ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সাংস্কৃতিক জোটের স্বাধীনতা উৎসব

রোদে জলে দিনে রাতে অস্ত্র কাঁধে অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধ ছুটে আসে...

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ২৫ মার্চ ২০১৮

রোদে জলে দিনে রাতে অস্ত্র কাঁধে অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধ ছুটে আসে...

মোরসালিন মিজান ॥ মার্চের বিকেল। শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে পা রাখতেই ভেতরে অদ্ভুত একটা শিহরণ। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে। কিন্তু শিল্পীদের কণ্ঠে ছিল সূর্যোদয়ের গান। সম্মেলক কণ্ঠে তারা গাইলেন- পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে/রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল।/জোয়ার এসেছে জনসমুদ্রে/রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল...। বার বার শোনা গান। এর পরও ভেতরে একটা জোয়ার অনুভূত হলো। চোখের সামনে যেন ভেসে উঠলো একাত্তর। হ্যাঁ, পূর্ব দিগন্তে স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়েছে। কিন্তু মুক্তির তো এখনও বাকি। সেই মুক্তির সংগ্রামে নতুন করে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানালেন সংস্কৃতিকর্মীরা। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ স্লোগানে শুরু হলো স্বাধীনতা উৎসব। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে শনিবার এর উদ্বোধন করেন আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি সাবেক ডেপুটি স্পীকার কর্নেল শওকত আলী। এর আগে শহীদ মিনারের বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্য দিয়ে উৎসবের সূচনা করা হয়। শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন সংস্কৃতি কর্মীরা। এরপর বেজে ওঠে প্রাণের সুর। উপস্থিত সকলেই দাঁড়িয়ে গায়- আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি...। জাতীয়সঙ্গীতের সুরে আমূল বদলে যায় পরিবেশ। সবাই যখন আবেগঘন, মাইকের সামনে এসে দাঁড়ান কবি মুহাম্মদ সামাদ। তার স্বরচিত কবিতায় ৭ মার্চ। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। তিনি আবৃত্তি করে যান- রোদে জলে দিনে রাতে/অস্ত্র কাঁধে অস্ত্র হাতে/মুক্তিযুদ্ধ ছুটে আসে...। কবি তারিক সুজাতও স্বরচিত কবিতায় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ। আলোচনায় অংশ নেন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, গণসঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীর প্রমুখ। সভাপতিত্ব করেন জোট সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। বক্তারা বলেন, একাত্তরের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি। বিপুল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালী তা অর্জন করেছে। কিন্তু একইদিন সমান গুরুত্ব দিয়ে অবিসংবাদিত নেতা উচ্চারণ করেছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’ মানুষের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছিলেন জাতির জনক। কিন্তু মাঝপথে থামিয়ে দেয়া হয়েছিল তাঁকে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের পথ ধরে, ৩০ লক্ষ শহীদের স্বপ্নের পথ ধরে সবসময় এগিয়ে যেতে পারেনি বাংলাদেশ। বারবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি। বারবার আমরা পিছিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের রাজনৈতিক অনৈক্যের সুযোগ কাজে লাগিয়েছে শত্রুপক্ষ। বঙ্গবন্ধু দুই যুগ ধরে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন জানিয়ে বক্তারা বলেন, তাঁর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেও অনেক কিছু পাওয়া হয়েছে আমাদের। বাংলাদেশের নিজস্ব আইনে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন ও রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের দায় মিটিয়েছে সরকার। অর্থনৈতিক মুক্তির প্রশ্নেও এসেছে সুখবর। মার্চ মাসেই উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে সোনার বাংলা। পাশাপাশি বক্তারা বলেন, ৪৭ বছর ধরে মুক্তির সংগ্রাম অব্যাহত থাকলেও, পথ চলার অনেক বাকি। সামনে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তি। একটি জাতীয় নির্বাচন সামনে। এ সময় আমাদেরকে আরও সাহসী হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী পরাজিত অপশক্তির চেহারা সবার সামনে তুলে ধরতে হবে। যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, যারা জাতির জনকের নেতৃত্বে বিশ্বাস করে না, তাদের রাজনীতি করার কোন অধিকার নেই। সে কথা বলতে হবে। ঐক্যের ওপর জোর দিয়ে তারা বলেন, ৬৯ সালে ঐক্যবদ্ধ না হলে গণঅভ্যুত্থান হতো না। শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গবন্ধু হতেন না। আগামী দিনগুলোতে আমরা স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখতে চাই। তাই দেশের জন্য নিজেদের আরও নিবেদিত করতে হবে। তারা বলেন, আমরা চাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি সরকার গঠন করুক। কিন্তু একইসঙ্গে স্পষ্ট করে বলতে চাই কোন রকম দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার সহ্য করা হবে না। লুটেরাদের ছাড় দেয়া হবে না। দেশপ্রেম থেকে কোন সরকার বিচ্যুত হলে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলবে বলেও জানান বক্তারা। আলোচনা পর্ব শেষ হলে শুরু হয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। দলীয় সঙ্গীতে মুক্তির কথা বলে উদীচীর শিল্পীরা। একই সুর শোনা যায় সুরতালের পরিবেশনায়। একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন আরিফ রহমান, আবদুল হালিম খান। একক আবৃত্তি করেন এনামুল হক বাবু ও ফয়জুল আলম পাপ্পু। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে স্পন্দন। পথনাট নিয়ে মঞ্চে ছিল সময় সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী। দলীয় আবৃত্তি পরিবেশন করে মুক্তধারা আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্র ও প্রকাশ। একই দিন থেকে স্বাধীনতা উৎসব শুরু হয়েছে ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবর মঞ্চে। অনুষ্ঠানে একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন আঁখি বৈদ্য ও আসিফ ইকবাল সৌরভ। দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করে পঞ্চভাস্কর, নন্দন, উজান। কবিতায় স্বাধীনতার কথা বলেন বেলায়েত হোসেন, ইকবাল খোরশেদ, নায়লা তারান্নুম চৌধুরী কাকলী ও মাসুদুজ্জামান। দলীয় আবৃত্তি নিয়ে মঞ্চে ছিল স্বরশ্রুতি, কথা আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্র ও ত্রিলোক বাচিক পাঠশালা। নৃত্যের ভাষায় মুক্তিসংগ্রামের কথা বলে নান্দনিক নৃত্য সংগঠন ও কত্থক নৃত্য সম্প্রদায়। সবশেষে ছিল পথনাটকের পরিবেশনা। ইউনিভার্সেল থিয়েটারের পরিবেশনা দিয়ে প্রথম দিনের আয়োজন। তিন দিনব্যাপী আয়োজন আগামীকাল সোমবার শেষ হবে।
×