ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নারীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত কর‍া গেলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে

প্রকাশিত: ০৭:৩৫, ২৫ মার্চ ২০১৮

নারীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত কর‍া গেলে উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ‘খাজ (কাজ) তো খাজই, খাজ না করলে খাইমু কি। বড় বড় পাস দেওয়ার পারি নাই, জাকরি কেমনে করমু? তয় মাঠে গিয়ে ফসলের কাজ সবই পারি। আফনারা আমারে একটু জমি দেন। আমি ধান লাগাইমু, আয় উন্নতি করতাম চাই।’ কথাগুলো ছিপছিপে একহারা গড়নের সুহেদা বেগমের। তিনি বিধবা হয়েছেন পাঁচ বছর আগে। পাঁচ সন্তানের জননী সুহেদার শূন্যদৃষ্টি, রোদে পোড়া চেহারা, শক্ত চোয়াল আর বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা বলে দেয় জীবনযুদ্ধের কঠিন সংগ্রামে তিনি একজন লড়াকু সৈনিক। সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের গোবিন্দশ্রী গ্রামের মেয়ে সুহেদার স্বামীর বাড়িও একই গ্রামে। ভিটামাটি ছাড়া নিজেদের কোন জমি নেই। বাবার বাড়ি থেকেও কোন সম্পত্তি পাননি সুহেদা। তাই অন্যের জমিতে কামলা খাটেন এই পরিশ্রমী নারী। বছরের অর্ধেক সময়ে বোরো মৌসুমে বীজতলা তৈরি করা, বৈশাখ মাসে গেরস্তবাড়িতে ধান ভানা থেকে শুরু করে গোলায় ধান ভরা পর্যন্ত সব কাজ করেই চলত সুহেদার। কিন্তু, এ সকল কাজে পুরুষরা যে মজুরি পেতেন তার চেয়ে অনেক কম মজুরি সুহেদা পেতেন। তবে গত বছরে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল এবং অতিবৃষ্টিতে সৃষ্ট অকালবন্যায় হাওড়ের সব বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় কৃষকের সব বোরো ধানের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। গ্রামে বসে কাজের কোন সুযোগ না পেয়ে সুহেদা তার দুই ছেলেকে সঙ্গে করে গ্রামের অন্যদের সঙ্গে কাজের সন্ধানে ভোলাগঞ্জ যান। সেখানে পাথর কোয়ারিতে পাথর উত্তোলন, বালু টানার কাজ করে সুহেদা রোজ ২০০ টাকা মজুরি পান। এই কাজে অনেক পরিশ্রম; বিশ্রামের কোন সুযোগ নেই বলে জানালেন সুহেদা। বাড়ির জন্য তার মন কাঁদে, সেখানে ছোট ছোট তিনটি মেয়ে পথ চেয়ে আছে মায়ের ফিরে আসার অপেক্ষায়। সুহেদার মতো অনেক গ্রামীণ নারী পুরুষের সঙ্গে ক্ষেতখামারে কাজ করে, অর্থ উপার্জনের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। নারী কৃষকরা কৃষি কাজে অবদান রেখে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখলেও ভূমির মালিকানায় বা বাজার ব্যবস্থায় নারীর প্রবেশাধিকার নেই বললেই চলে। তাদের মতে, উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে স্থায়িত্বশীল করতে নারীর ভূমি অধিকার ও কৃষিতে অংশগ্রহণের স্বীকৃতি দিতে হবে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৯ দশমিক ৪ শতাংশ নারী। কিন্তু ভূমিতে গ্রামীণ নারীর মালিকানা মাত্র ২-৪ শতাংশ এবং বাকি ৯৬ শতাংশ জমির ব্যক্তি মালিকানা পুরুষের নামে। শনিবার সকাল সাড়ে দশটায় রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০১৮ উদযাপন উপলক্ষে এ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) কর্তৃক আয়োজিত ‘উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় নারীর ভূমিকা: ভূমি অধিকার, কৃষিতে স্বীকৃতি ও করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় এসব তথ্য জানানো হয়। এতে সমীক্ষাভিত্তিক আলোচনাপত্র উপস্থাপন করেন এএলআরডির উপনির্বাহী পরিচালক রওশন জাহান মনি। প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বাঞ্ছিতা চাকমা, বিশিষ্ট সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা সার্কেলের রানী য়েন য়েন, বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক পারভীন সুলতানা ঝুমা ও এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা। এছাড়া মুক্ত আলোচনায় কয়েক নারী কৃষক তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মানবাধিকার কর্মী, এএলআরডির চেয়ারপার্সন ও নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশী কবির। আলোচনায় উপস্থাপিত সমীক্ষাপত্রে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূলধারার কর্মক্ষেত্রগুলোতে নারীর অবদান বেড়েই চলছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী কৃষি, শিল্প ও সেবা এই তিনটি অর্থনীতির বৃহত্তর খাত। এতে ১ কোটি ৬৮ লাখ নারী কাজ করছেন। তার মধ্যে শুধু কৃষি খাতে নিয়োজিত রয়েছেন ৯০ লাখের বেশি। বর্তমানে জিডিপিতে নারীর অবদান ২০ শতাংশ। সুতরাং স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নের জন্য নারীর এই সকল অবদানকে গুরুত্ব দিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হবে এবং তার জন্য রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে। তিনি বলেন, দারিদ্র্য হ্রাসকরণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই একমাত্র নিয়ামক নয়। তবে এটা ঠিক যে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ১৯৯০’র দশকের পর থেকে ক্রমান্বয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিবেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০৪ সাল থেকে গড় বার্ষিক জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের বেশি; যা উল্লেখযোগ্য হারে দারিদ্র্য দূরীকরণে সক্ষম হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রবৃদ্ধির সঙ্গে অর্থনৈতিক ন্যায্যতা এবং সমতার ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। বিভিন্ন গবেষণায় এটা প্রমাণিত যে কর্মসংস্থানসহ সকল সম্পদে পুরুষের পাশাপাশি নারীর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা গেলে তা দারিদ্র্য দূরীকরণসহ উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় ফলদায়ক হয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার শুরুর দিকে শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ অনেক কম ছিল। কারণ, নারী শুধু গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। কৃষিকাজে নারীর অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। ঘরের বাইরে গ্রামীণ নারীর পদচারণা শুরু হয়। এ পরিবর্তনের পেছনে কয়েকটি সুস্পষ্ট কারণ রয়েছে। স্বাধীনতার পর চার দশকে নারী-পুরুষের সম্পর্কের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, ফলে ভূমিহীনতা বেড়েছে। খাবারের সংস্থানের জন্য, পরিবারের আয় বৃদ্ধির জন্য পুরুষের পাশাপাশি নারীও কৃষি কাজে শামিল হয়। এই পরিবর্তন গ্রামাঞ্চলের বাইরেও বিস্তৃতি পায়। অধ্যাপক বাঞ্ছিতা চাকমা বলেন, ‘কৃষি ও কৃষিপণ্য উৎপাদনে নারীদের অবদান অনেক বেশি কিন্ত দুঃখজনক হলো নারীদের সেই পরিমাণে মূল্য বা স্বীকৃতি দেয়া হয় না। উত্তরাধিকার সম্পত্তি থেকেও তারা বঞ্চিত হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের নামে আদিবাসী এলাকাতে যে সকল স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে সেই এলাকায় বসবাসরত আদিবাসী জনগোষ্ঠী বিশেষত নারীদের চলাফেরার নিরাপত্তাটুকুও নেই।’ চাকমা রানী বলেন, ‘আদিবাসীদের বাদ দিয়ে স্থায়ীত্বশীল উন্নয়ন সম্ভব নয়। সুতরাং সমতল ও পাহাড়ের নারীদের কৃষিতে অবদানের স্বীকৃতি দিতে হবে। পাশাপাশি ব্যক্তিগত মালিকানা ও সমষ্টিগত সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরী।’ শামসুল হুদা বলেন, ‘উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় সাথে আমাদের কোন দ্বিমত নেই। তবে এতে প্রান্তিক মানুষের অংশগ্রহণ কতটুকু নিশ্চিত করতে পারলাম সেটাই বিবেচনার বিষয়। কারণ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বলে দেয়, বৈষম্য বেড়েছে প্রকটহারে। উন্নয়নে যাদের অবদান তাদের এতে যুক্ত করতে হবে। তা না হলে এটা স্থায়ীত্বশীল হবে না। যারা অপরাধী তাদের বিচার হতে হবে। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে।’ উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় নারীর ভূমিকাকে ত্বরান্বিত করতে অনুষ্ঠানে আলোচকবৃন্দ কয়েকটি সুপারিশ উল্লেখ করেন- প্রস্তাবিত সর্বজনীন পারিবারিক আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। খাসজমি নীতিমালায় বৈষম্যের জায়গাটি তুলে দিয়ে এটিকে আইনে পরিণত করা এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতে তার বণ্টন নিশ্চিত করা; কৃষি নীতিমালা সংশোধন করে নারী কৃষকের সুস্পষ্ট সংজ্ঞায়নের মাধ্যমে স্বীকৃতি প্রদান এবং সরকারী সেবাসমূহে নারীর অন্তর্ভুক্তি এবং প্রাপ্তি নিশ্চিত করা; আইন কমিশনের মতানুযায়ী সিডও ধারা ২ ও ১৬.১. (গ) থেকে সংরক্ষণ প্রত্যাহার করা; সকল প্রকার উন্নয়ন সংক্রান্ত আইনকানুন, নীতিমালা ও পরিকল্পনা (যেমন- পর্যটন) গ্রহণকালে এবং বাস্তবায়নে নারীর ওপর সম্ভাব্য ক্ষতিকর প্রভাবসমূহের কথা চিন্তায় রেখে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা। আলোচনায় ফরিদপুর থেকে আসা নারী কৃষক মনোয়ারা, রাজশাহীর তানোরের চামেলী এবং ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে আসা নাসিমা আক্তার তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, আমরা আমাদের কাজের স্বীকৃতি চাই এবং যদি তা পাই তাহলে এই উন্নয়ন আরও দ্রুত এগিয়ে যাবে। এছাড়া বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, আদিবাসী সংগঠন ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিবর্গ আলোচনায় অংশ নেন।
×