ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মারুফ রায়হান

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ২৪ এপ্রিল ২০১৮

ঢাকার দিনরাত

ঢাকার আবহাওয়া অনেকটা লন্ডনের মতো হয়ে গেছে। কীরকম? আগাম আন্দাজ করা কঠিন রোদ থাকবে নাকি বৃষ্টি হবে। খুঁতখুঁতে কেউ বৃষ্টি হবে ভেবে বাসা থেকে বেরুনোর সময় ছাতা সঙ্গে নিলেন। কিন্তু তিন চার ঘণ্টা থাকল খটখটে রোদ। অবশ্য ছাতা এমন একটা বস্তু যেটি রোদেও সমান কাজে লাগে। কিন্তু ওই যে বললাম, ভদ্রলোক খুঁতখুঁতে, তিনি রোদের জন্য ছাতা বহন করবেনÑ সেটা হতেই পারে না। বাংলাদেশ গ্রীষ্মপ্রধান দেশ, বলা যায় দশ মাসই গরম থাকে। চলতি বৈশাখে রোদের তেজ গনগনে। তারপরও রোদ থেকে বাঁচতে খুব সামান্য সংখ্যক পথচারীই ছাতা সঙ্গে রাখেন। শুধু রোদের কথাই বা বলি কেন, বর্ষাবাদলার দিনেও কয়ভাগ ঢাকাবাসী ছাতা নিয়ে ঘরের বাইরে বের হন? এটা কি বাঙালীর ফ্যাশন, মানে হাতে ছাতা রাখলে স্মার্টনেস নষ্ট হয়ে যাবে! নাকি উপেক্ষা, কিংবা উদাসীনতা? আর রেইনকোটের চল বুঝি শূন্যের কোঠায় নামতে বাকি নেই। বলেছি বটে রাজধানীর আবহাওয়া লন্ডনের মতো হয়ে গেছে। আসলে বলতে পারি হাফ লন্ডন। অন্তত গত সপ্তাহে পর পর কয়দিন রোদ-বৃষ্টির পালাবদল দেখে এটা বলা যেতে পারে। কখনো ঠা ঠা রোদ, তাপমাত্রা ত্রিশ ডিগ্রীর ওপরে উঠে যাওয়া। কখনোবা ঝুম বৃষ্টি। কয়েক ঘণ্টা পর তাতে বিরতি, তবে মেঘলা মেঘলা বাকিটা সময়। রোববার সন্ধ্যায় আকস্মিকভাবে ঝড় উঠলো। ধানমন্ডি এলাকার বেশ কিছু বড় বড় গাছ উপড়ে পড়লো। এত পথচলতি মানুষ, রিক্সারোহী আহত হলেন। এর আগেও ঝড়ে ধানমন্ডি এলাকার গাছ উপড়েছে। সেখানকার গাছগুলোর নিচের মাটি তাই নিরীক্ষা করা দরকার। নিচের মাটি নরোম থাকলে আবারও অল্প ঝড়ে গাছ উপড়ে বিপদ ঘটতে পারে। এলাকাবাসীর ঝুঁকি এড়াতে যথাযথ উদ্যোগ নেয়া জরুরি হয়ে উঠেছে। নিষ্ঠুর শহর থেকে গ্রামে করুণ প্রত্যাবর্তন এই নিষ্ঠুর শহর ঢাকায় যারা বসবাস করছেন তাদের সিংহভাগই ঢাকার বাইরে থেকে আসা। পড়ালেখা ও জীবিকার সন্ধানে যারা একবার এ শহরে আসে তাদের বড় একটা অংশ আর এখান থেকে ফিরে যায় না। অন্তত চেষ্টায় ব্যর্থ না হওয়া পর্যন্ত ঢাকার মাটি কামড়ে পড়ে থাকার উদাহরণ অজস্র্র। তাই ঢাকা যাকে অপ্রত্যাশিতভাবে সময়ের আগেই ফিরিয়ে দেয় তার জেন্য ঢাকা আরও নিষ্ঠুর নগরীর পরিচিতি পায়। গত সপ্তাহে রাজীব ঢাকা থেকে ফিরে গেছেন নিজ গ্রামে, তবে জীবিত রাজীব নয়। অপঘাতে তার মৃত্যু ছিল সারা দেশেরই আলোচিত একটি বিষয়। তার মরদেহ নিজ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছুানোর পর স্বজন ও গ্রামবাসীরা চোখের জল ফেলেছে। মুখে কাপড় চেপে এবং ডুকরে উঠে যারা কেঁদেছে তাদের ছবি খবরের কাগজে এসেছে। এমন ছবি আমাদের একদিকে আবেগাপ্লুত করে, অন্যদিকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। ৩ এপ্রিল কারওয়ান বাজারে বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের দুটি বাসের ধাক্কাধাক্কিতে বিআরটিসির বাসে থাকা রাজীবের একটি হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। মাথায়ও আঘাত লাগে। দুই সপ্তাহ ধরে চিকিৎসকরা অনেক চেষ্টা করেছেন রাজীবকে বাঁচাতে। