ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

কোটা নিয়ে কথকতা!

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ২০ এপ্রিল ২০১৮

কোটা নিয়ে কথকতা!

কোটা ব্যবস্থা যে কোন অনুন্নত, উন্নয়নশীল দেশে আছে। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বা শ্রেণীকে উন্নত জীবিকার সুযোগ না করে দিলে রাষ্ট্র উন্নত হতে পারে না। দেশের একটি বা একাধিক গোষ্ঠীকে অনুন্নত অবস্থায় ফেলে রেখে কোন দেশ উন্নত হতে পারে না। সেজন্য উন্নত বিশ্বের বহু দেশে এই ব্যবস্থা চলমান। এ লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে আরও একটি বিষয় রাষ্ট্রকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হয়, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রটি যেন এই সুযোগ গ্রহণ করে রাষ্ট্রের জন্ম, স্বাধীনতা, রাষ্ট্রের মূলনীতি ও আদর্শ বিরোধীদের হাতে চলে না যায়। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে, আমাদেরকে রাষ্ট্রের প্রশাসন, নিরাপত্তাবাহিনী এবং বিচার বিভাগ ও সংসদকে দৃঢ়ভাবে রাষ্ট্রের আদর্শ বিরোধীদের, দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীদের রাষ্ট্রের তিনটি অংশে প্রবেশের সুযোগ বন্ধ করতে হবে। এটি করা না গেলে বলাবাহুল্য এ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা বিলুপ্ত হবে এবং রাষ্ট্রটি দ্রুত ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত হবে। ফলে, মুক্তিযুদ্ধ ও এর ‘মুক্তিযোদ্ধা’ স্বাধীন দেশের নির্মাতা, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃবৃন্দ, অগণিত ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, নারী মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকা ও অবদান ইতিহাস থেকে লুপ্ত হয়ে যাবে যা জাতি ও রাষ্ট্র কোনক্রমেই ঘটতে দিতে পারে না। এখন বিসিএস পরীক্ষা পাস করে প্রশাসনের অঙ্গগুলোতে প্রবেশ করে তরুণ, তরুণী গ্র্যাজুয়েটবৃন্দ। প্রতি বছর মাত্র আড়াই হাজার পদের জন্য দু’তিন লাখ গ্র্যাজুয়েট পরীক্ষা দিয়ে থাকে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার যোগ্য মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রের প্রশাসনে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে যথার্থভাবে মুক্তিযোদ্ধা কোটা প্রবর্তন করেন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতা নিহত হলে মুক্তিযোদ্ধারা চরম রাষ্ট্রীয় হেনস্থা, হত্যা, গুম ও চাকরিচ্যুতি, ভাতা-সুযোগ-সুবিধা কর্তন ইত্যাদির শিকার হয়ে জীবন জীবিকার অস্তিত্ব সঙ্কটে পরে। যেই ধারাবাহিকতা চলে দীর্ঘ ২১ বছর। আমার ধারণা, সে সময়ের সংঘটিত বিসিএস পরীক্ষায় মুক্তিযোদ্ধারা কোন সুযোগ লাভ করেনি। উল্টো, জিয়া রাষ্টপ্রতি হয়ে এবং নিয়ম ভেঙ্গে চীফ মার্শাল’ল এডমিনিস্ট্রেটর হয়ে দিনের পর দিন মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাদের বানোয়াট ক্যু’ করার অজুহাতে ফাঁসির রায় লিখেছিল এবং দ- কার্যকর করছিল! প্রায় চার হাজার মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা ঐ সময় রাষ্ট্রের শাসকদের কোপানলে পরে প্রাণ হারিয়েছিল। অনেকের লাশ বা খবরও পাওয়া যায়নি। গুম, খুন স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-আলবদর গোষ্ঠী ’৭১-এ শুরু করেছিল, যা জিয়া অব্যাহত রেখেছিল এবং পরে খালেদা-নিজামী-তারেক-বাংলা ভাই-মুফতি হান্নান এবং আরও পরে মেজর জিয়া নামের এক জঙ্গী চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা ও জেএমবি, আনসার আল ইসলামের যৌথ নেতৃত্বে প্রগতিশীল, বিজ্ঞানমনস্ক তরুণ, উদার লালন ভক্ত, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্ম গুরু, শিয়া মতাবলম্বী, বিদেশী বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগীদের অনেকেই টার্গেটেড হত্যার শিকার হয়! সুতরাং, বলা চলে ’৭৫ থেকে ৯৬ পর্যন্ত ২১ বছর এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা