ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

'আমার শিক্ষক আমাকে আত্মহত্যা থেকে বাঁচিয়েছেন'

প্রকাশিত: ১৮:৫৩, ২১ এপ্রিল ২০১৮

 'আমার শিক্ষক আমাকে আত্মহত্যা থেকে বাঁচিয়েছেন'

অনলাইন ডেস্ক ॥ মাত্র ১৬ বছর বয়সেই নিজের জীবন নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন হাটি স্পারে নামে এক ব্রিটিশ কিশোরী। হয়তো সে আবারও চেষ্টা করতো, হয়তো সফলও হতো, যদি না একজন শিক্ষক তার এই মানসিক টানাপোড়েন টের পেতেন। এই জীবন ফিরে পাওয়ার জন্য হাটি তার সেই শিক্ষকের কাছে ঋণী। এখন হাটির বয়স ২৬, কাজ করছেন একজন শিক্ষাণবিশ শিক্ষক হিসেবে। তার লক্ষ্য, আজকের কিশোর কিশোরীদের আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে বের করে আনা। তিনি বলেন, "আমি হয়তো বার বার আত্মহত্যার চেষ্টা করে যেতাম। তখন হয়তো আমার পরিস্থিতি আমার তিন বন্ধুর মতোই হতো। যারা ২০ বছর বয়সের মাথায় জীবনকে বিদায় জানিয়েছে।" কি কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা আকড়ে ধরেছিলো হাটিকে? এমন প্রশ্নের উত্তরে জানা যায়, ছোটবেলায় বাবা মায়ের বিচ্ছেদের পর হাটি মায়ের সঙ্গেই থাকতেন। কিন্তু মায়ের অসুস্থতা সেইসঙ্গে কারো মনযোগ না পাওয়া তার ছোট্ট মনকে বিষিয়ে তুলেছিলো। হাটি বলেন, "মা অসুস্থ থাকায় সবাই তাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতো। আমি কিভাবে এই পরিস্থিতিতে টিকে আছি, আমার কেমন লাগছে, আমার মানসিক অবস্থা কি কেউ জানতে চায়নি। এসব কারণে ১৪ বছর বয়সেই আমাকে বিসন্নতা গ্রাস করে। সব সময় মন ভীষণ খারাপ থাকতো, ঘুমাতে পারতাম না, এই হতাশা বেড়েই যাচ্ছিলো।" সে বছর ছিল হাটির জিসিএসই পরীক্ষা। এ নিয়ে প্রস্তুতি চলার মধ্যেই স্কুল প্রাঙ্গনে হাটির সঙ্গে দেখা করেন তার ডিজাইন ও প্রযুক্তি কোর্সের শিক্ষক। জিজ্ঞেস করেন সে কেমন আছে? সব ঠিক আছে কিনা। তিনি যেন দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন, এই মেয়েটি তার নিজের মধ্যে নেই। তারপর একে একে নিজের সব কথা জানান হাটি। "সেই প্রথম আমি কাউকে আমার কথাগুলো জানাই। তিনি আমার সব কথা মনযোগ দিয়ে শুনলেন। এক পর্যায়ে আমি কাঁদতে থাকি। তিনি আমাকে থামাননি, আমার কথার মাঝখানে কোন কথা বলেননি, প্রশ্ন করেননি, আমি যেন অনেকটা নিজের সঙ্গেই নিজে কথা বলছিলাম, যেটা আগে হয়নি। তিনি শুধু শুনে গেছেন। তার এই নিস্তব্ধতা, উদারতা আমার ভেতরে সাহস জুগিয়েছে।" সেই থেকে হাটি স্কুলের ভেতরে বাইরে পুরো সময়টা তার পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মানসিক বিসন্নতার বিরুদ্ধে আর পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে সমান তালে চালিয়ে যান তার যুদ্ধ। এভাবে সফলতার সঙ্গে তিনি জিসিএসসি এবং "এ" লেভেল পাস করেন। এরপর কিছু সময় চাকরি করেন। পরে ফ্যাশন ও টেক্সটাইলে ডিগ্রী নেন। একদিন বিয়ে করেন পছন্দের মানুষটিকে। স্বামী আর সেই স্কুল শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় শিক্ষকতা পেশাকে বেছে নেন হাটি। এখন তিনি কাজ করছেন ডিজাইন ও প্রযুক্তি কোর্সের শিক্ষাণবিশ শিক্ষক হিসেবে। ঠিক তার প্রিয় শিক্ষকের মতো।