ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রুমেল খান

এক পায়ের জাদুকর- ফেরেঙ্ক পুসকাস

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ২৫ এপ্রিল ২০১৮

এক পায়ের জাদুকর- ফেরেঙ্ক পুসকাস

১৯৫৩ সালের ২৩ নবেম্বর ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ফেরেঙ্ক পুসকাসের হৃষ্টপুষ্ট চেহারা এবং একক অনুশীলন দেখে উৎসাহী ইংরেজ দর্শকরা ভাবতেই পারেনি ঠিক দু’দিন পরেই তাদের জন্য কি নির্মম ভবিতব্য অপেক্ষা করছে! প্রায় এক লাখ দর্শক দু’দিন পরে অবাক বিস্ময়ে দেখেছিল বিশ্বের সর্বকালের সেরা বাঁ পায়ের প্রলয়। শেফিল্ডের ছুরির ধারে ছিন্নভিন্ন হয়েছিল ইংল্যান্ড ৬-৩ গোলের ব্যবধানে। দেশের মাটিতে সেই প্রথম ইংল্যান্ডের পরাজয়। বুদাপেস্টে এক বছরের মধ্যে পুসকাসের পায়ে আবার আত্মসমর্পণ করে ইংল্যান্ড ৭-১ গোলে। পরপর দুটি ম্যাচে ইংল্যান্ডের এ অবিশ্বাস্য নতি স্বীকার রাতারাতি খ্যাতির তুঙ্গে তুলে দেয় ইনসাইড লেফট পজিশনে খেলা পুসকাস ও তার ফুটবল শিল্পকে। ১৯৫২ সালে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন হাঙ্গেরি ‘৫৪ বিশ্বকাপে অন্যতম ফেবারিট হওয়া সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত রানার্সআপ হয় ফাইনালে পুসকাস আহত থাকায়, হাঙ্গেরির ফুটবলে সেটা ছিল সবচেয়ে বেদনাদায়ক অধ্যায়। বিশ্ব ফুটবলে এতদিন ধরে যত ফুটবলার স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল, তাদের মধ্যে পুসকাস হলেন যেমন অদ্বিতীয় তেমনি অনন্য। যে কোন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেকে সক্রিয় রাখতে তার মতো বড় ফুটবলার খুব একটা দেখা যায়নি। পুসকাসের বল নিয়ন্ত্রণ ছিল অসাধারণ। গতির টানে যে কোন খেলোয়াড়কে ফেলে রেখে বল নিয়ে ছুটতে পারতেন। তার এ গতিময় দক্ষতার জন্য সমালোচকরা তাকে ‘দ্য গ্যালপিং মেজর’ আখ্যা দিয়েছিলেন। পঞ্চাশের দশকে হাঙ্গেরি যে দুরন্ত দাপট বজায় রেখেছিল তার পেছনে ছিল পুসকাসের অসাধারণ ফুটবলশৈলী। দৈহিক ক্ষমতা ও প্রতিভার দিক দিয়ে তিনি যে শুধু দক্ষ ছিলেন তাই নয়, সেই সঙ্গে ছিল তার উদ্ভাবনী শক্তি। নতুন নতুন পরিকল্পনা রচনা করে তিনি দলের আক্রমণকে এমন সক্রিয় রাখতেন যে বিপক্ষের রক্ষণভাগের খেলোয়াড়রা তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারতেন না। চোখের পলকে বলকে পা থেকে টেনে এনে দুরন্ত শট করার ব্যাপারে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তার বাঁ পা অপেক্ষাকৃত মজবুত ও কঠিন, হাঙ্গেরিয়ানরা তাই একসময় তাকে বাঁ পায়ের জাদুকর বলতেন। তারা বলতেন, সরকার যেন পুসকাসের বাঁ পাটিকে সোনা দিয়ে মুড়িয়ে রাখে। সত্যিই তাই। বাঁ পায়ের রাজা পুসকাসের অধিকাংশ গোল এসেছে ওই পায়ের শট থেকেই। ডান পা তার অপেক্ষাকৃত দুর্বল হলেও সেটা কখনও বোঝা যায়নি। পুসকাস বাঁ পায়ের কৌশল দিয়ে ডান পায়ের দুর্বলতাকে এমনভাবে ঢেকে রেখেছিলেন যে কিছুতেই বোঝা যায়নি তিনি এক পায়ের ফুটবলার। অথচ খেলোয়াড় হিসেবে তার শারীরিক গঠন উদাহরণ দেয়ার মতো ছিল না। উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি। তার