। ভোর থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নেতাকর্মীরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যোনে জড়ো হতে থাকে। সমাবেশ শেষ হওয়া পর্যন্ত নেতাকর্মীদের আসতে দেখা গেছে। কথা ছিল জানুয়ারিতে এই সমাবেশ হবে। তারপর ফেব্রুয়ারিতেও আরেকদফা সময় পরিবর্তন হয়। তাই এবারের প্রস্তুতি ছিল বেশ। ঢাক-ঢোল, বাদ্য বাজনা আর গানের তালে তালে- লাঙ্গল কাঁধে নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতি ছিল রাজপথে। সমাবেশের কারণে রাজধানীর বিভিন্ন রুটে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এরশাদ বলেন, জনগণ সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। আমরা চাই দেশবাসী তার ভোট দিতে পারুক। দেশে এখন কোন নির্বাচন হয় না, তবে এবার সরকারকে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে বাধ্য করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা ইসিকে নির্বাচনকালীন রূপরেখা দিয়েছি। সংসদে যারা আছেন তাদের নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে হবে। আমরা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করব না। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন পরিচালনা করবে। সমাবেশে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ আরও বলেন, সারাদেশে চলছে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি ও লুটপাটের মহোৎসব। শিক্ষাঙ্গনে পচন ধরেছে, গোল্লায় গেছে। ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে শিক্ষার ভবিষ্যত। আগে পাস করতে কষ্ট করতে হতো। এখন কষ্ট করেও ফেল করা যায় না। ব্যাংকে টাকা নেই, শেয়ার বাজার ধ্বংস। আগামী প্রজন্ম ধ্বংসের পথে। সমাজে সর্বত্র অবক্ষয়। নিরাপত্তা নেই, নেই শান্তি। এত অবিচারের মধ্যে দেশবাসীকে শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে দিতে প্রস্তুত জাতীয় পার্টি। তিনি আরও বলেন, দেশ নাকি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে! আতশবাজি ফুটিয়ে উৎসব করা হলো। আদৌ কি দেশ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে? উন্নয়ন শুধু ঢাকায়। ঢাকার বাইরে কোন উন্নয়ন নেই। গ্রামের মানুষ ভাল নেই। ঢাকার বাইবের অবস্থা একবার স্বচক্ষে দেখে আসুন। সমাবেশে জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ এমপি বক্তব্যের শুরুতেই স্বাধীনতার মাসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল শহীদকে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, জাতীয় পার্টি আর কারো ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হবে না। জাতীয় পার্টির শাসনামলে দেশে দলীয়করণ, চাঁদাবাজি ছিল না। মানুষ আবার এরশাদের শাসনামলে ফিরতে চায়। পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, দেশের রাজনৈতিক গন্তব্যর অস্থিরতা বিরাজ করছে। অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিচ্ছে। বেকারত্ব বাড়ছে। শিক্ষিত বেকাররা মাদকে আসক্ত হচ্ছে। মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার বলেন, অনেক ষড়যন্ত্র আর আঘাত করেও জাতীয় পার্টিকে ধ্বংস করা যায়নি। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ক্ষমতায় এলে অনেকের মামলা প্রত্যাহার করা হয়, কিন্তু পল্লীবন্ধু এরশাদসহ আমাদের অনেক কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মামলা ঝুলছে। ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, জাপাকে অনেকে ধ্বংস করতে চেয়েও পারেনি। মানুষ আজ পরিবর্তন চাচ্ছে। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, প্রফেসর দেলোয়ার হোসেন খান, সুনীল শুভ রায়, মশিউর রহমান রাঙ্গা, সাহিদুর রহমান টেপা, এ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম, মেজর (অব.) খালেদ আখতার, লিয়াকত হোসেন খোকা এমপি, জহিরুল আলম রুবেল, জোটের শরিক দলের নেতা এমএ মান্নান, এমএ মতিন ইসলামী, আবু নাসের ওয়াহেদ ফারুক প্রমুখ। নেতাদের শোডাউন ॥ মহাসমাবেশে জাপার মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, ঢাকা-৪ আসনের এমপি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা, রত্না আমিন হাওলাদার, লিয়াকত হোসেন খোকা ছাড়াও শোডাউন করেন, ঢাকা-১ আসনের এমপি এ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি, চট্টগ্রাম থেকে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, কুমিল্লার এমপি আমির হোসেন, সিলেটের এমপি ইয়াহিয়া চৌধুরী, তাজ রহমান, মানিকগঞ্জ-৩ থেকে জহিরুল আলম রুবেল, ঢাকা-৫ থেকে মীর আব্দুস সবুর আসুদ, রংপুর থেকে মশিউর রহমান রাঙ্গা, কিশোরগঞ্জ থেকে মুজিবুল হক চুন্নুর অনুসারীরা। এছাড়া জাতীয় যুব সংহতি, জাতীয় ছাত্র সমাজ, জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক পার্টি, জাতীয় শ্রমিক পার্টি ও জাতীয় কৃষক পার্টিও বিশাল মিছিলসহকারে সমাবেশে যোগ দেন। যানজটের জন্য দুঃখ প্রকাশ ॥ মহাসমাবেশের কারণে সকাল থেকেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশপাশের পুরো এলাকায় ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। পল্টন থেকে শাহবাগমুখী সড়কে বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। এতে ব্যাপক জনদুর্ভোগ সৃৃষ্টি হয়। এজন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন জাতীয় পার্টি ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি। মহাসমাবেশে বক্তব্যের সময় তিনি বলেন, আজ সমাবেশে এরশাদ প্রেমিকদের ঢল নেমেছে। এজন্য রাজধানীবাসীকে যানজটের কবলে পড়ে ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়েছে। আমি জাতীয় পার্টির পরিবারের পক্ষ থেকে রাজধানীবাসীর কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি। এরশাদ বলেন, ‘মানুষ আমার কাছে বার্তা চায়। প্রথম বার্তা হচ্ছে, আমরা ইতিহাস সৃষ্টি করব। আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করব। এ আমার বার্তা। আমরা প্রস্তুত। দেশ প্রস্তুত। ২৫/৩০ বছর আমরা ক্ষমতায় ছিলাম না। দুই দল ক্ষমতায় ছিল। তারা জনগণকে কী দিয়েছে? অন্যায়-অবিচার। নারীদের লাঞ্ছনা, বেকারত্ব। জনগণকে তারা কিছু দিতে পারেনি। শুধু লম্বা লম্বা কথা। সমাবেশের কথা উল্লেখ করে এরশাদ বলেন, এত বড় জনসমুদ্র আর কখনও দেখিনি। ঢাকার রাস্তা অবরুদ্ধ। সব রাস্তা বন্ধ। মানুষ চলতে পারছে না। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় যাওয়ার শক্তি অর্জন করেছে। তিনি নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘উই আর রেডি অর নট? উই আর রেডি।’
×