ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হাজার হাজার কোটি টাকা রেমিটেন্স হিসেবে বিদেশী কর্মীরা নিয়ে যাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৪:১২, ২০ এপ্রিল ২০১৮

হাজার হাজার কোটি টাকা রেমিটেন্স হিসেবে বিদেশী কর্মীরা নিয়ে যাচ্ছে

মন্ত্রী-মিনিস্টার নন, সরকারী পরিসংখ্যান ব্যুরো অর্থাৎ ‘বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিকস’ (বিবিএস) বলছে দেশ বেকারে ভর্তি। অথচ এক গবেষণা তথ্যে দেখা যাচ্ছে বিদেশীরা বাংলাদেশে কাজ করে প্রতিবছর বহু টাকা স্ব-স্ব দেশে নিয়ে যাচ্ছে। কত টাকা? শত কোটি টাকা? না, শত নয় হাজার হাজার কোটি টাকা। ভাবা যায়! যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত গবেষণা সংস্থা ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’ জানাচ্ছে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে বিদেশীরা কাজ করে ২০০ কোটি ডলারের বেশি যার যার দেশে নিয়ে গেছে। টাকায় কত? বর্তমান বাজারদর ৮৪-৮৫ টাকা ধরে হিসাব করলে সর্বমোট দাঁড়ায় ১৭ হাজার কোটি টাকার মতো। পিউ রিসার্চ সেন্টারের যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, এই টাকার সিংহভাগ নিয়ে যাচ্ছে চীনা কর্মী-শ্রমিকরা। তারা ২০১৬ সালে নিয়ে গেছে ৭ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। তারপরই ইন্দোনেশিয়ার স্থান ২ হাজার ২৫৫ কোটি টাকা। মালয়েশিয়া নিয়েছে এক হাজার ৬০৭ কোটি টাকা। ভারতীয় কর্মী-শ্রমিকরা নিয়েছে ৯৩৫ কোটি টাকা। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকরা নিয়েছে মাত্র ৭৬৩ কোটি টাকা। আরও যেসব দেশে ‘আউটওয়ার্ড রেমিটেন্স’ হয়েছে সে সব দেশের মধ্যে আছে : কোরিয়া, ভিয়েতনাম, নেপাল, থাইল্যান্ড, জাপান, নরওয়ে, যুক্তরাজ্য এবং শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি দেশ। পিউ রিসার্চ সেন্টারের খবর থেকে বোঝা যায় আমরাই শুধু বিদেশে কাজ করে স্বদেশে ‘রেমিটেন্স’ আনি না অর্থাৎ ডলার আনি না; আমাদের দেশ থেকেও হাজার হাজার বিদেশী কাজ করে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে যায়। তার অর্থ ‘রেমিটেন্স’ একটি দ্বিমুখী ব্যাপার। শুধু আসেই না, যায়ও। মুশকিল হচ্ছে এই আসা-যাওয়ার মধ্যে আবার দুটো দিক আছে। একটা দিক হচ্ছে সরকারীভাবে আসা-যাওয়া এবং আরেকটি দিক হচ্ছে বেসরকারীভাবে আসা-যাওয়া, যাকে বলা হয় ‘হুন্ডির’ মাধ্যমে টাকা/ডলার দেশে আনা এবং বিদেশে পাচার। দেশে আসাটা এ পথে অবৈধ হলেও তা আমাদের উপকারে লাগে, তাই কিছু বলি না। আবার উল্টোভাবে হুন্ডিতে দেশ থেকে টাকা চলে গেলে তা ক্ষতিকর এবং তাই আমরা এই নিয়ে হৈচৈ করি। অথচ উভয়ভাবেই ‘হুন্ডি’ ক্ষতিকর এবং তা বর্তমান আইনে (মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন আইন) দ-নীয় অপরাধ। এই অপরাধ নানাভাবে সংঘটিত হচ্ছে এবং তা অবিরত। কাগজেই দেখলাম ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’ যত টাকা দেশের বাইরে যায় বলে হিসাব দিয়েছে প্রকৃতপক্ষে এই বিদেশগামী টাকার পরিমাণস তারচেয়ে অনেক অনেক বেশি। দেশে বর্তমানে তিনটি সংস্থা বিদেশীদের ‘ওয়ার্ক পারমিট’ দেয়। তাদের হিসাব মতে এবং সরকারী তথ্য মোতাবেক এই মুহূর্তে বাংলাদেশে মোটামুটি ৮০ হাজার বিদেশী কাজ করে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোক ভারতের। বলা হচ্ছে প্রায় অর্ধেকের মতো। যদিও তাদের সরকারীভাবে পাঠানো টাকা চীন, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার তুলনায় তা কিছুই নয়। কিন্তু মুশকিল অন্যত্র। