ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এনামুল হক

গো-হত্যা প্রশ্নে ফেঁসে গেছে বিজেপি সরকার

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ২০ এপ্রিল ২০১৮

গো-হত্যা প্রশ্নে ফেঁসে গেছে বিজেপি সরকার

বিজেপি সরকার নিজেদের তৈরি সমস্যায় নিজেরাই ফেঁসে গেছে। গো হত্যার ওপর নিষেধাজ্ঞা তাদের নিজেদেরই কঠিন সমস্যায় ফেলেছে। অনেক গরু আর উৎপাদনের কাজে আসছে না এবং সে কারণে সেগুলোর আর অর্থনৈতিক মূল্য না থাকায় মালিকরা সেগুলোকে পরিত্যাগ করেছে। এই পরিত্যক্ত গরুগুলো ইতস্তত বিচরণ করে বেড়াচ্ছে। যেখানে সেখানে যাচ্ছে। ক্ষিদের তাড়নায় যার তার জমিতে ঢুকছে, ফসল খাচ্ছে বা নষ্ট করছে। এমন চিত্র বিশেষভাবে ভারতের মধ্য প্রদেশের প্রায় ৫০ হাজার গ্রামের সর্বত্রই চোখে পড়বে। গবাদিপশুর সর্বশেষ শুমারি অনুযায়ী মধ্যপ্রদেশে প্রায় ২ কোটির মতো গরু ও ষাঁড় আছে। ভারতের যে কোন প্রদেশের মধ্যে এটাই সর্বোচ্চ। সেখানে প্রতি তিনজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে একটি গরু আছে। পরিত্যক্ত মালিকহীন এই গরুগুলোর দল বেঁধে মহাসড়কে বা ক্ষেতখামারে বিচরণ এক মস্ত সমস্যার জন্ম দিয়েছে। রাজ্যের ৫০ শতাংশ গরু প্রজননক্ষম শ্রেণীতে পড়ে না বিধায় সেগুলোকে অনুৎপাদিকা বলে ধরা হয় এবং সে কারণে পরিত্যক্ত হয়। এদের নিজেদেরই চড়ে বেড়াতে দেয়া হয়। গো হত্যার জন্য গরু বিক্রির ওপর গত বছরের মে মাসে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার চেষ্টা করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। এখন সরকার বুঝতে পারছে কি সমস্যা তারা সৃষ্টি করেছে। কৃষকদের যে কি ক্ষতি হচ্ছে সে সম্পর্কে তীব্র অভিযোগ ওঠার পর আইনটি সংশোধনের জন্য রাখা হয়েছে। সুপ্রীমকোর্ট ইতোমধ্যে সারাদেশে আইনটির ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছে। সর্বভারতীয় কিষাণ সভার আহ্বানে সম্প্রতি হাজার হাজার কৃষক গরু নিয়ে সরকারের নীতির ব্যাপারে তাদের ক্ষোভের বহির্প্রকাশ ঘটাতে নাশিক থেকে মুম্বাই পর্যন্ত প্রায় ২শ’ কিলোমিটার পথ হেঁটে মিছিল করে যায়। কর্মসূচীর সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে কৃষাণ সভা গরু ব্যবসার ওপর কার্যকর নিষেধাজ্ঞা বাতিলে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য দিল্লীতে দু’দিনব্যাপী সমাবেশ করে। মহারাষ্ট্রের পার্শ্ববর্তী রাজস্থানে গরুর সংখ্যা প্রায় সোয়া কোটি অর্থাৎ দেশের মধ্যে পঞ্চম সর্বাধিক। সেখানে প্রায় ২ হাজার গোশালা আছে যেখানে গরু থাকে ৮ লাখ। প্রতিবছর গরুর সংখ্যা বাড়ছে প্রায় ২৫ শতাংশ। এগুলোকে রাখতে গিয়ে সম্পদ ও বাজেটের ওপর চাপ পড়ছে। গোরক্ষায় রাজনৈতিক গুরুত্ব দেয়ার ফলে অনিবার্য সহিংসতার জন্ম হচ্ছে। কখনও কখনও প্রাণহানি ঘটছে। সহিংসতার কারণে গরু ব্যবসায় দেখা দিয়েছে অচলাবস্থা। ২০১০-১১ সালে রাজ্যের ১০টি প্রধান গবাদিপশুর মেলায় ৩০ হাজার গরু বিক্রি হয়েছিল। ২০১৬-১৭ সালে এ সংখ্যা ৩১ হাজারের কমে নেমে আসে। গত বছরের এপ্রিলে হরিয়ানার ডেইরি চাষী পেহলু খানের হত্যাকা-ের পর রাজস্থানে মাত্র ৪৬০টি গরু বিক্রি হয়েছে। গোশালা নির্মাণে অর্থ সঙ্কটের সমস্যা তো আছেই তার ওপর অবহেলা-অযতেœ হাজার হাজার গরুর গোশালায় মৃত্যু হয়েছে। পরিত্যক্ত গরুর মালিকদের কঠোর সাজার ব্যবস্থা থাকলেও বাহ্যত তা কোন কাজে আসছে না। পরিত্যক্ত গরুর মালিক চিহ্নিত করা প্রায়শই অসম্ভব। তা ছাড়া খরায় পীড়িত কৃষকরা যেখানে নিজেরাই ঠিকমতো খেতে পায় না সেখানে তারা বিপুলসংখ্যক অনুৎপাদনশীল গরু পরিত্যক্ত করতে বাধ্য হচ্ছে। পরিত্যক্ত গরু ক্ষেতখামার নষ্ট করায় সেগুলোকে ঠেকাতে গিয়ে অনেকে প্রাণ হারিয়েছে। উত্তর প্রদেশের এক কৃষক এমনিতেই প্রায় দু’লাখ রুপীর দেনায় আবদ্ধ ছিল। তার ওপর আপনা থেকে চড়ে বেড়ানো গরুর পালের হাত থেকে নিজের জমির ফসল রক্ষা করতে না পেরে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। পরিত্যক্ত ও চড়ে বেড়ানো গরুগুলো যথেষ্টই অর্থনীতির ক্ষতি করছে বলে উত্তর প্রদেশ রাজ্য বিধান সভায় উত্থাপিত একটি বিলে স্বীকার করা হয়েছে। পরিত্যক্ত গরুর জন্য রাজস্থানে ১৯৩৪, মধ্য প্রদেশে ১৫০০, গুজরাটে ৬৬৭, উত্তর প্রদেশে ৪৮৬ ও হরিয়ানায় ৪১০টি গোশালা আছে। এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে কোটি কোটি রুপী ব্যয় হচ্ছে। অথচ তা অর্থনীতির কোন কাজে আসছে না। উপরন্তু তা সামাজিক সম্প্রীতির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে এবং চোরাচালানে উৎসাহিত করছে। ৫০ লাখেরও বেশি পরিত্যক্ত চড়ে বেড়ানো গরুকে খাওয়ানোর জন্য ভারত সরকারের বছরে ১১ হাজার ৬০৭ কোটি রুপী প্রয়োজন। এদিকে সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রামনিয়ম গোহত্যার ওপর নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে তার নীরবতা ভঙ্গ করে গত বছরের জুন মাসে বলেছিলেন যে, কৃষকরা শুধু যে মাংস হিসাবে গরু থেকে অর্জিত আয় হতে বঞ্চিত হবে তাই নয়, উপরন্তু অনুৎপাদনশীল গরু রক্ষণাবেক্ষণ করতে গিয়ে বাড়তি খরচও বহন করতে হবে যেটা তাদের ওপর গুরুভার হয়ে চেপে বসবে। সুব্রামনিয়ম গো হত্যা নিষিদ্ধকরণকে খুব ভাল উদ্যোগ বলে মনে করেননি। সরকারের শীর্ষ অর্থনীতিবিদ বরং হুঁশিয়ার করে দিয়েছিলেন যে, এই নিষেধাজ্ঞা গবাদিপশু চাষের অর্থনীতির ওপর যথেষ্ট বিরূপ প্রভাব ফেলবে। তিনি বলেন, যে কোন সরকারেরই তাদের সামাজিক নীতি বেছে নেয়ার অধিকার আছে তবে এসব নীতির অর্থনৈতিক মাশুল সম্পর্কেও পুরো সচেতন থাকতে হবে। সরকার গত বছর হত্যার জন্য পশুরহাটে গবাদিপশু বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। এতে কেরালা, তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপক বিক্ষোভের সঞ্চার হয় যেখানে গোমাংস হলো প্রধান আহার্য বস্তুর অন্যতম। সুব্রামনিয়ম ‘গোহত্যা’ শব্দটি ব্যবহার করেননি। তবে তার পরিবর্তে অনুৎপাদনশীল গবাদিপশুর প্রান্তিক মূল্যের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন কৃষক যদি অনুৎপাদনশীল গবাদিপশু মাংসের জন্য বিক্রি করতে না পারে তাহলে গবাদিপশুর খামার লাভজনক হবে না। ইতোমধ্যেই দেখা গেছে যে গবাদিপশুর খামার থেকে প্রাপ্তির অঙ্কটা অতি সামান্য এমনকি নেতিবাচক। সরকারের নীতির ফলে কৃষকরা মাংসের উৎস হিসেবে গবাদিপশুর খাতে আয় থেকে বঞ্চিতই শুধু হবে না, এই পশু রাখার বাড়তি খরচও তাদের বহন করতে হবে। কৃষকের জীবিকার অন্যতম উৎস এই গবাদিপশু খামারের অর্থনৈতিক গুরুত্ব স্বীকার করতে হবে এবং সেই সঙ্গে মানতে হবে যে, কৃষকের জীবিকার এই উৎসটির নিয়তি ও ভবিষ্যত এই সম্পদের অর্থাৎ এক্ষেত্রে আর উৎপাদনশীল নয় এমন গরুর প্রান্তিক মূল্যের ওপর দারুণভাবে নির্ভর করবে। সুব্রামনিয়ম বলেন, এর পরও কথা আছে। পরিত্যক্ত আপনা থেকে চড়ে বেড়ানো গবাদিপশুকে রাখতে ও খাওয়াতে হবে। এর পেছনে যে বিপুল ব্যয় হবে তা নেহায়তই জলে ফেলে দেয়া হবে। এরপর আছে রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়া, যার সামাজিক ব্যয়ও কম নয়। তারপর আছে মানুষের দৈহিক পুষ্টির ওপর সম্ভাব্য প্রভাব। তিনি বলেন, ভারতীয়দের যে পরিমাণ আমিষ গ্রহণ করা উচিত তার তুলনায় তারা আগে থেকেই কম আমিষ খাচ্ছে। গোহত্যা নিষিদ্ধকরণ তাদের আমিষের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস থেকে বঞ্চিত করবে। সূত্র : ইন্ডিয়া টুডে/ইন্টারনেট
×