তার লক্ষ্য প্রতিটি শিশুর জীবনে ভরসা হয়ে পাশে থাকা। শিক্ষকতার প্রশিক্ষণ চলাকালীন হাটি বুঝতে পারেন, সেখানকার কয়েকজনের অবস্থা তার সেই বিসন্ন কৈশোরবেলার মতো। তারপর তিনি অবসরে তাদেরকে সময় দিতে শুরু করেন, তাদের পাশে দাঁড়ান। "চুল অসমান করে ছাটা, হাত কচলানো, কোন একটা হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। এসব দেখে বুঝতাম তারা আমার মতো নিজের ক্ষতি করতে চাইছে। তারপর থেকেই আমি তাদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করি। নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানাই। তবে কখনোই তাদের কিছু নিয়ে চাপ দেইনি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে আমার দারুণ আলাপ হতো।" একপর্যায়ে হাটি চোখের সামনে দারুণ সব পরিবর্তন দেখতে শুরু করেন। অনেকেই নামে বেনামে চিঠি লিখে তাদের কৃতজ্ঞতার কথা প্রকাশ করে। তারমধ্যে একটি চিঠিতে লেখা ছিলো। "আপনি আমাকে যে সাহায্য করেছেন, সেটা আপনার ধারণার বাইরে, আপনি একজন দারুণ শিক্ষক। হাটি বলেন, "এই চিঠিটা যতোবার পড়ি, চোখ ভিজে আসে।" বয়:সন্ধিকালের বিসন্নতা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, বিশ্বের প্রতি ৫ জনের মধ্যে ১ জন কিশোর/কিশোরী মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগে। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্তদের মধ্যে অর্ধেকের সমস্যা শুরু হয় ১৪ বছর বয়সে যা ১০ বছরের মাথায় ভয়াবহ আকার নেয়। গত বছর যুক্তরাজ্যের ১০ হাজার কিশোর কিশোরীর ওপর এক সরকারি জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে। এক তৃতীয়াংশ কিশোরী এবং প্রতি ১০ জন কিশোরের মধ্যে একজন ১৪ বছর বয়স থেকেই অবসাদে ভোগে। দারিদ্র্যদের মধ্যে এই হার সবচেয়ে বেশি। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতেও তাদের দেরী হয়ে যায়। একারণে প্রতিটি স্কুলে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানানো হয় সংস্থাটির পক্ষ থেকে। বিসন্নতার লক্ষণ •সব সময় মন খারাপ, উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত থাকা। •অসহায়বোধ, আশাহীনতায় ভোগা। •আত্মবিশ্বাসের অভাব। •অপরাধবোধ বা সব বিষয়ে নিজেকে দোষারোপ করা। •অল্পেই কেঁদে ফেলা, খিটখিটে মেজাজ, কাউকে সহ্য না হওয়া। •সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা। •আত্মহত্যা বা নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা। লক্ষণ বুঝে সঠিক সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলেই আক্রান্তকে দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। হাটি এখন বোঝেন ১০ বছর আগে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে দেখে তার সেই শিক্ষকের কেমন লেগেছিলো। হাটির আশা তিনি যে সহায়তা পেয়েছেন এবং নিজে যা চেষ্টা করছেন তার ছাত্র/ছাত্রীরা একই কাজ করবে অন্যদের প্রয়োজনে। "একটা শিশুকে কেমন আছো জিজ্ঞেস করা খু্ব সাধারণ শোনালেও এর যে কতো শক্তি আছে তা আমাদের ধারণার বাইরে। তাদের বারবার প্রশংসা করা, গুরুত্ব দেয়া, ভালবাসি বলা। এই কথাগুলো একটা মানুষকে সারাজীবনের জন্য বদলে দিতে পারে।" বলেন জীবন জয় করা হাটি। সূত্র- বিবিসি বাংলা
×