শরীরও ছিল স্থূল গোছের। অসাধারণ ফুটবল প্রতিভার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তার খেলার মধ্যে যে ত্রুটি ছিল না তা নয়। দুর্বলতা ছিল অনেক। কারণ খেলার মধ্যে তার একটি পায়ের ব্যবহারই দেখা গেছে বেশি। এ জন্য এক পায়ের খেলোয়াড় হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত। অর্থাৎ বাঁ পা। অচল ছিলেন হেড করার ব্যাপারেও। সচরাচর তাকে হেড করতে মাথা বাড়াতে দেখা গেছে কম। তবে হেড করতেন একেবারে উপায়ান্তর না থাকলে। বল কন্ট্রোল করার ক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে ছিল তার অভাবনীয় ফুটবল মেধা। নতুন নতুন পদ্ধতিতে নতুন প্রণালী প্রয়োগ করে পুসকাস আক্রমণ শানাতে ভালবাসতেন। সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন ব্যাপার ছিল তার রানিং ক্রসপাস। ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় বল পাস করতে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ১৯২৭ সালের ১ এপ্রিল হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে জন্মগ্রহণ (২০০৬ সালের ১৭ নভেম্বর ৭৯ বছর বয়সে মারা যান পুসকাস) করেন পুসকাস। ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি আগ্রহ ছিল তার। বড় মাঠে বড় খেলোয়াড়দের খেলা দেখে তিনি তা অনুসরণ করার চেষ্টা করতেন। কিসপেস্টের মাঠে পঞ্চাশ দশকের বিখ্যাত ম্যাজিক ম্যাজিয়াসের অন্যতম নায়ক পুসকাসের ফুটবল জীবন শুরু হয়। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। ১৬ বছর বয়সে তিনি কিসপেস্ট দলে যোগ দেন। এর দু’বছরের মধ্যে জাতীয় দলে নির্বাচিত হন। ১৯৪৯ সালে হাঙ্গেরি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কিসপেস্ট দলকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। সেনাবাহিনীর অধীনে চলে যায় কিসপেস্ট। ফলে কিসপেস্টের ফুটবলাররা মিলিটারি র‌্যাঙ্কের আওতায় আসেন। পুসকাস উন্নীত হন মেজর পদে। তার নিকনেম হয়ে যায় ‘দ্য গ্যালপিং মেজর’ যা আগেই বলা হয়েছে। ইনসাইড পজিশনের খেলোয়াড় হিসেবে তিনি যে শুধু দলকে পরিচালনা করতেন তাই নয়, সেই সঙ্গে তিনি লীগ ম্যাচে ৪ বার সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন। পুসকাস যে গোলমেশিন ছিলেন সেটি বোঝা যাবে তার ক্লাব ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গোলের সংখ্যা দেখলেই। তার ধারে কাছেও নেই আজকের মেসি-রোনাল্ডোরা। ক্লাব পর্যায়ে ৬২০ ম্যাচে ৬১৬ এবং হাঙ্গেরির হয়ে ৮৫ আন্তর্জাতিক ম্যাচে ৮৪ গোল! কী, চোখ কপালে উঠে যাচ্ছে নিশ্চয়ই! পঞ্চাশ দশকে হাঙ্গেরি বিশ্ব ফুটবলে যে চমক এনেছিল, তার মূলে ছিল ফেরেঙ্ক পুসকাসের অনমনীয় ভূমিকা। ১৯৫২ সালে হাঙ্গেরি অলিম্পিকে যে সোনার পদক জয় করেছিল তার মূল নায়ক ছিলেন পুসকাস। সেই শুরু হয়েছিল পুসকাসের সক্রিয় প্রাধান্যের দৌরাত্ম্য। ১৯৫৩ ও ১৯৫৪ সালে বলতে গেলে তিনি একক কৃতিত্বে ইংল্যান্ডকে বিধ্বস্ত করেন। ১৯৫৪ সালের বিশ্বকাপ পুসকাসের জীবনের এক স্মরণীয় অধ্যায়। বিশ্বকাপের ফাইনালে দুঃখজনক হারের পর তাকে নিয়ে হাঙ্গেরি ফুটবলে শুরু হয় চরম