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার উদ্ধৃতি দিয়ে মিডিয়া কয়েকদিন পরপরই বলছে হিসাবের বাইরেও প্রচুর সংখ্যক লোক অবৈধভাবে বাংলাদেশে কাজ করছে। শর্ট ভিসায় এসে কাজ করে তারা চলে যায়, আবার আসে, আবার যায়। এর মধ্যে বহু লোক আছে যারা প্রচুর বেতনে-মজুরিতে কাজ করে। স্থানীয়দের তুলনায় তাদের বেতন-মজুরি অনেক অনেক বেশিÑ দ্বিগুণ, তিনগুণ, চারগুণও। এ ধরনের লোকের নাকি হিসাব নেই। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এর ওপর কাজ করছে। তারা এসব লোককে ধরার জন্য কাজ করছে। কারণ হিসাব মতে তাদের কর দেয়ার কথা। অথচ তারা কর দেয় না, ফাঁকি দিয়ে চলে যায়। ধরার কোন উপায় নেই বলে জানানো হচ্ছে। যে সমস্ত কোম্পানিতে, ফ্যাক্টরিতে বিদেশীরা কাজ করতে আসে তার মালিকদের সহায়তায় তারা তাদের আয় গোপন করে। এতে মালিকেরও লাভ, বিদেশীদেরও লাভ। এটা এক ব্যবসায়িক সম্পর্ক। এখানে দেশপ্রেম বিবেচ্য হয় না। এমনিতে ব্যবসায়ীরা দেশের জন্য, শিল্পের জন্য কত কথা বলেন অথচ নিজস্ব লাভের প্রশ্নে তারা দেশপ্রেমের ক্ষেত্রে চরম উদাসীন। তারা নির্লিপ্তভাবে বিদেশীদের সাহায্য করছে রোজগার করতে, কর ফাঁকি দিতে। এভাবে কত টাকা ফাঁকি দেয় তারা এর কোন হিসাবই নেই। বস্তুত সরকারীভাবে যত টাকা তারা স্ব-স্ব দেশে নেয় তার চেয়ে বহুগুণ বেশি টাকা বেসরকারীভাবে ‘হুন্ডির’ মাধ্যমে নেয়। এর কী কোন হিসাব আছে? দৃশ্যত নেই। তবে ‘কানাকানি’ করে অনেকেই অনেক হিসাব দেন এবং বলেন অমুক দেশের লোকেরা বাংলাদেশে কাজ করে ২৫-৩০ হাজার কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে নিয়ে যাচ্ছে। যদি তাই হয় তাহলে এটা মারাত্মক খবর। সরকাররের উচিত এ বিষয়ে তদন্ত করা। আর সরকার কত তদন্ত করবে। সবদিকে খালি তদন্ত কর, তদন্ত কর- এই দাবি। আমদানি-রফতানির মাধ্যমে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে, তদন্ত কর। অমুক ঘুষ খাচ্ছে, তদন্ত কর। তদন্ত করতে করতেই সময় শেষ। এর মধ্যে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। দেশটি প্রকৃতপক্ষে যত উন্নতি করতে পারত এসব অনিয়মের কারণে ততটুকু করতে পারছে না। বর্তমান সমস্যার আসল বিবেচ্য বিষয় অন্যত্র। দেশে এত বেকার, তাহলে কিভাবে বিদেশীরা এসে কাজ করে এভাবে টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছে? ‘বিবিএস’ নামীয় ‘বামন’ প্রতিষ্ঠানটি যা বলছে তাতে দেখা যায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৫ বছরের বেশি বয়সী শ্রমিক বাজারে নতুনভাবে ঢুকেছে ১৪ লাখ। এর মধ্যে কর্মসংস্থান হয়েছে ১৩ লাখের। এক লাখ বেকার। পুরনো বেকার আছে। নতুন ও পুরনো বেকার মিলে হয় ২৬ লাখ ৮০ হাজার। আবার ছদ্ম বেকার অর্থাৎ আধাআধি বেকার হিসেবে মিলে মোট বেকার হয় ৪১ লাখ ৮০ হাজার। বিশাল হিসাব। মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো