ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

যৌথ ইশতেহারে সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত

রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিন ॥ রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহারে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী অপরাধীদের বিচার করতে হবে -কমনওয়েলথ

প্রকাশিত: ০৮:৪৪, ২১ এপ্রিল ২০১৮

রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিন ॥ রাখাইনে রোহিঙ্গাদের  ওপর গণহারে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী অপরাধীদের বিচার করতে হবে -কমনওয়েলথ

উত্তম চক্রবর্তী, লন্ডন থেকে ॥ দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরির জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে বাংলাদেশ সহযোগিতা করতে চায় বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণ পরিবেশে আমরা যেন ভাল পড়শী হিসেবে পাশাপাশি থাকতে পারি এবং নিজেদের জনগণের কল্যাণে গঠনমূলক নীতি অনুযায়ী কাজ করতে পারি। শুক্রবার স্থানীয় সময় বিকেলে ব্রিটিশ রাজপ্রসাদ উইন্ডসর ক্যাসেলে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সরকার প্রধানদের সম্মেলনে রিট্রিট সেশসে দেয়া বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। সেশনে সভাপতিত্ব করেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে। শুক্রবার দুই দিনব্যাপী ২৫তম কমনওয়েলথ সম্মেলনের শেষ দিনে গৃহীত যৌথ ইশতেহারে রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে। এতে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহারে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী অপরাধীদের স্বাধীন তদন্ত প্রক্রিয়ায় জবাবদিহিতার আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে কমনওয়েলথ। জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক সংস্থা ইউনাইটেড ন্যাশনস হাইকমিশন ফর রিফিউজির মাধ্যমে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকদের টেকসই প্রত্যাবর্তনের আহ্বান জানান কমনওয়েলথ দেশগুলোর প্রধানরা। লন্ডনের স্থানীয় সময় রাত সাড়ে সাতটায় এক প্রেসব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক প্রেস ব্রিফিংকালে যৌথ ঘোষণার ৫০ অনুচ্ছেদে রোহিঙ্গা ইস্যুটি স্থান পাওয়ার কথা জানান। তিনি জানান, সমাপনী দিনে ৫৩টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা নতুন কমনওয়েলথ গড়ার সর্বসম্মত অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। তিনি জানান, সম্মেলনের সমাপনী দিনে অন্যান্য কাজের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুক্রবারও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ কয়েকটি দেশের সরকার প্রধানের সঙ্গে কথা বলেছেন। ব্রিফিংকালে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিমও উপস্থিত ছিলেন। রোহিঙ্গাদের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিচার চায় কমনওয়েলথ ॥ কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে সমাপনী দিনে গৃহীত যৌথ ইশহারে রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি অনুচ্ছেদ সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে। এতে স্বাধীন তদন্ত প্রক্রিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী অপরাধের তদন্ত প্রক্রিয়ায় জবাবদিহিতার আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে কমনওয়েলথ। সর্বসম্মতভাবে গৃহীত যৌথ ঘোষণায় বলা হয়, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া এক মিলিয়নের বেশি রোহিঙ্গাদের প্রতি কমনওয়েলথ সদস্য দেশের সরকার প্রধানদের পক্ষ থেকে পূর্ণ সংহতি জানানো হয়। অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়া বাস্তুচ্যুত এ জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশের প্রশংসা করার পাশাপাশি কমনওয়েলথ রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানগণ সব ধরনের সহিংসতা বন্ধ করা ও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার আহ্বান জানানো হয়। একইসঙ্গে স্বাধীন তদন্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গণহারে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। যৌথ ঘোষণায় আরও বলা হয়, জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক সংস্থা ইউনাইটেড ন্যাশনস হাইকমিশন ফর রিফিউজির মাধ্যমে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকদের টেকসই প্রত্যাবর্তনের আহ্বান জানান কমনওয়েলথ। নিরাপত্তা ও সম্মানের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমিতে টেকসই প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ তৈরির আহ্বান জানান তারা। কমনওয়েলথ রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা রোহিঙ্গা সঙ্কটেনর মূল কারণ খুঁজে বের করা এবং শীঘ্রই রাখাইন এ্যাডভাইজরি কমিশনের (কফি আনান কমিশন) সুপারিশ বাস্তবায়নের তাগিদ দেন। উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে মিয়ানমারের চুক্তির কথা উল্লেখ করে কমনওয়েলথ রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানগণ রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবর্তন শুরু করার কথাও বলেন। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার সমাজে সমান সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কথাও বলেন তারা। বিভিন্ন সেশনে প্রধানমন্ত্রী যা বলেন ॥ সেশনের ৪ নম্বর এজেন্ডা ‘কমনওয়েলথ সচিবালয় পরিচালনা ও অর্থায়ন’ বিষয়ে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর স্বার্থে কাজ এগিয়ে নিতে আমরা সচিবালয়ের ভূমিকাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখি। আমরা মনে করি, সদস্য দেশগুলোর যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গিও এক্ষেত্রে সমান গুরুত্বপূর্ণ। কমনওয়েলথ সচিবালয় পরিচালনার অর্থায়নের প্রশ্নে হাই লেভেল গ্রুপের পর্যালোচনার প্রেক্ষাপট থেকে কিছু বলতে চাই। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি প্রস্তাব তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রথমত হাই লেভেল গ্রুপকে হতে হবে আরও বেশি প্রতিনিধিত্বমূলক, যেখানে কমনওয়েলথের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সদস্য রাষ্ট্র থাকবে। বোর্ড অব গবর্নসের সঙ্গে উন্মুক্ত আলোচনার মাধ্যমে সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে বিস্তৃত পরামর্শের জন্য কর্মকৌশল থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, উদ্ভাবনী উপায়ে অর্থায়নসহ পৃথক অর্থায়নের কর্মকৌশল ও বিকল্প নির্ধারণে হাই লেভেল গ্রুপ নজর দিতে পারে। তৃতীয়ত, বেসরকারী খাতের অংশীদারিত্ব ও প্রকল্প সহ-অর্থায়ন আরেকটি বিকল্প উপায় হতে পারে। আলোচনার পঞ্চম এজেন্ডা ‘বৈশ্বিক প্রেক্ষিত’ নিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তার অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, প্রথমত আরও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও যোগাযোগ গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমি যোগাযোগ বিষয়ের ঘোষণার (ডিক্লারেশন অন কানেক্টিভিটি) খসড়াকে স্বাগত জানাই। আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরির জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে সহযোগিতা করতে চাই, যেখানে আমরা ভাল পড়শী হিসেবে পাশাপাশি থাকতে পারব এবং নিজেদের জনগণের কল্যাণে গঠনমূলক নীতি গ্রহণ করব। কমনওয়েলথে যোগাযোগের আলোচনা গুরুত্ব পাওয়ায় সাধুবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যোগাযোগকে আমরা বিস্তৃত পরিসরে দেখি। আমরা মতামত, জ্ঞান, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি, সড়ক-রেল-আকাশ, পণ্য, সেবা ও বিনিয়োগের যোগাযোগে বিশ্বাসী। নিয়ম মেনে বাণিজ্যিক যোগাযোগ এবং স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও সুস্থ বহুজাতিক বাণিজ্যিক কার্যক্রম সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ‘এই জায়গা থেকে বাংলাদেশ তার পড়শী ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে মিলে উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা যোগাযোগ বিষয়ক কর্মসূচীর দ্রুত বাস্তবায়ন পরিকল্পনাকে বিশেষভাবে দেখি এবং কমনওয়েলথ অংশীদারদের বহুখাতের অবকাঠামোগত প্রকল্প নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানাই। সাইবার ইস্যু বিষয়ে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাইবার জগতে আমরা যেমন সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি, তেমনি চ্যালেঞ্জের মুখেও পড়তে হচ্ছে। সেজন্য একদিকে আমাদের প্রয়োজন অবাধ, বহুমুখী ও নিরাপদ ইন্টারনেট নিশ্চিতে কাজ করা। পাশাপাশি দরকার সাইবার আক্রমণের ঝুঁকি এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে জঙ্গীবাদ ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে কাজ করা। এটা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে আমাদের সরকারের নীতি ‘জিরো টলারেন্স’। সেই অবস্থান থেকে আমরা কমনওয়েলথ সাইবার ডিক্লারেশনকেও স্বাগত জানাই। এই ডিক্লারেশনে সাইবার জগত দেখভালে যে নীতি ও দিক-নির্দেশনা রয়েছে, তাও তাৎপর্যপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতের উন্নয়ন বাংলাদেশের জাতীয় অগ্রাধিকার। আমরা এরইমধ্যে নিজেদের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার ভিশন বাস্তবায়ন করেছি। আমরা মনে করি, অবাধ আইসিটি খাত এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে সক্ষমতা তৈরি ডিজিটাল বিভাজন কমানোর মৌলিক শর্ত, একইভাবে এটা দারিদ্র্য নির্মূলীকরণ, টেকসই উন্নয়ন অর্জন ও অংগ্রহণমূলক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী কমনওয়েলথ সচিবালয়কে ডিক্লারেশনটির দ্রুত বাস্তবায়নের আহ্বান জানান। কমনওয়েলথ সংস্কারের পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের কমনওয়েলথ সম্মেলনের প্রতিপাদ্য ভবিষ্যতের কথা বলে, জনগণের মঙ্গলজনক ভবিষ্যতের কথা বলে। সেকেলে পরিকল্পনার উপর চলতে থাকা সংগঠনের বর্তমান যে অবস্থা ও সক্ষমতা, তা আমাদের প্রত্যাশা পূরণের জন্য অপর্যাপ্ত। তাই, আমাদের এ সংস্থাকে প্রত্যাশার দিকে রূপান্তর করতে হবে, সেটা হতে পারে পুনর্বার যাত্রাও। এ ক্ষেত্রে আরও তিনটি প্রস্তাব উত্থাপন করে বাংলাদেশের সরকার প্রধান বলেন, এক, কমনওয়েলথ উন্নয়ন তহবিল এবং এসডিজি অর্জনে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য প্লাটফর্ম গঠন, দুই, রাজনৈতিক মূল্যবোধের সুরক্ষা ও প্রচারে কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এ্যাসোসিয়েশনের ভূমিকা আরও জোরদার করা এবং তিন, প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বদের নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ মহল গঠন। ব্রিটেনের রানীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা বিনিময় ॥ ২৫তম কমনওয়েলথ সম্মেলনে রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সভায় অংশগ্রহণ উপলক্ষে লন্ডনে থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে। বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় রাতে লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেসে রানীর সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন প্রধানমন্ত্রী। পরে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল হক সাংবাদিকদের একথা জানান। রানী এলিজাবেথ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রিন্স চার্লসের সঙ্গেও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী কমনওয়েলথ অন্যান্য সদস্য দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সঙ্গে রানীর দেয়া নৈশভোজে যোগ দেন। এছাড়া শুক্রবার সকাল থেকে লন্ডনের উইশোর ক্যাসের স্টেন্ট জর্জ হলে অন্যান্য রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সঙ্গে রিট্রিট সেশনে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার সকালে ৫৩টি দেশের নেতাদের অংশগ্রহণে ২৫তম কমনওয়েলথ সম্মেলনের উদ্বোধন করেন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ।
×