বিতর্ক। গ্রুপ পর্যায়ের খেলায় পুসকাসের অসাধারণ নৈপুণ্যে হাঙ্গেরি জার্মানিকে হারায় ৮-২ গোলের বিশাল ব্যবধানে। তবে সেই খেলায় পুসকাস মারাত্মক আহত হন। পরের ২টি ম্যাচে তিনি খেলতে পারেননি। তবুও তাকে ছাড়াই হাঙ্গেরি ফাইনালে পৌঁছায়। কারণ এ দলটিও ছিল বেশ পরিপক্ব। সবার ধারণা ছিল বিশ্বকাপ জিতবে হাঙ্গেরিই। ফাইনালের আগেও ফিট হতে পারেননি পুসকাস। তারপরও দেশের স্বার্থে আহত অবস্থায় মাঠে নামলেন। দশ মিনিটের মধ্যে হাঙ্গেরি ২-০ গোলে এগিয়ে যায়। প্রথম গোলটি আসে পুসকাসের পা থেকেই। পরে বৃষ্টির কারণে হাঙ্গেরি আক্রমণাত্মক না খেলে রক্ষণাত্মক কৌশল নেয়। এ সুযোগটাই নেয় জার্মানি। তারপরও পুসকাসের একটি অসাধারণ গোল রেফারি যে কি কারণে অফসাইডের অজুহাতে বাতিল করল কে জানে! না হলে ফলটা অন্যরকম হতে পারত। ১৯৫৬ সালে পুসকাস হনভেড দলের সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকা সফরে গেলেন। এ সময় হাঙ্গেরিতে শুরু হলো বিপ্লব। পুসকাস আর ফিরলেন না। তিনি বুদাপেস্টের মায়া ত্যাগ করে শুরু করলেন নতুন ফুটবল জীবন। যখন পেশাদার ফুটবলার হিসেবে জীবন শুরু করলেন তখন তার বয়স ত্রিশ। হাঙ্গেরির ফুটবল বিশেষজ্ঞরা বললেন, তার ফুটবল জীবনের গৌরব সূর্য ডুবে যাচ্ছে। স্বদেশের মাটিতে তার পক্ষে আর ফুটবল খেলা সম্ভব হবে না। তাছাড়া এখন তার আর সেই শারীরিক ক্ষমতা নেই। ফিটনেস নেই। যেজন্য পুসকাস নিজের দেশে সুনাম নষ্টের ভয়ে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু পুসকাস ভিন্ন ধাতুতে গড়া। নতুন করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ও সুনামকে তুলে ধরতে চাইলেন। স্পেনের রিয়াল মাদ্রিদ ক্লাবে যোগ দিলেন। দলে ছিলেন স্প্যানিশ ফুটবলের পথিকৃৎ আর্জেন্টাইন গ্রেট আলফ্রেডো ডি স্টেফানো। স্টেফানো-পুসকাস সমন্বয়ে ইউরোপীয় ফুটবলে নতুন করে জাগরণ তুলল রিয়াল মাদ্রিদ। রিয়াল দর্শকরাও পুসকাসকে সমাদরেই গ্রহণ করলেন। স্টেফানো আর তার সম্মিলিত আক্রমণে রিয়াল পাঁচবার লীগ জয়ের কৃতিত্ব পেল। চারবার সর্বোচ্চ গোলদাতা হলেন পুসকাস। ইউরোপিয়ান কাপের ৩৭টি ম্যাচে রিয়ালের হয়ে গোলমেশিন পুসকাস করেন ৩৫টি গোল। স্পেনের জাতীয় দলের হয়ে পুসকাস চারটি আন্তর্জাতিক ম্যাচে অংশ নিয়েছিলেন। এর মধ্যে প্রথমটি ছিল বিশ্বকাপের কোয়ালিফাই ম্যাচ মস্কোর বিরুদ্ধে। পরের ৩টি ১৯৬২’র বিশ্বকাপ। সেই বিশ্বকাপে স্পেনের ফল খারাপ হলেও পুসকাস ছিলেন নিজস্ব স্বকীয়তায় ভাস্বর। ইউরোপিয়ান কাপের খেলায় ইন্টার মিলানের বিরুদ্ধে পুসকাস শেষ অংশ নিয়েছিলেন ১৯৬৪ সালে। শেষ পর্যন্ত চল্লিশ বছর বয়সে ফুটবল থেকে পুসকাস বিদায় নেন। ইউরোপিয়ান ফুটবলে সেরা ফুটবলারদের কথা উঠলে প্রথমেই চলে আসে পুসকাসের নাম। খেলোয়াড় হিসেবে তিনি যেমন মাঠের মধ্যে বড়, তেমনি মাঠের বাইরেও একজন আন্তরিক মানুষ হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন। দর্শকদের কাছেও তার জনপ্রিয়তা কম ছিল না। তাইতো পঞ্চাশ দশকে হাঙ্গেরি আর ষাটের দশকে স্পেনের মাঠে লাখো দর্শক সমস্বরে চিৎকার করেছেন, ‘পুসকাসÑ দ্য গ্যালপিং মেজর দ্য বেস্ট ফুটবল অব দ্য ওয়ার্ল্ড।’
×