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। লাইফ সাপোর্টে থাকা রাজীবকে চিকিৎসকরা ১৩ দিনের মাথায় মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর মৃতদেহ দাফনের জন্য পটুয়াখালীতে গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার আগে সুস্থ ও সচেতন প্রত্যেক মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়ে গেছেন রাজীব হোসেন। দেখিয়ে দিয়েছেন এই নগরীতে নাগরিকদের জীবন কত তুচ্ছ। বিবেকহীন কিছু গাড়িচালকের কাছে কেন এভাবেই নিভে যায় রাজীবদের মতো আরও অনেক প্রাণের স্বপ্ন! সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন রাজীব হোসেন। তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে তিনি মাকে হারান। আর বাবাকে হারান অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময়। মা-বাবাকে হারিয়ে তিনি ঢাকার মতিঝিলে এক খালার আশ্রয়ে চলে আসেন। এখানে থেকে লেখাপড়ার পাশাপাশি একটি কম্পিউটারের দোকানে খণ্ডকালীন চাকরিও করতেন রাজীব। সেই অর্থ দিয়ে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীতে পড়ুয়া দুই ভাইয়ের খরচও চালাতেন। স্বপ্ন দেখতেন ছোট দুই ভাইকে নিয়ে একদিন সুখের মুখ দেখবেন। কিন্তু বিবেকহীন দুই চালকের ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতা তাঁদের সেই স্বপ্ন চুরমার করে দিল। শুধু রাজীব নয়, বাসচালকদের এমন প্রতিযোগিতা এ পর্যন্ত কত যে স্বপ্ন চুরমার করেছে, তার কোন ইয়ত্তা নেই। উল্লেখ্য, গত ৪ এপ্রিল রাজীব হোসেনকে কেন এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। সেই রিট এখনও বিচারাধীন। রিটকারী আইনজীবী বলেছেন, রাজীবের মৃত্যু হলেও তিনি এই মামলা চালিয়ে যাবেন। মানুষ চায় রাজীবের ছোট দুই ভাই ক্ষতিপূরণের অর্থ পাক। চলন্ত বাসে নারী নিগ্রহের প্রতিবাদে চলন্ত বাসে নারী নিগ্রহের ঘটনা সমাজজীবনে শঙ্কা জাগায়। তবে এর পাশাপাশি প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের বিষয়টি জনমনে আশাবাদ তৈরি করে। এমনই একটি দৃষ্টান্ত মিললো গত সপ্তাহে। বলা যায়, দারুণ একটি ঘটনা ঘটে গেলো। মানুষ আগের মত চুপ থাকছে না, আস্তে আস্তে সচেতন হচ্ছে, প্রতিবাদ করতে শিখছে। উত্তরা-রামপুরা রুটের তুরাগ পরিবহনের কয়েকজন পরিবহনকর্মী উত্তরা ইউনিভার্সিটির এক ছাত্রীকে সেক্সুয়ালি হ্যারাজ করার অপচেষ্টা করছিলো, তরুণীটি চলন্ত অবস্থায় বাস থেকে লাফ দিয়ে