শুধু নয়, আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী, সংখ্যালঘু, প্রগতিশীল লেখক, কবি মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের আক্রমণের লক্ষ্যে হয়েছিল। প্রকৃত পক্ষে, ২০০৯ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত নয় বছর মুক্তিযোদ্ধারা বা তাদের সন্তানরা সঠিকভাবে মূল্যায়িত হয়েছেন। অর্থাৎ প্রায় ত্রিশ বছর মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা চরম অবহেলার শিকার হয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটে সাধারণ হিসেবে বলা যায়, দীর্ঘ ২০০৬ পর্যন্ত, তারপর দু’বছর, ‘৭৫-এর পর মুক্তিযোদ্ধাদের অধিকাংশই তো মারা গেছেন দারিদ্র্য এবং অসম্মানের মধ্যে। স্বাভাবিকভাবে, তাদের সন্তানেরা যাতে এ নিচু অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, সেজন্য মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের তাদের পিতা-মাতাদের দীর্ঘ বঞ্চনার প্রক্রিয়া থেকে উত্তরণের জন্য সুযোগ দান ছিল পুরো জাতির। সম্ভবত অনেক পরিবারের মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরাও চাকরির বয়স অতিক্রম করেছে। বিবেচনায় সুবিধাবঞ্চিত, দারিদ্র্যে বাসরত মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনি পর্যন্ত কোটার সুবিধাটা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এখন আমার মনে দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনির জন্য ১০% কোটা থাকতে পারে এটা বোঝানোর জন্য যে কৃতজ্ঞ জাতি দীর্ঘ ত্রিশ বছর বিরূপ শাসকের কারণে যে প্রজন্মকে যথাযোগ্য সম্মান দেখাতে পারেনি, তাদের নাতি-নাতনিদের জন্য সে সুযোগ রেখে সে বঞ্চনার কিছুটা প্রতিদান দিচ্ছে। তবে, মুক্তিযোদ্ধার গ্র্যাজুয়েট নাতি-নাতনির সংখ্যা প্রতি বছর ৫% এরও কম হবে বলে, ধারণা করি। আর এটা তো বলাই বাহুল্য যে, অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধাদের আমরা দীর্ঘ ত্রিশ বছর তাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে পারিনি। প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত প্রশংসনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে বলেছেন- ‘কেউ যখন কোটা চায় না, তখন কোন কোটাই থাকার দরকার নেই।’ তিনি বর্তমানের ছেলেমেয়েদের ডিজিটাল বাংলাদেশের বর্তমানে প্রচলিত নানা ডিজিটাল প্রোগ্রামি, তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক অন্যান্য কাজ করে ঘরে বসে আয় করার অবাধ সুযোগের প্রতি আগ্রহী না দেখে ওই আড়াই হাজার সরকারী প্রশাসনের চাকরির জন্য দেশব্যাপী এত হাঙ্গামা, অস্থিতিশীল পরিবেশ, সর্বোপরি জনগণকে রাস্তা অবরোধ করে জিম্মি করার ঘটনা দেখে বিরক্ত হয়ে ঐ পদক্ষেপের কথা বলেছেন। আমার মতে, খুবই সঠিক পদক্ষেপ হয়েছে এটি। কারণ, এখন সব ছেলে মেয়ে পরীক্ষার ফলের ওপর নির্ভর করে এ চাকরি পাবে বা পাবে না। ওরা যখন মেধার কথাই বার বার বলেছে, তখন একমাত্র মেধাই থাকুক। প্রতিবন্ধী, আদিবাসী ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের জন্য বিশেষ কোন ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। তবে, মেধা দ্বারা উত্তীর্ণ ছাত্র-ছাত্রীদের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড ভালভাবে যাচাই করে দেখা সবসময় গুরুত্বপূর্ণই থাকবে। অন্তত রাজাকার, জামায়াত ও জামায়াত মিত্র পরিবারগুলোর সন্তানদের (যাদের সন্তানরাও পাকিস্তানি মানসিকতা ধারণ করে) বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে, নতুবা প্রশাসনে জামায়াত-বিএনপির আধিক্য থেকে যাবে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়নে রাষ্ট্র, সরকারকে হিমশিম খেতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ছেলেমেয়েদের মিছিল-সমাবেশের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ, টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ছোঁড়া কি ছাত্রছাত্রীদের সরকার বিরোধিতার মাত্রা বাড়িয়ে