ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনে শপথ গ্রহণ

ইতিহাস গড়লেন হামিদ

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২৫ এপ্রিল ২০১৮

ইতিহাস গড়লেন হামিদ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দ্বিতীয় মেয়াদে দেশের একুশতম রাষ্ট্রপতি পদে দায়িত্ব পালনের জন্য শপথ নিয়েছেন দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। যিনি আগামী ৫ বছর এ পদে দায়িত্ব পালন করবেন। কিশোরগঞ্জের প্রত্যন্ত ভাটি অঞ্চলের মিঠামইনে জন্ম নেয়া বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদের রয়েছে বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল প্রথমবার রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে তিনি জাতীয় সংসদে স্পীকারের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি ৭ বারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী মোঃ আবদুল হামিদ ৭৪ বছর বয়সে দ্বিতীয়বারের মতো রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টা ৪৩ মিনিটে বঙ্গভবনের দরবার হলে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালনের জন্য শপথ গ্রহণ করেন। জাতীয় সংসদের স্পীকার শিরীন শারমিন চৌধুরী রাষ্ট্রপতিকে শপথবাক্য পাঠ করান। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদকে নিয়ে দরবার হলে প্রবেশ করেন। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ, সংসদের উপনেতা সাজেদা চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, ডেপুটি স্পীকার, রাষ্ট্রপতি পরিবারের সদস্য, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, তিন বাহিনী প্রধান, জাতীয় সংসদের সদস্য, বিদেশী কূটনীতিক, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য, জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক এবং জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন। শপথ গ্রহণ শেষে রাষ্ট্রপতি অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। এর আগে বঙ্গভবনে পৌঁছলে আবদুল হামিদ ও তার স্ত্রী রাশিদা খানম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানান। শেখ হাসিনার সঙ্গে বোন শেখ রেহানাও উপস্থিত ছিলেন। পরে স্পীকার শিরীন শারমিনসহ তারা একসঙ্গে দরবার হলে পৌঁছেন। এ সময় সামরিক বাহিনীর একটি বাদক দল ফ্যানফেয়ার বাজায়। দরবার হলে ঢোকার পরে আবদুল হামিদ ও শিরীন শারমিন মঞ্চে ওঠেন। শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম। সাদা পাঞ্জাবি ও মুজিবকোট পরিহিত মোঃ আবদুল হামিদ শপথ বাক্য পাঠ করার পর সবাইকে হাত তুলে সালাম জানান। পরে শপথ নামায় সই করেন তিনি। শপথ নেয়ার পর মোঃ আবদুল হামিদ এখন রাষ্ট্রপতি পদে সপ্তদশ ব্যক্তি হিসেবে ২১ তম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। সংবিধান অনুযায়ী আগামী ৫ বছর তিনি দায়িত্ব পালন করবেন। তিনিই দেশের একমাত্র ব্যক্তি যিনি দ্বিতীয় মেয়াদে এই দায়িত্ব পালন করছেন। সংবিধান অনুযায়ী সর্বোচ্চ দুই বার রাষ্ট্রপতি পদে থাকার সুযোগ থাকায় এটাই হবে তাঁর শেষ মেয়াদ। এর আগে গত ২০১৩ সালের ২২ এপ্রিল প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন তিনি। ওই বছর ২৪ এপ্রিল দেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ওই বছরের ১৪ মার্চ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন থাকার সময় তিনি প্রথম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। এরপর জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর ২০ মার্চ থেকে তিনি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। পরে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। গত ৭ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদকে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচিত ঘোষণা করেন এ পদে নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা। রাষ্ট্রপতি পদে মোঃ আবদুল হামিদ একমাত্র বৈধ প্রার্থী হওয়ায় নির্বাচন কমিশনার রাষ্ট্রপতি আইন ১৯৯১ এর ৭ ধারা মোতাবেক তাঁকে নির্বাচিত ঘোষণা করেন। নির্বাচিত ঘোষণার পরে ওইদিনই এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয়। গত ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের জন্য তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তফসিল অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের জন্য ভোট গ্রহণের তারিখ ১৮ ফেব্রুয়ারি নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু গত ৫ ফেব্রুয়ারি এ পদে নির্বাচনের জন্য মোঃ আবদুল হামিদের পক্ষে একটি মাত্র মনোনয়নপত্র জমা পড়ে। ফলে ৭ ফেব্রুয়ারি যাচাই বাছাইয়ে তাঁর মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী কোন প্রার্থী না থাকায় রিটার্নিং কর্মকর্তা ওইদিনই তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করেন। এ পদে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর গত ৩১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সংসদীয় বোর্ড দ্বিতীয় মেয়াদের জন্যও মোঃ আবদুল হামিদকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়নের জন্য সিদ্ধান্ত নেয়। ১ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার রাতে বঙ্গভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদকে দেশের ২১তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে দলের মনোনয়ন প্রদানের সিদ্ধান্তের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দেন। গত ২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন জাতীয় সংসদের চীপ হুইপ আসম ফিরোজ। ৫ ফেব্রুয়ারি আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে এসে রাষ্ট্রপতির পক্ষে মনোনয়নপত্র জমা দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এ পদে একজনের মনোনয়নপত্র জমা হওয়ায় ভোটের আয়োজন করতে হয়নি। জাতীয় সংসদের সদস্যরা ভোট দিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেন। কিন্তু ’৯১ সালের পর থেকে এ পদের নির্বাচনে কখনো ভোটের আয়োজন করতে হয়নি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আবদুল হামিদের পক্ষেই তিনটি মনোনয়নপত্র জমা পড়ে। প্রথম মনোনয়নপত্রের প্রস্তাবক ছিলেন সংসদ সদস্য ওবায়দুল কাদের এবং সমর্থক সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জমা দেয়া দ্বিতীয় মনোনয়নপত্রের প্রস্তাবক ছিলেন সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন, সমর্থক ছিলেন সংসদ সদস্য আ স ম ফিরোজ। তৃতীয় মনোনয়নপত্রের প্রস্তাবক ছিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং সমর্থক সংসদ সদস্য আতিউর রহমান আতিক। আইন অনুযায়ী প্রথম মনোনয়নপত্র যাচাই বাছাইয়ের বৈধ ঘোষণার পর বাকি মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন হয় না। বাকি মনোনয়নপত্রগুলো এমনিতে বাতিল হয়ে যায়। এক্ষেত্রে প্রথম মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করের বাকি মনোনয়নপত্র বাতিল করে দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। ৭ ফেব্রুয়ারি মোঃ আবদুল হামিদকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি পদের নির্বাচনে দাখিল করা মনোনয়নপত্র পরীক্ষা করা হয়। মনোনয়নপত্র পরীক্ষার পর রাষ্ট্রপতি পদে মোঃ আবদুল হামিদের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করা হয়। রাষ্ট্রপতি পদে মোঃ আবদুল হামিদ একমাত্র বৈধ প্রার্থী হওয়ায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের নির্বাচনী কর্তা প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা রাষ্ট্রপতি আইন ১৯৯১ এর ৭ ধারা মোতাবেক মোঃ আবদুল হামিদকে দেশের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, মেয়াদ অবসানের কারণে রাষ্ট্রপতি পদ শূন্য হওয়ার ক্ষেত্রে মেয়াদপূর্তির তারিখের আগের নব্বই থেকে ষাট দিনের মধ্যবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হয়। ফলে গত ২৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এ নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা ছিল। তার আগেই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন আবদুল হামিদ। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯ মেয়াদে এ পর্যন্ত ১৬ জন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই হিসেবে আবদুল হামিদ এই পদে সপ্তদশ ব্যক্তি এবং দ্বিতীয় মেয়াদে ২১তম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েছেন। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপ্রতি পদে একবার ভোট হলেও এরপর থেকে আওয়ামী লীগের আমলে সাহাবুদ্দিন আহমেদ, বিএনপি পরের আমলে প্রথমে বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং পরে ইয়াজউদ্দিন আহমেদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় এলে জিল্লুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করেন। ২০১৩ সালে তিনি ইন্তেকাল করলে মোঃ আবদুল হামিদ কিছুদিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন। পরে মোঃ আবদুল হামিদ নির্বাচিত হন। আইন অনুয়ায়ী রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ ৫ বছর হলেও বিএনপি সরকারের দ্বিতীয় আমলে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ সাত বছর রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এর মধ্যে পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ হওয়ার পরের দুই বছর তিনি রাষ্ট্রপতি ছিলেন জরুরী অবস্থা জারির সুবাদে। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার কামালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৯ সালে ছাত্রলীগে যোগ দেয়ার মধ্য দিয়ে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ১৯৬১ সালে কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থাতেই তিনি যোগ দেন আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে। এক পর্যায়ে তাকে কারাগারেও যেতে হয়। প্রথমবার ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ময়মনসিংহ-১৮ আসন থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় দফায় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৫ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত তিনি। ১৯৮৬ সালের তৃতীয় সংসদ, ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ, ১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ, ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ এবং সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনেও তিনি সাংসদ নির্বাচিত হন। সপ্তম সংসদে ১৯৯৬ সালের ১৩ জুলাই থেকে ২০০১ এর ১০ জুলাই পর্যন্ত ডেপুটি স্পীকারের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ এর ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত স্পীকার হিসেবে সংসদ পরিচালনা করেন আবদুল হামিদ। আর নবম সংসদে নির্বাচিত হওয়ার পর দ্বিতীয়বারের মতো স্পীকার হন। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন মোঃ আবদুল হামিদ। মঙ্গলবার ৫ বছর মেয়াদের জন্য দ্বিতীয় দফায় শপথ নেন তিনি।
×