ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসেনজিৎ হালদার

অভিমত ॥ সকল প্রতিবন্ধকতার উৎস দুর্নীতি

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২৫ এপ্রিল ২০১৮

অভিমত ॥ সকল প্রতিবন্ধকতার উৎস দুর্নীতি

দুর্নীতি-জালিয়াতি যেন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়ে চলেছে। খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা সব জায়গাগুলোতেই পরিলক্ষিত হয় দুর্নীতি নামক প্রতিবন্ধকতা। সমাজ ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে নেতিবাচক যে শব্দ তা হলো দুর্নীতি-অনিয়ম। যুগের আধুনিকায়ন হলেও দুর্নীতি বিতাড়িত না হয়ে প্রতিনিয়তই যুক্ত হচ্ছে ভিন্ন মাত্রা তথা নতুন কায়দায়। এক সময় টেবিলের নিচের খবর প্রচলিত থাকলেও আজ তা আর তেমন শোনা যায় না। তবে এ কথা সত্য যে, দেশ ডিজিটাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থাৎ প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের কারণে দিন দিন দুর্নীতি-অনিয়ম কমছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পরিবর্তনের সঙ্গে ঢাকাও পড়ছে অনেক বিশৃঙ্খলা। শুধু মানুষের মৌলিক অধিকার নিয়ে দুর্নীতি প্রসঙ্গে বলতে গেলে পাওয়া যায় ভয়াবহ চিত্র। অথচ কোন দেশের সচেতন-শিক্ষিত নাগরিকের এমনটি প্রত্যাশিত নয়। ‘ভেজাল খাবার’ শব্দ দুটি শুধু যে খাবারের সঙ্গেই সম্পৃক্ত তা নয়, বরং এর প্রভাব রয়েছে সমগ্র জাতির মেধা ও মননে। ভাল খাবার যোগাড় করতে গেলে প্রয়োজন হয় নিরীক্ষণের। কেননা সেখানে রয়েছে সাধারণের শঙ্কা। শাক-সবজি, ফলমূল, মাছ-মাংস, এমনকি খাবার পানীয় পর্যন্ত, সব কিছুতেই ভেজাল দেয়া হয়Ñ যা প্রমাণিত। মানে-গুণে-পুষ্টিতে এজাতীয় খাবার একজন মানুষের পূর্ণাঙ্গ বিকাশে কতখানি সমৃদ্ধ, তা বিশেষজ্ঞরাই ভাল বলতে পারবেন। আমাদের দেশের খাবার জাতীয় পণ্যের বেশিরভাগ ব্যবসায়ী শুধু মুনাফাতেই মনোযোগী, মানে-গুণে-ভাল খাবারে নয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়মিত তদারকি এমনকি জেল-জরিমানা করেও এর প্রতিকার করতে পারছে না। কারণ, যাদের এ বিষয়ে সচেতন থাকা উচিত, মূলত তারাই দুর্নীতিগ্রস্ত, অনিয়ন্ত্রিত। যারা বস্ত্রশিল্পের নিয়ন্ত্রক, তারাও সাধারণের বস্ত্র যোগানে অমনোযোগী। যদিও এদেশের বস্ত্রের মান ভাল, তবুও দেখা যায় দরিদ্র মানুষের রয়েছে প্রয়োজনীয় কাপড়ের অভাব। শুধু তাই-ই নয়, এ শিল্পে যারা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন হরহামেশাই তাদের আন্দোলন করতে দেখা যায় সময়মতো বেতন প্রাপ্তি কিংবা বকেয়া বেতন আদায়ের জন্য। এমন ঘটনার কথাও শোনা যায় যে, অনেক শ্রমিক বেতন পাওয়ার জন্য জীবন বলি দেন। এক্ষেত্রেও এ শিল্পে বিদ্যমান রয়েছে কতিপয় কিছু অসৎ দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি। অনেক পোশাক শিল্পের মালিক তাদের আখের গোছানোর জন্য অসচ্ছল-দরিদ্র শ্রমিকদের ঠিকমতো বেতন-ভাতা দেন না। একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থ উপার্জন করবে সে সুযোগ কোথায়! অর্থাৎ সেখানে প্রকৃতপক্ষেই বিরাজ করে দুর্নীতির থাবা। বাসস্থানের কথা বলতে গেলে দেখা যায়, এখনও দেশের অনেক মানুষই বাস্তুভিটা হারা। কখনও ভূমিদস্যুদের হাত, কখনও ভাঙ্গন, কখনও বা উচ্ছেদ। শেষে রাস্তাই বাস্তুহারাদের ঠিকানা! বর্তমান