ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শান্তা ফারজানা

একটি হাতও আর হারাতে চাই না

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ২৩ এপ্রিল ২০১৮

একটি হাতও আর হারাতে চাই না

গত ৩ এপ্রিল দুপুরে বিআরটিসির একটি দোতলা বাসের পেছনের ফটকে দাঁড়িয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে যাচ্ছিলেন মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতকের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাজীব হোসেন। বাসটি হোটেল সোনারগাঁওয়ের বিপরীতে পান্থকুঞ্জ পার্কের সামনে পৌঁছলে হঠাৎ পেছন থেকে স্বজন পরিবহনের একটি বাস বিআরটিসি বাসটির গা ঘেঁষে অতিক্রম করে। দুই বাসের প্রবল চাপে গাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা রাজীবের হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ওই ঘটনার পর পথচারীরা রাজীবকে পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে ভর্তি করেন। এরপর তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেয়া হয়। রাজীবের বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড় ছিলেন। পড়ালেখার পাশাপাশি একটি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার টাইপ করে তিনি নিজের এবং ছোট দুই ভাইয়ের খরচ চালাতেন। ১৩ দিন পর রাজীবের মৃত্যুতে বিআরটিসি বাসের চালক অহেদ আলী ও স্বজন বাসের ড্রাইভার খোরশেদকে দুই দিনের রিমান্ডে পাঠায় আদালত। পরে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনায় মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে এবং আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করছে। সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে রোজ যত লোক প্রাণ হারান বা জখম হন, সেই পরিসংখ্যান শিউরে ওঠার মতো। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে বা বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা প্রতিষ্ঠান এআরআইএর হিসেবে গত দশ বছরে বাংলাদেশে ২৯ হাজার ৪৩২টি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ২৬ হাজার ৬৮৬ জন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ২১ হাজার ৫৪৮ জন। জাতিসংঘে বাংলাদেশসহ সদস্যদেশগুলো অঙ্গীকার করেছিল ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। সেভ দ্য রোড-এর রিসার্চ সেলের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় দিনে গড়ে ২৫ জন মারা যান। অবশ্য পুলিশের হিসাবে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান গড়ে ৬ জন। রিসার্চ সেলের তথ্যানুযায়ী, গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৮ হাজার ৬৪২ জন। আহত হয়েছেন ২১ হাজার ৮৫৫ জন। এর মধ্যে বাস দুর্ঘটনা এক হাজার ২৪৯টি, ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান দুর্ঘটনা এক হাজার ৬৩৫টি, হিউম্যান হলার ২৭৬টি, কার-জিপ-মাইক্রোবাস ২৬২টি, অটোরিকশা এক হাজার ৭৪টি, মোটরসাইকেল এক হাজার ৪৭৫টি, ব্যাটারিচালিত রিক্সা ৩২২টি ও নছিমন-করিমনে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৮২৪টি। এসব দুর্ঘটনার হিসাব রাখে বাংলাদেশ পুলিশ। বর্তমানে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা মহামারী আকার ধারণ করেছে। দুর্ঘটনার অনেক কারণ থাকে। তবে চালক-সর্বস্ব চিন্তাটা প্রকৃত কারণ না। এটা উপসর্গ। চালকের যেমন ভুল আছে, তেমনি বিআরটিএর ভুল আছে, যারা সড়ক নির্মাণ করেন তাদের গাফিলতি ও ভুল আছে এবং এখানে যারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ মালিকেরও ভুল আছে। তারপর অনেক গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট নাই। ফিটনেস দেখানোর দায়িত্ব মালিকের, চালকের নয়। এদিকে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় সর্বোচ্চ সাজা তিন বছর কারাদ-। জানা যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ শাস্তি দুবছর। আর যুক্তরাজ্যে সর্বোচ্চ সাজার মেয়াদ ১৪ বছর পর্যন্ত। কিন্তু বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার মামলায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির খুবই কম। প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা এবং বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানির পরও বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তায় কার্যকর উদ্যোগে ঘাটতি রয়েছে। এ ছাড়া দুর্ঘটনায় দায়ীদের সাজা দিতে কঠোর আইন এবং এর প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে জাতিসংঘের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশ সই করেছে। বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব সড়ক পরিবহন, স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকারসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের। এসব মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, কোন বছর কত সড়ক দুর্ঘটনা কমানো হবে, এর কোন কর্মপরিকল্পনা এখনও হয়নি। উপরন্তু, অবহেলা-অবজ্ঞার