দেবার উদ্দেশ্যে করেনি? কতিপয় আইন-শৃক্সক্ষলা বাহিনী যা করেছে তা অনেকটা বাড়াবাড়ি। কিছুদিন আগে সাত কলেজের ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার ফল প্রকাশের দাবিটি ছিল ন্যায্য। তাছাড়া ঐ সাত কলেজকে যদি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধীনে আনার কোন যৌক্তিকতা থেকে থাকে তাহলে তা জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ে সাহায্যে কার্যকরভাবে করা দরকার ছিল। দেখা গেল ঐ পদক্ষেপের ফলে অপ্রস্তুত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এক শাঁকের করাতের নিচে পড়েছিল।ওটাও কোন পুলিশ দল তারেকের হয়ে কাজটি করেছিল। যেমন এবার তারেকের নির্দেশে ভিসির বাসভবন, বাসার সবরকমের সাংসারিক জিনিসপত্র, গাড়িসহ চূর্ণ, বিচূর্ণ করার দৃশ্যটি দেখে হামলাকারীদের অন্ধ আক্রোশ, রোষ, ঘৃণা, প্রতিশোধ স্পৃহা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে! গু-ারা তো ভাড়াখাটে, তারা কোটা বা শিক্ষা, এসব জানে না, বোঝে না। কারো কাছ থেকে যথেষ্ট অর্থ না পেলে তারা এ কাজ কেন, কোন ভাঙচুর, হত্যা, গুম করে না- এ তো সবাই জানে। এবার আরও একটি বিষয় অনেককে চিন্তায় ফেলেছে। আমাদের সফল কৃষিমন্ত্রী দেশের সেনাশাসন, বিএনপি-জামায়াত জোটের দুঃসাশন, এক এগারোর সেনা সমর্থিত সরকারের শাসনের সময়ে শেখ হাসিনা গ্রেফতার হলে সবসময় দলের, দেশের সঙ্কট সময়ে দলের হাল ধরেছিলেন, এমন কি ২০০৯ এর বিডিআর বিদ্রোহের সময়ও শেখ হাসিনার সঙ্গে অন্য অনেকের সঙ্গে সদ্য ক্ষমতাসীন সরকারকে রক্ষা করতে তিনিই সামনে ছিলেন। ভুলে গেলে চলবে না, তিনি মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজনীতিবিদ এবং সফল কৃষিমন্ত্রী যার নেতৃত্বে কৃষক সব রকম কৃষি সহায়তা পেয়ে দেশকে খাদ্যে স্বনির্ভর করেছে। তিনি মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিরোধিতা সহ্য করতে না পেরে সংসদে কিছু কথা বলেছেন। কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা তার পুরো বক্তব্যটি বিশ্লেষণ না করে, যে স্লোগান দিয়েছে, দিতে পেরেছে, দেখে শুনে আমি স্তম্ভিত ও চরম হতাশ হয়েছি। বুঝলাম, ওরা কারা, কিভাবে দেশের স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘকাল শাসক গোষ্ঠীর হাতে নির্যাতিত হয়েছে, দেশের মুক্তির জন্য প্রাণকে উৎসর্গ করতে মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘটিত করেছেন- সেসব সম্পর্কে, এমন কি বর্তমানে কৃষি ক্ষেত্রে তাঁর আগ্রহে, উৎসাহে, দেশ প্রেমে যে বিপ্লব সাধিত হচ্ছে, কৃষিবিজ্ঞানে দেশে নোবেল পাওয়ার মত কাজ করছে কৃষি বিজ্ঞানীরা- সেসব সম্পর্কে অন্ধ, কিন্তু স্বার্থবাদী! হায় আফশোস, তরুণ-তরুণীরা এই ২০১৮ তে ডিজিটাল কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের জন্য ব্যাকুল না হয়ে এই ট্র্যাডিশনাল বিসিএস প্রশাসনের চাকরির জন্যই কি শুধু এই দেশব্যাপী, বিশেষত ঢাকা শহরকে রণক্ষেত্রে পরিণত করল? বেসরকারী বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী কি কখনও বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছে? তাদের লক্ষ্যে কি কখনও বিসিএস ক্যাডারের চাকরি ছিল না আছে? কখনও ছিল না। এখনও নেই। তাহলে প্রশ্ন তারা কেন রাজপথে নামল? কারা তাদের নামিয়েছে? তাহলে শেষে হাতে থাকে এক- লক্ষ্য একটি দেশে বড় ধরনের অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করা যার ফল-সরকারের চরম অসুবিধা সৃষ্টি। এটি হলে কাদের লাভ- এ হিসাব ও ছাত্রছাত্রীদের করতে হবে। ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, এই তরুণ-তরুণীরা কি ডিজিটাল বাংলাদেশ চাচ্ছে? এরা কি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম হবে? ওদের তো জঙ্গীদের প্রচার-প্রচারণার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও আধুনিক উদার বিজ্ঞান চেতনার পক্ষে প্রচারণা চালানোর কথা। ওরা কি তা করছে? লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×