সরকার ভূমিহীনদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করলেও দেশে এখনও অধিকাংশ মানুষের নিজস্ব বাসস্থান নেই। অনেক দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনেকের জায়গা জমি এমনকি ভিটে মাটি গ্রাস করছে। দুঃখের বিষয় এই যে, অনেক ক্ষেত্রেই সরকারী মহলসহ প্রশাসনও ক্ষমতাধর সেই সকল দুর্নীতিবাজদের চিহ্নিত করলেও তারা থেকে যায় আইন বা বিচারের বাইরে। সাধারণ মানুষের সে সময় যে কিছুই করার থাকে না, তা বলাই বাহুল্য। অথচ এ দেশটাতে সকলের অধিকার সমান পাওয়ার কথা, যা বাস্তবে আদৌ প্রতীয়মান হয় না। শিক্ষা নিয়ে বলতে গেলে শিউরে উঠতে হয়। প্রশ্ন ওঠে, কি শিখছি আমরা? এ রকম শিক্ষা লাভ করে তা কি কাজে লাগবে আমাদের জীবনে? যে শিক্ষা আমাদের দেশে দেয়া হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে, তা নিয়ে অনেকের মনেই রয়ে যায় যথেষ্ট উদ্বেগ। কারণ, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত করেও এদেশে বেকারের সংখ্যা বেড়ে চলে। একটি জাতি যত শিক্ষিত, সে জাতির তত উন্নতি এ কথা বহুকাল আগের। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন- দেশে হচ্ছে টা কি! প্রশ্নফাঁস! এ যে জাতির জন্য শুধু লজ্জাজনক তাই নয়, বরং একটি জাতিকে সমূলে ধ্বংস করার পরিকল্পিত প্রয়াসও বটে। প্রশ্নফাঁস যদি দুর্নীতির অংশ হয়, তবে শিক্ষা আর প্রকৃত শিক্ষা হয় কি করে! পড়ালেখা না করে একজন শিক্ষার্থী যখন পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করে ভাল ফল লাভ করে, তখন শিক্ষারই বা কি মূল্য থাকে? ভেবে দেখুন- আমরা আজ যারা ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক, তারাই জাতির ভবিষ্যতের ধ্বংসের কারণ। চিকিৎসা সেবা যেখানে সাধারণের মৌলিক অধিকারের একটি, তা নিয়েও আমাদের রয়েছে গভীর শঙ্কা। কেননা, টাকা ছাড়া কোনরূপ চিকিৎসা এদেশে হয় না। শুধু সরকারী হাসপাতাল বাদ দিলে, চিকিৎসা নিয়ে যে ব্যবসা আমাদের দেশে বিদ্যমান রয়েছে, তা লোকমুখে এক শব্দে ‘গলাকাটা’। এর প্রমাণ সবাই পায় বেসরকারী হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা করাতে গেলে। এমনও হয়, আগে টাকা না দিলে কোন চিকিৎসা হয় না! এই আমাদের দেশে মৌলিক চাহিদাগুলোর হাল। অথচ সংবিধানে বলা আছে, মৌলিক অধিকারগুলো সকলেরই সমান পাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা বলে অন্য অভিজ্ঞতার কথা। পক্ষান্তরে চিকিৎসা শাস্ত্রে যারা পড়ালেখা করেন, তাদের অনেকেই প্রশ্ন পেয়ে পরীক্ষা দিয়ে ডাক্তারী বিজ্ঞানে পড়ালেখা করে। বিস্তারিত না জেনে, গবেষণা না করে একজন শিক্ষার্থী যখন ডাক্তার হন, তখন কিভাবে আমরা সে ডাক্তারের ওপর ভরসা রাখব? এই ভেবেই শরীরের রক্ত ঠা-া হয়ে আসে। এও যে অনেক বড় দুর্নীতির অংশ, এ কথা অনস্বীকার্য। জ্ঞান-বিজ্ঞানে যেখানে এগিয়ে চলেছে একুশ শতকের পৃথিবী, সেখানে আমাদের দেশে বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কিত থাকা অস্বাভাবিক নয়। ২০২১ সালের মধ্যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে বাংলাদেশ ডিজিটাল হচ্ছে। এরই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কতিপয় দুর্নীতিবাজ ডিজিটাল দুর্নীতির নীল নক্সা অঙ্কন করছে। তবে প্রযুক্তির সমন্বিত ব্যবহারে বেশিরভাগ দুর্নীতি রোধ করা