ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বকাপকথন-১৫ ॥ ত্রয়োদশ বিশ্বকাপ মেক্সিকো : ১৯৮৬

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ২৫ এপ্রিল ২০১৮

বিশ্বকাপকথন-১৫ ॥ ত্রয়োদশ বিশ্বকাপ মেক্সিকো : ১৯৮৬

একুশতম বিশ্বকাপ ফুটবল শুরুর আর দেড় মাস বাকি। প্রস্তুত রাশিয়ার মস্কোর লুজনিকিসহ ১২ স্টেডিয়াম। ৮১ হাজার আসনের এই লুজনিকি স্টেডিয়ামে ১৪ জুন এবারের বিশ্বকাপের উদ্বোধনী এবং ১৫ জুলাই সমাপনী (ফাইনাল) ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। এখন চলছে মাঠগুলোর শেষ মুহূর্তের পরিচর্যা। এরই মধ্যে এ কথা সবার জানা হয়ে গেছে, এবারের ২১তম বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসছে রাশিয়ায়। এবারের ২১তম বিশ্বকাপে ৩২ দল অংশ নেবে। কোন ৩২ দল ২১তম বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশ নেবে সেটাও এখন কারও জানতে বাকি নেই। কোন্ ২১ দল অংশ নেবে সেটাও সবার জানা হয়ে গেছে। রাশিয়ার ১২ স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের ৬৪ ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবে। এ কথাও সবার জানা, ১৯৩০ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম আসর বসে উরুগুয়েতে। মন্টিভিডিওতে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম ফাইনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। মন্টিভিডিও থেকে মস্কো। বিশ্বকাপ ফুটবলের ৮৮ বছরের পথচলা নিয়ে আমাদের ধারাবাহিক আয়োজন ‘বিশ্বকাপকথন’। লিখেছেন...প্রথিতযশা কবি, কথাসাহিত্যিক ও ক্রীড়ালেখক সৈয়দ মাজহারুল পারভেজ মন্টিভিডিও টু মস্কো প্রথম দেশ হিসেবে দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব পায় মেক্সিকো। এর আগে তারা ১৯৭০ সালে প্রথমবার বিশ্বকাপ ফুটবলের সফল আয়োজক ছিল। ফিফার ১৫৯টি সদস্য দেশের ভোটে আয়োজক নির্বাচিত হলো মেক্সিকো। এবার দশম বিশ্বকাপের মূল পর্বে খেলল ২৪টি দেশ সে কথা আগেই বলা হয়েছে। অঞ্চলভিত্তিক দলগুলো হলো : ইউরোপ : ইতালি, প. জার্মানি, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, স্পেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, বেলজিয়াম, উ. আয়ারল্যান্ড, পর্তুগাল, ডেনমার্ক, পোল্যান্ড, স্কটল্যান্ড; কনমোবল : ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে,; কনকাকাফ : মেক্সিকো; ওশেনিয়া : নিইজিল্যান্ড; আফ্রিকা : আলজেরিয়া ও মরক্কো; এশিয়া ; দ. কোরিয়া ও ইরাক দ্বাদশ বিশ্বকাপে অংশ নেয়। এই ২৪টি দেশ নির্বাচন করা হয় বাছাইপর্বের ১২১টি দেশের মধ্যে থেকে। বাছাই পর্বে অনুষ্ঠিত হয় ৩০৮টি ম্যাচ। আর মূল পর্বে ২৪টি দল খেলল ৫২টি ম্যাচ। স্পেনের ১২টি স্টেডিয়ামে এই ৫২টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। দশম বিশ্বকাপের মতো এবারও