ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সড়কে অপ্রতিরোধ্য দুর্ঘটনা

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২১ এপ্রিল ২০১৮

সড়কে অপ্রতিরোধ্য দুর্ঘটনা

‘সড়ক দুর্ঘটনা’ মৃত্যুদানব হয়ে মানুষকে পিষে মারার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। অনভিপ্রেত এই অঘটনের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। প্রতিনিয়তই কারও বাবা, কারও মা, কারও ভাই, কারও বোন এর বেপরোয়া গতির রোষানলে পড়ে প্রাণ বিসর্জনের অকাল প্রয়াত গল্পে আটকে যাচ্ছেন। আর স্বজনহারা পরিবার-পরিজন আজীবন দুঃখের বোঝা বয়ে বেড়ানোর বীভৎস গ-িতে হাবুডুবু খাচ্ছেন। সম্প্রতি কয়েকটি সড়ক দুর্ঘটনার মতো অমানবিক অঘটন পত্রিকান্তরে ঝড় তুলেছে। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া আদৌ কি সম্ভব। এই অনাকাক্সিক্ষত অঘটনে অকালে চলে যাওয়া কিংবা পঙ্গুত্ব বরণ করে জীবনের রঙিন খেলায় পিছিয়ে পড়া মানুষগুলো শুধু নীরবে কেঁদেই চলেছেন। বেঁচেও মরে থাকার অভিমানী ক্লেশ সর্বদা তাড়িত করছে তাদের। অঙ্গহীন অভিমানে পুড়ছেন তিনি যিনি দুর্ঘটনার শিকার। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে নিজেকে নিভৃত রাখার চেষ্টা করছেন। কেউ খাওয়াতে চাইলে রাগে-ক্ষোভে কথা বলছেন। অভিমানী স্বরে প্রশ্ন ছুড়ছেন, খেয়ে কি হবে, বেঁচে থেকেই বা কী লাভ? হাতহারা দুর্বিষহ যন্ত্রণায় কাতর মানুষটি দানাপানি ছেড়ে ভেতরের প্রলয়ঙ্করী জীবন অতিষ্ঠ বোধশক্তির গতিসম্পন্ন রেশ উন্মুক্ত করতে চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যর্থ প্রচেষ্টা। শহরে পড়ালেখা করতে আসা ছাত্রত্বের মেধা যাচাই, মেধাবী অস্তিত্ব ও অস্থিত্বে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা পরিবারের সচ্ছলতা টিকিয়ে রাখতে একটি কর্মপন্থা বেছে নিয়ে যখন আত্মসমৃদ্ধির পথ খুঁজছিলেন ঠিক তখনই আচমকা ধেয়ে আসল সড়কের দুর্ঘটনা নামক দানব। একটি সুস্থ ও সুন্দর স্বপ্নমাখা শরীরে বসিয়ে দিল মরণকামড়। দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিল ডান হাত। বলছিলাম ৩ এপ্রিল সড়ক দুর্ঘটনায় হাত হারানো তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীব হোসেনের কথা। রাজধানীর সার্ক ফোয়ারার কাছে বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের দুই বাসের রেষারেষিতে হাত হারান মুমূর্ষু রাজীব। বাসের চাপায় তার ডান হাত কনুইয়ের ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেই বিচ্ছিন্ন জীবনে তিনি বেঁচে থাকার সাধ হারিয়ে ফেলেছেন। এই হারিয়ে ফেলা আর কতদিন মানুষকে অভিমান, যন্ত্রণা ও কষ্টে পোড়াবে? মাতৃদেহ স্বচক্ষে পিষ্ট হতে দেখেছে পুত্র। ঘাতক বাস প্রাণপণে ঠেলে মাকে বাঁচানোর অসহায় প্রচেষ্টা শুধু কান্নাই উপহার দিয়ে গেল। বিনিময়ে বেপরোয়া বাস কেড়ে নিল জন্মধাত্রী জননীর জীবন। চাচার মৃত্যুর সংবাদ শুনে টাঙ্গাইল থেকে ময়মনসিংহ ঈশ্বরগঞ্জের মাইজবাগের বাসায় ছুটে গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তুহিন। ৫ এপ্রিল সেখান থেকে মাকে নিয়ে যাচ্ছিল গ্রামের বাড়ি আবদুল্লাহপুরে। কিন্তু গ্রাহ্যহীন চালকের নিষ্ঠুরতায় এক শোকের সঙ্গে যুক্ত হলো আরেক শোকার্ত ক্ষত। দুর্ঘটনার এমন পৈশাচিক তৎপরতা পুত্র তুহিনকে শোকসাগরে ভাসিয়ে দিয়ে গেল মাতৃহীনতার যন্ত্রণায়। অন্যদিকে মায়ের কাছে বিস্কুটের বায়না ধরা শিশুকন্যার চাওয়া পূরণ করতে পারেননি এক হতভাগা মা। রাস্তার ওপাশের দোকানে যেতে কন্যাশিশুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মা-মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে কেড়ে নিল প্রাণপ্রিয় সন্তানের জীবন। ৪ এপ্রিল খুলনা নগরীর খালিশপুরে আলমনগর পোড়া মসজিদের সামনের সড়কে একটি বিআরটিসি বাস ধাক্কা দিলে মা শিমুল আক্তার ও মেয়ে তামিমা আক্তার তন্বী ছিটকে পড়েন রাস্তায়। এতে মা শিমুল মারাত্মক আহত হলেও ঘটনাস্থলেই মারা যায় ছোট্ট তন্বী। এ যেন প্রতিদিনকার সংবাদ। সড়কে এমন দুর্ঘটনা নিত্য নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে পথচারীর জীবনে। পথে পথে ঝড়ছে প্রাণ। শূন্য বুকের আর্তনাদ-আহাজারি স্বজনহারা মানুষকে দিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘ জীবনে বয়ে চলার গভীর দুঃখবোঝা। এই কষ্টগাথা দুর্ঘটনা বিপর্যয় কি চলতেই থাকবে। সড়ক দুর্ঘটনার অসহনীয় সংবাদ মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। যাত্রা পথে যাত্রীর প্রাণে জন্ম দিচ্ছে উৎকণ্ঠা। দুর্ঘটনার ভয়াবহ সংবাদ সকলকে অস্থিরতার দিকে ধাবিত করছে। দিন দিন দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বাড়ছে বৈ কমছে না। বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার হিসাবে, দেশে প্রতিদিন গড়ে দুর্ঘটনায় সড়ক-মহাসড়কে ১১ জনের প্রাণহানি ঘটছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৭ সালে আগের বছরের চেয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় ২২ শতাংশ প্রাণহানি বেড়েছে। নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর তথ্যানুসারে ২০১৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে ৫ হাজার ৬৪৫ জনের। সংস্থাটির হিসাবে, ২০১৬ সালের চেয়ে দেড় হাজার মৃত্যু বেড়েছে ২০১৭ সালে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, ২০১৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ২ হাজার ৩৯৪ জনের। আর যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাবে এই সংখ্যা ৮ হাজার। সড়ক দুর্ঘটনায় যখন-তখন বলী হচ্ছে জলজ্যান্ত তরতাজা দেহ। বাস্তবতা নিরিখে সামাজিক ব্যাধির এ ভয়ঙ্কর রূপ নিরসনে কোন তুষ্টিদায়ক লক্ষণ নেই। যত দিন যাচ্ছে প্রতিযোগিতা দিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনার মাত্রা। এ ভয়াবহ রশি টেনে ধরার সাহস যেন কারও নেই। দেশব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনায় যে মানুষ মারা যাচ্ছে তার শূন্যতা পূরণ হবে কীভাবে? অকালে ঝরে যাওয়া এসব প্রাণের বিয়োগব্যথা আস্তে আস্তে নির্মূল হলেও অচল হওয়া পরিবারের ভার বয়ে বেড়ানো মানুষটির শূন্যস্থান পূরণে হিমশিম খাওয়া স্বজনের আজীবন যন্ত্রণা কতটা কঠিন তা কেবল তারাই বলতে পারবেন। দুর্ঘটনায় নিহতদের বেশিরভাগই কর্মক্ষম। তাই নিহত পরিবারে নেমে আসছে অনিশ্চয়তা। প্রতিদিন বহু পরিবার এ অন্ধকারে যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু এ থেকে মুক্তির উপায় কি? অনাকাক্সিক্ষত অঘটনের কবলে পড়ে অনেক জীবন চলে গেছে জীবনের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগেই। আর সেই যন্ত্রণা রেখে গেছে আজীবন। সঙ্গী হয়েছে নীরব কান্না। কিন্তু কেন এই জীবন্ত প্রাণবধের অহেতুক প্রতিযোগিতা? প্রশ্নটা যদি রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের জিজ্ঞেস করা হয় তাহলে উত্তরটা কী হতে পারে। উত্তর যাই হোক বাস্তবতা বলছে, একের পর এক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে এবং সেখানে পতিত হচ্ছে অসংখ্য তাজা প্রাণ। এর কারণ খুঁজতে গেলে সবার আগে বেরিয়ে আসবে চালকের অদক্ষতা এবং বেপরোয়া চালনা। অঘটনের কারণ জানতে গিয়ে দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চালকই সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম আসামি। যে চালকের খামখেয়ালিপনায় অকালে নিভে যাচ্ছে অসংখ্য জীবনপ্রদীপ, সেই চালকের কী হচ্ছে? সংবাদ মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনা যেভাবে সস্তা সংবাদের পথ্য যুগিয়ে যাচ্ছে তার ক’টি সংবাদ আছে যে, কোন দুর্ঘটনার জন্য চালকের শাস্তি নিশ্চিত করতে পেরেছে রাষ্ট্র। এখন পর্যন্ত দুর্ঘটনায় পতিত যানের কারণ অনুসন্ধানের সঠিক তদন্ত রিপোর্ট প্রদর্শন কিংবা দোষী চালকের শাস্তি নিশ্চিতে আশাজাগানিয়া সংবাদ কারও চোখে পড়েছে বলে মনে হয় না। সড়ক-মহাসড়কগুলোয় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনা। অনাকাক্সিক্ষত এ অঘটন রোধে রাষ্ট্রকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে দুর্ঘটনার আসল কারণ। এর জন্য শুধু চালক নয়; আরও অন্য কারণ থাকতে পারে। চালকের ওপর একতরফা দোষ চাপিয়ে বাকি ত্রুটিগুলো মাটিচাপা দিলে সেটা হবে অপ্রতিরোধ্য অঘটনে আরেকটু সুযোগ তৈরি করে দেয়া। তাই সব ক্ষেত্রে নজর দিতে হবে। যেমনÑ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য সাতটি সাধারণ কারণ শনাক্ত করেছে জাতীয় কমিটি। সেগুলো হলোÑ বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ, নিয়মভঙ্গ করে ওভারলোডিং ও ওভারটেকিং করার প্রবণতা, চালকদের দীর্ঘক্ষণ বিরামহীনভাবে গাড়ি চালানো, ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করা, ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চলাচল বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগের ঘাটতি এবং ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক ও চলাচলের অনুপযোগী সড়ক। ভাবতে হবে মানুষের জীবন নিয়ে। জীবন কোন কচুপাতার পানি নয়, নাড়া দিলাম আর ঝরাত করে মাটিতে পড়ে গেল। ব্যস এখানেই জীবনের পরিসমাপ্তি। স্মরণে রাখা ভাল, একটা জীবন একটি পরিবারকে নেতৃত্ব দেয়। তার ভরণপোষণে চলে পরিজন, চলে সংসার। এমন পরিস্থিতিতে যদি পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিটি অসময়ে সড়ক দুর্ঘটনার বলি হয় তাহলে কী হবে? এতে রাষ্ট্র বা সমাজ কেউই কোন সন্তোষজনক সমাধান দিতে পারবে না। যে চলে যায় সে আর ফিরে আসে না। সেটা হোক স্বাভাবিক মৃত্যু কিংবা অস্বাভাবিক মৃত্যু। মৃত্যু সবাইকে কাঁদায়। তবে সড়ক দুর্ঘটনার মতো অস্বাভাবিক মৃত্যু সবচেয়ে বেশি পীড়াদায়ক। সেই মৃত্যুতে যেমন দুঃখ থাকে, তেমনি থাকে সারা জীবনের ক্রন্দন ক্ষত। যে যাতনা জীবনের শেষ ভাগ পর্যন্ত তাড়িয়ে বেড়ায়। যারা সড়ক দুর্ঘটনার মতো অঘটনের পাল্লায় পড়ে অকাল প্রয়াত হয়েছেন তারা হয়ত মরে গিয়েও বেঁচে গেছেন। আর যারা আহত হয়ে পঙ্গু অবস্থায় জীবন পার করছেন তারা অনেকটা অর্ধমৃতরূপে টিকে আছেন এ জীবন-সংসারে। এই বাঁচা-মরার দুরন্ত গতি থামানোর শুভ শক্তি এ দেশে আছে কিনা তা কারও জানা নেই। তবে এটা পরিষ্কার যে, বিশ্বের সব দেশে কম-বেশি সড়ক দুর্ঘটনা হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের মতো এমন অসম প্রতিযোগিতা অর্থাৎ নিয়মিত সড়ক দুর্ঘটনার নজির হয়ত কোথাও নেই। আর থাকবেই বা কিভাবে! এদেশের যানবাহনে চালকের আসনে দক্ষ চালক কিংবা নিয়মনীতি মেনে যানবাহন পরিচালনার নজির কমই আছে। যতদিন পর্যন্ত যোগাযোগ ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সড়ক-মহাসড়কগুলোয় যান চলাচলের ওপর কঠোর নিয়মতান্ত্রিকতা বজায় না থাকবে ততদিন পর্যন্ত এমন অঘটনের বলি হতে হবে সাধারণ মানুষকে। লেখক : গবেষক [email protected]
×