মাঝে দিন দিন বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। বাড়ছে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হারিয়ে দরিদ্র ও ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা, যা মধ্যম আয়ের দেশে যাত্রার পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। মেধাবী ও কর্মক্ষম জনসম্পদ হারিয়ে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। সেভ দ্য রোড-এর রিসার্চ সেলের মতে, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য ফুটপাথ দখল, ওভারটেকিং, ওভারস্পিড ও ওভারলোড, হেলপার দিয়ে গাড়ি চালানো, রাস্তাঘাটের নির্মাণ ত্রুটি, গাড়ির ত্রুটি, যাত্রীদের অসতর্কতা, ট্রাফিক আইন না মানা, গুরুত্বপূর্ণ সড়কের ক্রসিংয়ে জেব্রা ক্রসিং না থাকা এবং জেব্রা ক্রসিং গাড়িচালক কর্তৃক না মানা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার করা, মহাসড়কে স্বল্পগতি ও দ্রুতগতির যান একই সঙ্গে চলাচল, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো এবং মহাসড়ক ক্রসিংয়ে ফিডার রোডের যানবাহন উঠে যাওয়াই দায়ী। বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে ২৩ লাখ যানবাহনের মধ্যে ফিটনেসবিহীন যানবাহন রয়েছে ৩ লাখের বেশি। আর যেসব যানবাহনের ফিটনেস আছে, সেগুলোও যথাযথভাবে নেয়া হয় না। কারণ, ৪০ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একটি যানবাহনের সনদ দেয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ খালি চোখে একটু দেখেই ফিটনেস দিয়ে দেয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফিটনেস সনদ দেয়ার যন্ত্র বিকল হয়ে আছে এক যুগ ধরে। দেশে চালকের লাইসেন্স আছে ১৬ লাখ। এরও একটা বড় অংশ দেয়া হয়েছে যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া, শ্রমিক ইউনিয়নের দেয়া তালিকা ধরে। অর্থাৎ প্রায় আট লাখ যানবাহনের কোন চালক নেই। অথচ বাণিজ্যিক যানবাহনের প্রতিটির জন্য দুজন চালক দরকার হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত তিন কারণে সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে। ওভারস্পিড, ওভারটেকিং, যান্ত্রিক ও রাস্তার ত্রুটি। সমস্যা যাই হোক সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস না পাওয়ার পেছনে রয়েছে নানা কারণ। চালকদের লাইসেন্স প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে যানবাহনের ফিটনেস সনদ, গাড়ির অনুমোদন, সড়কের ত্রুটি, সঠিক তদারকির অভাবসহ সকল ক্ষেত্রেই রয়েছে গলদ। দুর্ঘটনা রোধে সরকারীভাবে নেয়া সিদ্ধাসমূহও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কার্যকর হয় না। এক্ষেত্রে রয়েছে সমন্বয় ও পরিকল্পনার অভাব। অপরদিকে রাজীব হোসেনের মৃত্যুর জন্য পরিবহনের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী। তিনি বলেন, রাজীবের মৃত্যুর জন্য সড়ক ব্যবস্থাপনা দায়ী নয় বরং পরিবহন অব্যবস্থাপনার জন্য দুর্ঘটনাটি হয়েছে। চালকদের অসচেতনতা ও রেষারেষির কারণেই এটি হয়েছে। মূলত সরেজমিনে তদন্তপূর্বক চিহ্নিতকরণের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে ভবিষ্যতে সড়কসহ নৌপথ, রেলপথ এবং আকাশপথে সকল দুর্ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া যায়। অর্থাৎ তৃণমূল পর্যায়ে কারণ চিহ্নিত করে দুর্ঘটনার হার হ্রাস করা সম্ভব। কিন্তু এভাবে চিহ্নিত করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না ফলে ভবিষ্যতে একই ধরনের দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় এবং তা ‘আকস্মিক ঘটনা’ হিসেবেই রয়ে যায়। তাই ট্রাফিক আইন, মোটরযান আইন ও সড়ক ব্যবহার বিধি-বিধান সম্পর্কে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ও সাধারণের মধ্যে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। একই সঙ্গে টিভি-অনলাইন, সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সড়ক সচেতনতামূলক বা দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়াও জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশ থেকে হাট-বাজার অপসারণ, ফুটপাথ দখলমুক্ত করা, রোড সাইন (ট্রাফিক চিহ্ন) স্থাপন করা, জেব্রা ক্রসিং দেয়া, চালকদের পেশাগত প্রশিক্ষণ ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা, যাত্রীবান্ধব সড়ক পরিবহন আইন ও বিধিবিধান প্রণয়ন, গাড়ির ফিটনেস ও চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বাংলাদেশে দৈনিক ঘণ্টায় একজনেরও বেশি মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা বর্তমানে জাতীয় দুর্যোগে পরিণত হচ্ছে। উন্নত দেশগুলোতে নাগরিকের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। তেমনি নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের জবাবদিহিতাও রয়েছে। তাই সড়ক-নৌ-রেল-আকাশসহ সকল পথে নিরাপদ হোক জীবন, স্বস্তির হোক যাত্রা। লেখক : সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ-এনডিবি ও মহাসচিব সেভ দ্য রোড [email protected]
×