আত্মরক্ষা করে। পরে ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে ঘটনা জানানোর পর প্রশাসন ও সহপাঠীরা উদ্যোগী হয়। রোববার সকাল থেকে তারা তুরাগ পরিবহণের বেশ কিছু সংখ্যক বাস আটকে চাবি নিয়ে রাখে। তাদেরকে পুলিশও সহযোগিতা করেছে, যেটা প্রশংসার দাবীদার। সবচেয়ে প্রশংসিত ব্যাপার হলো, ওরা একটা বাসও ভাংচুর করেনি কিংবা বাসের কোনোধরনের ক্ষতিসাধন করেনি! ওদের দাবি, অভিযুক্তদের শাস্তির আওতায় আনলেই বাসের চাবি দিয়ে দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে বাস কর্তৃপক্ষের সাথে উত্তরা ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষের বৈঠকও হয়েছে। আশা করা যায় অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা গেলেই বাস-মিনিবাসের চালক ও হেলপাররা মেয়েদের দিকে খারাপ দৃষ্টিতে তাকাতেও দ্বিতীয়বার ভাববে। মোড়ে মোড়ে তরমুজ! আমরা বারবার শুনছি- ঢাকা পৃথিবীর বসবাসের সবচেয়ে অযোগ্য শহর। কিন্তু শহরটা বাসযোগ্য রাখার জন্য দিন রাত কিছু মানুষ যে কাজ করে চলেছে, সেকথা সেভাবে আমরা বলি না, শুনিও না। কোথাও তাদের স্বীকৃতি নেই। স্বীকৃতি তাদের কাম্য নয়। কেউবা মুখ লুকান ক্যামেরা থেকে। দাবি একটাই, আড়ালে থেকে কাজ করতে চাই। আমাদের এক বন্ধু দিন কয়েক ধরে ঢাকার রাস্তায় কি কি ফলের গাছ আর পাখির বাসা আছে তার ছবি তুলেছেন। বেরিয়ে এসেছে অবাক হওয়ার মতো তথ্য। কি নেই ঢাকায়? এখনও আম, জাম, পেয়ারা লেবু, আমলকী, কাঁঠাল, কলা, জামরুল, বেতফল, কামরাঙ্গা, পেপে, তাল, নারিকেল, সুপারি, তেঁতুল, জলপাইসহ রয়েছে আরও কত গাছ। গাছগুলোয় ফল ধরে, অনেক ফল গাছেই পাকে। কিছু গাছে পাখির বাসাও আছে। এই রকম গাছ, ফল, ফুল দিয়ে বন্ধুটি এ্যালবাম করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে ফল, ফুল, গাছ থাকবে তো নিরাপদ? একটা পাখি যখন বটের ফল মুখে নিয়ে উড়াল দেয় তখন সে দৃশ্য দেখে অনেকেরই প্রাণ জুড়ায়। আর যিনি গাছটা লাগিয়েছিলেন, তার কেমন অনুভূতি হয়? নিশ্চয়ই তার মনে হয়Ñ গাছটা লাগিয়ে ছিলাম শুধু এই দৃশ্যটা দেখার জন্যই। এতেই সার্থকতা। নিজের মনের তৃপ্তির আর প্রকৃতির প্রতি ভালবাসায় ঢাকাবাসী গাছ লাগান ঢাকার রাস্তায়। বোশেখ-জষ্টি মাসে মৌসুমী ফলের কল্যাণে ঢাকার রূপ যেমন কিছুটা বদলে যায়, তার গন্ধেও খানিকটা পরিবর্তন আসে বৈকি। তরমুজের কয়েকটি ফালি কিংবা কাঁঠালের দশ-বারোটি কোয়া খেলে এক বেলার খাবার হয়ে যায়। ঢাকার শ্রমজীবী মানুষ বলতে সবার আগে যে কয়টি পেশার নাম চলে আসে তার ভেতর রয়েছে রিক্সাচালনা, পোশাক-শ্রমিক ও নির্মাণ-মজুর। এদের সীমাবদ্ধ আয়ের টাকা দিয়ে ক্রয়ক্ষমতা আর কতটুকুই বা অর্জিত হয়। তাই রাজধানীতে রাস্তার পাশে এদেরই এক ফালি তরমুজ কিংবা এক প্লেট কাটা আনারস কিনে খেতে বেশি দেখা যায়। এবার বৈশাখেই