আবার গ্রুপিং করা হয়। তবে এবার গ্রুপ পর্বে ১৬টি দলের পরিবর্তে দেশ সংখ্যা ছিল ২৪টি। ফলে ২৪টি দলকে ৬টি গ্রুপে ভাগ করা হয়। প্রত্যেক গ্রুপে ৪টি করে দল অংশ নেয়। দ্বাদশ বিশ্বকাপের নিয়মেই এবারও খেলা হয়। এবার খেলার নিয়ম ছিল এ রকম, গ্রুপ পর্বের ২৪টি দলের গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স আপসহ ১৬টি দল দ্বিতীয় রাউন্ডে নক আউট পদ্ধতিতে খেলবে। দ্বিতীয় রাউন্ডের বিজয়ী ৮ দল কোয়ার্টার-ফাইনাল খেলবে। কোয়ার্টার-ফাইনালে বিজয়ী ৪ দল সেমি-ফাইনাল ও সেমি-ফাইনাল বিজয়ী দুই দল ফাইনাল খেলবে। ২৪টি দলকে ৬ গ্রুপে ভাগ করা হয় এভাবে: ক-গ্রুপে ইতালি, আর্জেন্টিনা, বুলগেরিয়া ও দ. কোরিয়া; খ-গ্রুপে মেক্সিকো, বেলজিয়াম, প্যারাগুয়ে ও ইরাক; গ-গ্রুপে ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, রাশিয়া ও কানাডা; ঘ-গ্রুপে ব্রাজিল, স্পেন, আলজেরিয়া ও উ. আয়ারল্যান্ড; ঙ-গ্রুপে প. জার্মানি, উরুগুয়ে, ডেনমার্ক ও স্কটল্যান্ড; চ-গ্রুপে ইংল্যান্ড, পর্তুগাল, পোল্যান্ড ও মরক্কো এ বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায়। মেক্সিকো সিটির আইজ্যাক স্টেডিয়ামের এক বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর উদ্বোধনী ম্যাচে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ইতালি বনাম বুলগেরিয়া। জিততে পারেনি ইতালি। খেলা ১-১ গোলে ড্র হয়। ইতালি জিততে না পারলেও ইংল্যান্ড পর্তুগালের বিপক্ষে জেতে ৩-০ গোলে। গ্যারি লিনেকার হ্যাট্রিক করেন। এরপর ছয় গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স আপসহ ১৬টি দল দ্বিতীয় রাউন্ডে নক আউট পর্বে খেলে। দ্বিতীয় রাউন্ডে নক আউট পর্বের ফলাফল ছিল এ রকম : মেক্সিকো ২-০ গোলে বুলগেরিয়াকে, বেলজিয়াম ৪-৩ গোলে সো. ইউনিয়নকে, ব্রাজিল ৪-০ গোলে পোল্যান্ডকে, আর্জেন্টিনা ১-০ গোলে উরুগুয়েকে, ফ্রান্স ২-০ গোলে ইতালিকে, প. জার্মানি ১-০ গোলে মরক্কোকে, ইংল্যান্ড ৩-০ গোলে প্যারাগুয়েকে এবং স্পেন ৫-১ গোলে ডেনমার্ককে হারিয়ে কোয়ার্টার-ফাইনাল নিশ্চিত করে। স্পেনের বুত্রাগুয়েনা হ্যাট্রিকসহ ৪ গোল করেন। দ্বিতীয় রাউন্ডে বেলজিয়ামের কাছে অপ্রত্যাশিতভাবে সোভিয়েতরা হারে ৩-৪ গোলে। রাশান তারকা বেলানভের হ্যাট্রিকও দলের হার বাঁচাতে পারেনি। কোয়ার্টার-ফাইনালে ফ্রান্স ১(৪)-১(৩) টাইব্রেকারে ব্রাজিলকে, প. জার্মানি ০(৪)-০(১) টাইব্রেকারে স্বাগতিক মেক্সিকোকে, আর্জেন্টিনা ২-১ গোলে ইংল্যান্ডকে এবং বেলজিয়াম ১(৫)-১(৪) স্পেনকে হারিয়ে সেমি-ফাইনালে পৌঁছে যায়। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনার মাঝ মাঠ থেকে ৪/৫ জন ইংরেজ খেলোয়াড়কে কাটিয়ে করা দৃষ্টিনন্দন গোলটি যথেষ্ট বিতর্কের জন্ম দেয়। বলা হয়, ম্যারাডোনা পা দিয়ে নয়; হাত দিয়ে গোলটি করেছিলেন। রেফারির চোখ ফাঁকি দিয়ে করা এ গোলটির বিষয়ে যদিও ম্যারাডোনা তা অস্বীকার করেননি। তিনি হাত দিয়ে করার কথা সরাসরি স্বীকার না করলেও এটিকে ‘ঈশ্বরের গোল’ হিসেবে অভিহিত করেন। আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনা ২ গোল, লিনেকার গোল করেন। ফ্রান্সের মিশেল প্লাতিনি, ব্রাজিলের কারেকা, সক্রেটিস, বিশেষ করে এ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার খেলা অনেক বছর মানুষ মনে রাখবে। সেমি-ফাইনালে প. জার্মানি ২-০ গোলে ফ্রান্সকে ও আর্জেন্টিনা ২-০ গোলে বেলজিয়ামকে হারিয়ে ফাইনাল খেলার গৌরব অর্জন করে। জার্মান তারকা ব্রেহমে ও রড্ডি ভয়েলার এবং আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনা আবার ২ গোল করেন। গ্রুপ পর্বের ফলাফল : গ্রুপ-এ : ইতালি-১ বুলগেরিয়া-১; আর্জেন্টিনা-৩ দ. কোরিয়া-১; ইতালি-১ আর্জেন্টিনা-১; বুলগেরিয়া-১ দ. কোরিয়া-১; ইতালি-৩ দ. কোরিয়া-২; আর্জেন্টিনা-২ বুলগেরিয়া-০; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : আর্জেন্টিনা গ্রুপ রানার্স আপ : ইতালি তৃতীয় : বুলগেরিয়া । গ্রুপ-বি : মেক্সিকো-২ বেলজিয়াম-১; প্যারাগুয়ে-১ ইরাক-০; মেক্সিকো-১ প্যারাগুয়ে-১; বেলজিয়াম-২ ইরাক-১; মেক্সিকো-১ ইরাক-০; বেলজিয়াম-২ প্যারাগুয়ে-২; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : মেক্সিকো গ্রুপ রানার্স আপ : প্যারাগুয়ে তৃতীয় : বেলজিয়াম । গ্রুপ-সি : ফ্রান্স-১ কানাডা-০; সো. ইউনিয়ন-৬ হাঙ্গেরি-০; সো. ইউনিয়ন-১ ফ্রান্স-০; হাঙ্গেরি-২ কানাডা-০; ফ্রান্স-৩ হাঙ্গেরি-০; সো. ইউনিয়ন-২ কানাডা-০; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : সো, ইউনিয়ন গ্রুপ রানার্স আপ : ফ্রান্স। গ্রুপ-ডি : ব্রাজিল-১ স্পেন-০; উ. আয়ারল্যান্ড-১ আলজেরিয়া-০; ব্রাজিল-১ আলজেরিয়া-০; স্পেন-২ উ. আয়ারল্যান্ড-১; ব্রাজিল-৩ উ. আয়ারল্যান্ড-০; স্পেন-৩ আলজেরিয়া-০; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : ব্রাজিল গ্রুপ রানার্স আপ : স্পেন তৃতীয় :। গ্রুপ-ই : প. জার্মানি-১ উরুগুয়ে-১; ডেনমার্ক-১ স্কটল্যান্ড-০; ডেনমার্ক-৬ উরুগুয়ে-১; প. জার্মানি-২ স্কটল্যান্ড-১; ডেনমার্ক-২ প. জার্মানি-০; উরুগুয়ে-০ স্কটল্যান্ড-০; গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : ডেনমার্ক গ্রুপ রানার্স আপ : প. জার্মানি তৃতীয় : উরুগুয়ে। গ্রুপ-এফ : পোল্যান্ড-০ মরক্কো-০; পর্তুগাল-১ ইংল্যান্ড-০; মরক্কো-০ ইংল্যান্ড-০; পোল্যান্ড-১ পর্তুগাল-০; মরক্কো-৩ পর্তুগাল-১; ইংল্যান্ড-৩ পোল্যান্ড-০। গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন : মরক্কো গ্রুপ রানার্স আপ : ইংল্যান্ড তৃতীয় : পোল্যান্ড। সুপার সিক্সটিন : নক আউট সেকেন্ড রাউন্ড : মেক্সিকো-২ বুলগেরিয়া-০; বেলজিয়াম-৪ সো. ইউনিয়ন-৩; পোল্যান্ড-০; আর্জেন্টিনা-১ উরুগুয়ে-০; ইতালি-০; প. জার্মানি-১ মরক্কো-০; ইংল্যান্ড-৩ প্যারাগুয়ে-০; স্পেন-৫ ডেনমার্ক-১; কোয়ার্টার ফাইনাল: ফ্রান্স-১(৪) ব্রাজিল-১(৩) (টাইব্রেকারে ফ্রান্স জয়ী); প. জার্মানি-০(৪) মেক্সিকো-০(১) (টাইব্রেকারে প. জার্মানি জয়ী); আর্জেন্টিনা-২ ইংল্যান্ড-১; বেলজিয়াম-১(৫) স্পেন-১(৪) (টাইব্রেকারে বেলজিয়াম জয়ী); সেমি-ফাইনাল: প. জার্মানি-২ ফ্রান্স-০; আর্জেন্টিনা-২ বেলজিয়াম-০; তৃতীয় স্থান : ফ্রান্স-৪ বেলজিয়াম-২; ফাইনাল: আর্জেন্টিনা-৩ প. জার্মানি-২ (ভলডানো, ব্রাউন, বুরুচাগা) (রুমেনিগে-২) চ্যাম্পিয়ন : আর্জেন্টিনা রানার্স আপ : প. জার্মানি তৃতীয় স্থান : ফ্রান্স। এ্যাজটেক স্টেডিয়ামের ফাইনালে ম্যারাডোনা নিজে গোল করলেন না। কেননা তাকে কড়া পাহারায় রাখে জার্মান ডিফেন্ডারা। তবে তাকে পাহারায় রাখার পরও ফাঁক গলে বেরিয়ে গেলেন বারবার। গোলের সুযোগ করে দিলেন সতীর্থ ভলডানো, বুরুচাগা ও ব্রাউনকে। তারা গোল করলেন। আর্জেন্টিনা জিতলো ৩-২ গোলে। অনবদ্য খেললেন ম্যারাডোনা। জার্মান অধিনায়ক রুমেনিগে ও ভয়েলার গোল করলেও দলের পরাজয় এড়ানো সম্ভব হয়নি। উপর্যুপরি দ্বিতীয়বারের মতো আর্জেন্টিনা কাপ জিতলেও তৃতীয়বার কাপ জয়ের স্বপ্ন ভেস্তে গেল জার্মানদের। এ প্রতিযোগিতার টপ ফেবারিট ব্রাজিল আগেই বিদায় নিয়েছে। ম্যাচে নেই ইতালিও। ফ্রান্স ও বেলজিয়াম ভাল খেলেও হেরে গেছে। ফাইনালে টিকে আছে ল্যাটিন দল আর্জেন্টিনা ও ইউরোপের প. জার্মানি। প্রতিযোগিতার আগে আর্জেন্টিনাকে ফাইনালিস্ট তো দূরের কথা কোয়ার্টার ফাইনালিস্টও ধরা হয়নি। অথচ তারাই কাপ জিতে চমক দেখায়। মারিও কেম্পেসের কৃতিত্বে যেমন আর্জেন্টিনা ’৭৮’র বিশ্বকাপ জিতেছিল এবারের কাপ জয়ের কৃতিত্ব পুরোটাই ছিল দিয়েগো ম্যারাডোনার। ম্যারাডোনার যাদুকরি ফুটবল প্রতিভা সারা ফুটবল বিশ্বকে বিমোহিত করে। তৃতীয় স্থান পায় ফ্রান্স। তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে তারা ৪-২ গোলে হারায় বেলজিয়ামকে। ত্রয়োদশ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার নেতৃত্ব দেন বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা ফুটবলার দিয়েগো ম্যারাডোনা আর প. জার্মানির কার্ল হাইঞ্জ রুমেনিগে। ত্রয়োদশ বিশ্বকাপে মোট ১৪৬টি গোল হয়। ত্রয়োদশ বিশ্বকাপে সর্বাধিক গোল করেন ইংল্যান্ডের গ্যারি লিনেকার। তিনি এ বিশ্বকাপে ৬টি গোল করে ‘টপ স্কোরার’ হন। হ্যাট্রিক করেন ইংল্যান্ডের গ্যারি লিনেকার, স্পেনের বুত্রাগুয়েনা, সোভিয়েত তারকা বেলানভ। ত্রয়োদশ বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ পরিচালনা করেন ব্রাজিলের রেফারি আর পি ফিলহো। (চলবে) লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ লেখক পরিষদ বাংলাদেশ ও ভারতে প্রকাশিত দুই শতাধিক বইয়ের লেখক e-mail : [email protected]
×