সম্ভব। কিন্তু প্রধান সমস্যা হচ্ছে- যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করবেন, তারাই যদি পরিকল্পিতভাবে দুর্নীতি করে, তবে এ থেকে নিস্তারের উপায় নেই। বরং সমস্যা হবে আরও প্রকট। অনেক বিশেষজ্ঞ দুর্নীতিরোধে নানা পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন। কিন্তু সে কাজ যারা বাস্তবায়ন করবেন, তারাই অনেক ক্ষেত্রে দুর্নীতিতে জড়িত। অর্থাৎ যে শর্ষে দিয়ে তাড়ানো হবে ভূত, আসলে সেই শর্ষের মধ্যেই ভূত। আশার কথা এই যে, প্রজন্মের পর প্রজন্মের বিবর্তনের ফলে সবাই ধীরে ধীরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে। যে কথাগুলো না বললেই নয়, তার মধ্যে পড়ে আমাদেরই ঘনিষ্ঠজনদের দুর্নীতির কথা। যেমন ধরুন, বাজারের মাছ অথবা সবজি বিক্রেতার কথা, যিনি হয়ত কোন চিন্তাভাবনা না করেই সীমিত কিছু লাভের আশায় খাবারে মেশান ফরমালিন নামক বিষ। দুঃখের বিষয় এই যে, ওই খাবারগুলোও খাওয়ার জন্য যায় তারই পরিবারে। হিসাব করে দেখুন, ক্ষতিটা হলো কার? আজ যদি আমি-আপনি-আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়িয়ে উল্টো তা করি, আমাদের পরের প্রজন্ম তাই শিখবে আমাদের হাত ধরে। কিন্তু এমনটা আমরা কেউই চাই না- এ কথা ধ্রুব সত্য। আমাদের দেশ সোনার বাংলাদেশ, যার মাটিতে বীজ বুনলেই গজিয়ে ওঠে সব রকমের ব্যবহার্য বৃক্ষ। তবুও আমাদের কৃষক ভাইয়েরা থাকে উদ্বিগ্ন, টাকা ছাড়া মেলে না ভাল বীজ। দেশের বেশিরভাগ কৃষকই গরিব। অনেকে বাস্তুভিটা হারাও বটে। তাদের দিকে পরিচ্ছন্ন হাত বাড়িয়ে দেয়ার লোকের বড্ড অভাব। অনেক কষ্ট করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে চাষাবাদ করে ফসল ফলিয়ে অনেকের মেলে না ন্যায্য দাম। প্রশ্ন, কেন? গণমাধ্যমে এমন খবরও প্রকাশিত হয়, কৃষক-চাষী তার উৎপাদনের ফসলের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে তা নষ্ট করে ফেলে। অথচ বাজারের অবস্থা বিবেচনা করলে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি পণ্যের মূল্যই চড়া। চাল থেকে শুরু করে সকল পণ্যের ব্যবসাতেই বিদ্যমান দুর্নীতি-অনিয়ম। বাংলায় একটি প্রবাদ খুব প্রচলিতÑ শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না। এ কথা এ কারণেই এখানে আসে যেÑ অসৎ বা অনৈতিক কাজ করে চিরজীবনের জন্য পাড় পাওয়া কখনই সম্ভব নয় এবং ইতিহাসও তাদের ক্ষমা করে না। অনেকে জীবিত থাকতেই তাদের দুর্নীতির বিচার হয়। এদেশে অতীতেও এমন হয়েছে, বর্তমানেও হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। আজ অথবা কাল যে কোন খবরই প্রকাশ হতে বাধ্য। যদি তা হয় ভালর জন্য, তবে তা প্রশংসায় মুখরিত হয় । আর যদি হয় তা খারাপ তবে তার জন্য শাস্তি পেতেই হবে। যদিও মানুষের সচেতনতাবোধই সবার আগে তবুও বলতে হয়, গুটিকয়েক লোকের জন্য অনেক সময় দোষী হয় একটি সমাজ, গোষ্ঠী বা কোন সম্প্রদায়। যে লোকগুলো দুর্নীতিগ্রস্ত তাদের চিহ্নিত করতে হবে এবং শুধু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারলেই সমাজের অনেক সমস্যার সমাধান হবে। ঘুষ-দুর্নীতি নিয়ে যাদের সম্পর্কে আলোচনা হয়, তাদের বিরুদ্ধেও প্রত্যক্ষ নজরদারি বাড়াতে হবে। তা হলেই কমবে এ জাতীয় সংবিধানবিরোধী, রাষ্ট্রের উন্নয়নবিরোধী অনৈতিক কাজ। লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×