ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ফেনীর উদ্দেশ্যে কবি বেলাল চৌধুরীর মরদেহ

প্রকাশিত: ০১:৪১, ২৫ এপ্রিল ২০১৮

ফেনীর উদ্দেশ্যে কবি বেলাল চৌধুরীর মরদেহ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের পর ফেনীর উদ্দেশ্যে নেয়া হচ্ছে কবি বেলাল চৌধুরীর মরদেহ। সেখানে কবির নিজ গ্রাম শর্শদির পারিবারিক কবর স্থানে বাবা মায়ের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন ষাটের দশকের অন্যতম কবি বেলাল চৌধুরী। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উদ্যোগে কবিকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বুধবার সকালে। তার মরদেহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শহীদ মিনারে আনার পর কবি-সাহিত্যিক ও প্রিয়জনদের উপস্থিতিতে পরিবেশ বেদনার্ত হয়ে ওঠে। কবির মরদেহ আনার সময় সঙ্গে ছিলেন তার ছেলে আব্দুল্লাহ ইউসুফ প্রতীক চৌধুরী, ভাতিজা অধ্যাপক-অনুবাদক রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী, জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি মুহম্মদ সামাদসহ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নেতারা। শহীদ মিনারে প্রথম কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। এসময় তিনি বলেন, কবি বেলাল চৌধুরী তার কবিতার মাধ্যমে আমাদের প্রিয় মূল্যবোধগুলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এরপর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বেলাল চৌধুরীর সঙ্গে তার সখ্যতার কথা বলেন। তার স্মৃতিচারণ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, তার চোখে কবি বেলাল চৌধুরী ছিলেন সাহিত্যের বটবৃক্ষ। তিনি ছিলেন ভিন্ন মাত্রার কবি। তার কবিতায়, লেখনীতে বারবার বাংলার মাটি, মানুষ ও আকাশের কথা উঠে এসেছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, কবি বেলাল চৌধুরী কলকাতাতেও সমান জনপ্রিয়। শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। তিনি বলেন, দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও কবিতা আন্দোলনে কবি বেলাল চৌধুরী অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের কবিদের সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের সেতুবন্ধন তিনি রচনা করে গেছেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। এসময় তিনি বলেন, বেলাল চৌধুরীর কবিতা আমাদের ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে। বেলাল ভাই সারা জীবনভর দেশের মানুষ আর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলেছেন। পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ নিজের কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি প্রকাশ করেছেন। সব সময় মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন আপাদমস্তক বাঙালি এই মানুষটি। সংস্কৃতিকর্মীরা কোনো বিপদে পড়লেই সবার আগে কবি বেলাল চৌধুরীর দ্বারস্থ হতেন। মন্ত্রী আশা করেন, নতুন প্রজন্মের কবিরা কবি বেলাল চৌধুরীর ভাবনা-চিন্তাকে ধারণ করে সাহিত্যাঙ্গনে একটি নতুন ক্ষেত্র তৈরি করবেন। কবির নশ্বর দেহটি না থাকলে তার স্বীয় সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি চর্চিত হবেন, মূল্যায়িত হবেন বলেও বিশ্বাস তার। তিনি বলেন, আশির দশকে দর্শনীর বিনিময়ে কবিতা পাঠের আসর শুরু হলে তাতে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন কবি বেলাল চৌধুরী। কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী বলেন, পশ্চিমবঙ্গের রূঢ়, কঠিন আবহাওয়ার সঙ্গে বাংলার কোমল আবহাওয়ার মেলবন্ধন ঘটিয়ে একটি নতুন আবহে নবপ্রণালী রচনা করে গেছেন কবি বেলাল চৌধুরী। জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি মুহম্মদ সামাদ বলেন, তার কাব্যসম্ভার বলে দেয়, দেশের মানুষ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি কতটা দায়বদ্ধ ছিলেন তিনি। কবিকে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, কবি রবিউল হুসাইন, মুহাম্মদ নুরুল হুদা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, অধ্যাপক অজয় রায়, সাংবাদিক হারুন হাবীব, আনোয়ারা সৈয়দ হক, কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাত, কবি নাসির আহমেদ, স্থপতি শামসুল ওয়ারেস, নাট্যজন ইনামুল হক, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন, কবি নূহ-উল-আলম লেনিন, কবি কামাল চৌধুরী প্রমুখ। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কবিকে শ্রদ্ধা জানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সঙ্গীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ, উদীচী, রাইটার্স ক্লাব, শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতি, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, বঙ্গবন্ধু লেখক পরিষদ, কথা আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্র, ঋষিজ, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, ভারতীয় দূতাবাসসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শেষে বেলাল চৌধুরীর ছেলে আব্দুল্লাহ ইউসুফ প্রতীক চৌধুরী বলেন, বাবা অসুস্থ থাকার সময় অনেকে সহযোগিতা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকার ও বিশিষ্টজনদের সহযোগিতার কথা স্মরণ করেন তিনি। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর পর কবির মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গ্রামের বাড়ি ফেনীর শর্শদিতে। সেখানে মায়ের কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হবে। বেশ কিছুদিন থেকেই কবি বেলাল চৌধুরী অসুস্থ। এজন্য তার ২০১৪ সালের পর থেকে মাঝে মাঝেই হাসপাতালে যেতে হচ্ছিল। শেষবারের মত হাসপাতালে নেওয়া হয় ১৮ এপ্রিল। টানা কয়েক দিন লাইফসাপোর্টে থাকার পর ২৪ এপ্রিল মঙ্গলবার দুপুর ১২ টা ১মিনিটে রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর মঙ্গলবার বাদ মাগরিব পল্টন জামে মসজিদে তার প্রথম জানাজা হয়। প্রথম জানাজা শেষে কবির মরদেহ রাখা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের হিমাগারে। কবি বেলাল চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৮ সালের ১২ নবেম্বর। সে হিসেবে প্রায় ৮০ বছরের জীবন। একেবারে ছোট নয়। এই এক জীবনে বহু কাজ করেছেন ফেনির সন্তান বেলাল চৌধুরী। নয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। কবি হিসেবেই তিনি বেশি পরিচিত কিন্তু তিনি আসলে বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী একজন মানুষ। বামপন্থি রাজনীতিতে জড়িয়েছেন। ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। জেল খেটেছেন। পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষুকে ফাঁকি দিয়ে কলকাতা গিয়ে উদ্বাস্তু জীবন কাটিয়েছেন। অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। প্রবন্ধ লিখেছেন। বিদেশি সাহিত্য থেকে অনুবাদ করেছেন। সাংবাদিকতা করেছেন। পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেছেন। চুটিয়ে আড্ডা দিয়েছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিখ্যাত ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা সম্পাদনায় অংশ নিতে পারা ছিল তার জীবনের এক উজ্জ্বল ঘটনা। প্রায় দেড় দশককাল স্থায়ী হয়েছিল তার কলকাতা জীবন। ১৯৭৪ সালে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। নতুন করে শুরু হয় তার যাত্রা। যোগ দেন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনে। সে সময়ে জাতীয় কবিতা পরিষদ ও পদাবলী কবিতা সংগঠন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। পল্লীবার্তা, সচিত্র সন্ধানী ও ভারত বিচিত্রা পত্রিকার সম্পাদনায় যুক্ত ছিলেন। কবিতা, গদ্য, অনুবাদ, সম্পাদনা, শিশুসাহিত্য মিলিয়ে বেলাল চৌধুরীল গ্রন্থ সংখ্যা পঞ্চাশের বেশি। ‘বল্লাল সেন’, ‘ময়ূর বাহন’, ‘সব্ক্তুগীন’ ছদ্মনামেও তিনি লিখেছেন। তার কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘নিষাদ প্রদেশে’, ‘আত্মপ্রতিকৃতি’, ‘স্থির জীবন ও নিসর্গ’, ‘জলবিষুবের পূর্ণিমা’, ‘সেলাই করা ছায়া’, ‘কবিতার কমলবনে’, ‘বত্রিশ নম্বর’, ‘যে ধ্বনি চৈত্রে শিমুলে’, ‘বিদায়ী চুমুকে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তার কথাসাহিত্য, প্রবন্ধ ও গবেষণা গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ‘স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল’, ‘ডুমুরপাতার আবরণ’, ‘চেতনার রঙ চন্দ্রশিলা’ এবং ‘লাকসাম দাদা ও অন্যান্য গল্প’। ‘কাগজে কলমে’, ‘মিশ্রচিত্রপট’, ‘নিরুদ্দেশ হাওয়ায় হাওয়ায়’, ‘জীবনের আশ্চর্য ফাল্গুন’, ‘নবরাগে নব আনন্দে’, ‘সুন্দরবন, সোঁদরবন ও রবীন্দ্রনাথ’, ‘মুহূর্তভাষ্য’ ইত্যাদি তার গদ্যনির্ভর গ্রন্থ। শিশু-কিশোরদের জন্য বেলাল চৌধুরী লিখে গেছেন, ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’, ‘সপ্তরত্নের কাণ্ডকারখানা’, ‘সবুজ ভাষার ছড়া’। নিজে লেখার পাশাপাশি হোর্হে লুই বোর্হেস, পাবালো নেরুদা, ডিলান টমাস, অক্তাবিও পাসের মতো কবিদের লেখা তর্জমা করেছেন বেলাল চৌধুরী; সম্পাদনা করেছেন বেশ কিছু স্মারকগ্রন্থ। তার সম্পাদিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘জলের মধ্যে চাঁদ ও অন্যান্য জাপানি গল্প’, ‘বিশ্বনাগরিক গ্যেটে’, ‘পাবলো নেরুদা-শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি’, ‘শামসুর রাহমান সংবর্ধনাগ্রন্থ’, ‘পদাবলী কবিতা সংকলন’ ও ‘কবিতায় বঙ্গবন্ধু’। সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৪ সালে একুশ পদক লাভ করে কবি বেলাল চৌধুরী। পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, নীহাররঞ্জন স্বর্ণপদক, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কারসহ নানা সম্মাননা। এক মেয়ে সাফিয়া আক্তার চৌধুরী মৌরী এবং দুই ছেলে আব্দুল্লাহ প্রতীক ইউসুফ চৌধুরী ও আব্দুল্লাহ নাসিফ চৌধুরী পাবলোকে রেখে গেছেন বেলাল চৌধুরী।
×