বিষয়। অথচ এসব বেকারের হিসাব দিচ্ছেন মোস্তফা কামাল সাহেব- পরিকল্পনামন্ত্রী। সরকার যাই বলুক না কেন তিনি মাঝে মাঝে এমন সব তথ্য দিচ্ছেন যাতে দিশেহারা হওয়ার মতো অবস্থা হয় অনেকের। কিছুদিন আগে মাথাপিছু খাদ্য গ্রহণের যে তথ্য তিনি জাতির সামনে পেশ করেছেন তার ‘ব্যুরোর’ মাধ্যমে তাতে দেশে খাদ্যশস্য উদ্বৃত্ত থাকার কথা। অথচ প্রচুর গম আমদানি করতে হয় প্রতিবছর। গমও কিন্তু খাদ্যশস্য। এসব ঘটনায় যাচ্ছি না। বোঝা যাচ্ছে বেকার ইদানীংকালে বাড়ছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ কমছে। ‘রোবট’ বসছে। শিল্পের আধুনিকায়ন হচ্ছে। কৃষিতে যন্ত্রপাতি ব্যবহার হচ্ছে। পুঁজিঘন শিল্প হচ্ছে বেশি বেশি। এসব আমার কথা নয়। কাগজে একদিন এসব খবর ছাপা হচ্ছে। হচ্ছে ‘দৈনিক জনকণ্ঠেও’ দেখা যাচ্ছে শিক্ষিত বেকার বাড়ছে। মেয়েদের মধ্যে বেকারত্ব বাড়ছে। রেমিটেন্স প্রাপকের পরিবারের লোকেরা কাজ করতে চায় না। আলস্য শুরু হয়েছে সর্বত্র। অন্যদিকে এমন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে দেশে যার থেকে দেশের শিল্পের দরকারি শ্রমশক্তি পাওয়া যায় না। বিবিএ, এমবিএর চাকরির দরখাস্ত পর্যন্ত করতে পারে না। ডেবিট, ক্রেডিট কাকে বলে তা বলতে পারে না। শিক্ষার পাঠ্যসূচীর সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রির প্রয়োজনীয়তার কোন সম্পর্ক নেই। অথচ বাড়িতে বাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়। পিতা-পুত্র-স্ত্রী-কন্যারাই উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, ডিন ইত্যাদি। অক্সফোর্ড, হার্ভার্ডের লিটারেচার পড়ানো হয়। অথচ মীনা বাজার, স্বপ্ন, আগোরা ইত্যাদি ‘রিটেইল শপের’ সমস্যা কী তা বিবিএ, এমবিএরা জানে না। অঙ্ক নেই, বিজ্ঞান নেই, ইংরেজী নেই। ‘হরিবল’ অবস্থা। এই শিক্ষা থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের লোক পাওয়া যাবে না। বিপণন, উৎপাদন, মার্চেডাইজিং, হিসাবায়ন ইত্যাদির লোক নেই। বিদ্যুত মিস্ত্রী, ওয়েলডিং মিস্ত্রি নেই। টেকনিক্যাল শিক্ষায় শিক্ষিত যুবক নেই। জেনারেল এমএ, বিএতে ভর্তি দেশ। এদের দিয়ে কী হবে? এরা তো কেরানীও না, প্রশাসকও না। বই পড়ে বুঝতে পারে সমস্যা- তাও তারা নয়। এ ফাঁকেই বিদেশীদের আগমন। আমি দেখেছি অনেক দেশের নাম শুনতে পারে না অনেক শিল্পপতি। অথচ ওই সব দেশের কর্মীরা তাদের প্রিয়পাত্র। তাদের জন্য বিশাল বিশাল ফ্ল্যাট ভাড়া করা থাকে। থাকা-খাওয়ার অপূর্ব সুযোগ-সুবিধা। সাধে তারা তা করে না। প্রয়োজন বড় বালাই। অথচ বিদেশীরা সব টাকা ‘লুট’ করে নিয়ে যাচ্ছে না বলে এর কারণ খোঁজা দরকার। ওই কারণ দূর করার চেষ্টা করা দরকার। সারাদেশে টেকনিক্যালি দক্ষ লোক তৈরির কলেজ-প্রতিষ্ঠান দরকার। ব্যবসায়ীদের ‘ব্যাংক-বীমা-অব্যাংক’ করার বদলে বলা দরকার জেলায় জেলায় ভাল স্কুল করার জন্য, যাতে ছেলেমেয়েরা অঙ্ক, বিজ্ঞান, ব্যাকরণ জানতে পারে। খেলা, বিনোদন-সিনেমা, ‘ফেসবুক’ থেকে কিছুটা হলেও ফিরিয়ে বিজ্ঞানের দিকে জাতিকে আনা দরকার। ‘জিডিপি’ বৃদ্ধির কথার সঙ্গে, বিনিয়োগ বৃদ্ধির কথার সঙ্গে টেকনোলজি, বিজ্ঞান ইত্যাদির কথাও দরকার। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×