রাস্তার মোড়ে মোড়ে তরমুজের স্তূপ দৃশ্যমান হচ্ছে। এসব তরমুজ আগের মতো গোলাকার নয়। দেখতেও কিছুটা ভিন্ন। রাজধানীর বিভিন্ন অঞ্চলে তরমুজ বিক্রেতাদের কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম এসব তরমুজ বরিশাল-পটুয়াখালি-কুয়াকাটা থেকে এসেছে। আবাদ কিছুটা কম হলেও এবার ফলন প্রচুর। তাই প্রতিদিনই জলপথে ঢাকায় তরমুজ আসছে। আস্ত তরমুজের বিক্রি এখনও যথেষ্ট নয়, তবে ফালি ফালি করে কাটা তরমুজ বিকোচ্ছে দেদার। কম ব্যবহৃত ফুট ওভারব্রিজ বিমানবন্দরের সামনের সড়কের কথা বলছি। প্রতিদিন উত্তরা থেকে অফিসে যাওয়া-আসার সময় এখানকার হাল দেখি। শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে থাকেন রাস্তা পারাপারের জন্য। অথচ কাছেই রয়েছে ফুটওভার ব্রিজ। কাছে বলতে একেবারে হাতের নাগালে। আগে ছিল অবশ্য কুড়ি গজ দূরে। কুড়ি গজ হাঁটতে হবে বলে লোকজন ওই সেতু তখন মাড়াতেন না বলেই মেয়র আনিসুল হক রাস্তা লাগোয়া ফুট ওভারব্রিজ তৈরির আদেশ দেন। এটি অবশ্য আগেরটার মতো অত চওড়া না হলেও দু’পাশে একটি করে স্বয়ংক্রিয় সিঁড়ি (এ্যাসকেলেটর) রয়েছে। বিমানবন্দর চত্বর এলাকায় কিছুক্ষণ দাঁড়ালে দেখা যায়, প্রতি মিনিটে ৩০-৩৫ জন ঝুঁকি নিয়ে সড়ক পারাপার হচ্ছেন। কেউ হাত উঁচিয়ে, কেউ যানবাহনের সামনে দিয়ে দৌড়ে পার হচ্ছেন। সড়কের কয়েক জায়গায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক উত্তর বিভাগের পক্ষ থেকে ‘রাস্তা পারাপারে ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার করুন’, ‘যত্রতত্র রাস্তা পারাপার দণ্ডনীয় অপরাধ’ লেখা সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। লোকজন এসব সাইনবোর্ডের সামনে দিয়েই রাস্তা পার হচ্ছেন। পথচারীর স্বভাবে পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হলো এই নতুন ফুট ওভারব্রিজ! ঢাকায় নতুন গ্যালারি ধানমন্ডি নয় নম্বর সড়কে, কলাবাগান মাঠের কাছেই প্রধান সড়কের পাশে ইউরোপীয় ধরনে নির্মিত বহুতল ভবনের ( বে’স পার্ক হেইটস্) নিচতলায় চালু হলো নতুন আর্ট গ্যালারি ‘এজ’। গ্যালারির একটি অংশে মুক্ত বাতাসের চলাচল, কাচের সিলিং দেয়া। ফলে আকাশ দেখা যায়। ভেতরের সাজসজ্জা আকর্ষণীয়। জাপানে প্রশিক্ষিত বিশিষ্ট শিল্পী মোহাম্মদ ইকবালের ৪২ তম একক চিত্র প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে উদ্বোধন হলো এই সুন্দর গ্যালারির। উদ্বোধনী আয়োজনে নবীন প্রবীণ শিল্পীদের মিলনমেলা বসেছিল। ছিলেন ক’জন শিল্পসংগ্রাহকও। সাইলেন্ট রিভিলেশন্স বা মৌন প্রতিভাস শীর্ষক এই চিত্রপ্রদর্শনীর ছবিগুলোয় বিপর্যস্ত পরিবেশের বিরূপ প্রভাব এবং যুদ্ধশঙ্কিত মানুষের, বিশেষ করে অল্পবয়সী ছেলেমেয়ের মুখাভিব্যক্তি উঠে এসেছে। একইসঙ্গে তা দৃষ্টিনন্দনও। ২২ এপ্রিল ২০১৮ [email protected]
×