ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কবির প্রয়াণ

প্রকাশিত: ০৪:০০, ২৬ এপ্রিল ২০১৮

কবির প্রয়াণ

চলে গেলেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এক বরেণ্য কবি। ‘বোহেমিয়ান’ অভিধাটি যার নামের পরতে পরতে লেগে আছে। অন্যতর এক জীবন প্রবাহে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। কবি হিসেবে তিনি তার সমাজে নিজের ঔজ্জ্বল্যকে অনুভব করতে সক্ষম হয়েছেন। অনুপ্রাণিত ছিলেন সবসময়। শুধু কবি না, ছিলেন অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক এবং সাংবাদিক। যেখানে হাত দিয়েছেন, সেখানেই ফলেছে সোনা। পত্রিকা সম্পাদনায় তার দক্ষতার তুলনা নেই। শুধু সস্তা জনপ্রিয়তা ও ভঙ্গি সর্বস্বতাই কাব্যের কোন প্রধান শক্তি হতে পারে না বলে তিনি সাহসের সঙ্গে উচ্চারণ করতেন। বিশ্বাস করতেন কাব্য রচনায় যুগপৎ প্রতিভা, মনন ও শ্রমের বিকাশ না ঘটাতে পারলে, সমাজের মানুষের কল্যাণে হৃদয়ের ভাষার সঙ্গে কবিদের হৃদয়ের ভাষাকে সংহত করতে না পারলে, মহিমা ও মুক্তির পথ ফুটিয়ে তুলতে না পারলে কেবল আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব আর ভাষার চাতুর্যের দ্বারা জাতির সঙ্গে কবির মিলন অসম্ভব। এ জন্য সবধরনের কবির মধ্যে সত্যসম্বন্ধ গড়ে তোলা প্রয়োজন। কারণ হিসেবে বলেছেন, সৌন্দর্য ও সত্যকে অবলম্বন করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব। কবি বেলাল চৌধুরী সুদীর্ঘ বর্ণাঢ্য কিংবা বোহেমিয়ান জীবনযাপন শেষে সংসারী হয়ে থিতু হয়েছিলেন। ছাত্রজীবনে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকায় গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি হয়েছিল। গ্রেফতার এড়াতে দেশ ছেড়ে চলে যান জাহাজে করে। পরে কলকাতায় থিতু হন। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘কৃত্তিবাস’ সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সম্পাদনাও করেছেন। অন্তরঙ্গ ছিলেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, তুষার রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও কমল কুমার মজুমদারের সঙ্গে। সেখানে শ্মশানে ঘরভাড়া করে থেকেছেন। একদিন মাছ ধরার ট্রলারে চড়ে অজানায় পাড়ি দিয়েছেন। অভিজ্ঞতার ভা-ার ছিল তার অফুরান। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। দুহাতে লেখালেখি করেন। সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানীর প্রথম সম্পাদক ছিলেন। দৈনিক রূপালি পত্রিকাও সম্পাদনা করেন। ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাস থেকে প্রকাশিত ‘ভারতবিচিত্রা’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন দীর্ঘদিন। জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং ২০১৪ সালে একুশে পদক পেয়েছেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ নিষাদ প্রদেশে, ১৯৬৪ সালে বেরোয়। বেলাল চৌধুরীর কবিতা (১৯৬৮), আত্মপ্রতিকৃতি, স্থিরজীবন ও নিসর্গ (১৯৭৫), স্বপ্নবন্দী (১৯৮৪), সেলাই করা ছায়া (১৯৮৫), কবিতার কমলবনে (১৯৯২), বত্রিশ নম্বর (১৯৯৭), ভালোবাসার কবিতা (১৯৯৭), যাবজ্জীবন সশ্রম উল্লাস (১৯৯৮), যে ধ্বনি চৈত্র, শিনদাল (২০০৮)। এ ছাড়া প্রবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনী, শিশুসাহিত্য, শীর্ষক ছয়টি গ্রন্থ ঢাকা থেকে প্রকাশ হয়। সম্পাদনা ছাড়াও অনুবাদ গ্রন্থও রয়েছে। ফেনীর শর্শাদি গ্রামে ১৯৩৮ সালের ১২ নবেম্বর কবি বেলাল চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন। আশি বছর বয়সে ২৪ এপ্রিল দুপুরে ইহলোক ত্যাগ করেন। মৃত্যুর চারদিন আগে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। ভবঘুরে সজীব কবি ছিলেন বাংলাদেশের শিল্পসাহিত্যাঙ্গনে অত্যন্ত জনপ্রিয়। আড্ডায় ছিলেন মধ্যমণি। বঙ্গবন্ধুকে ভালবেসে কবি বাংলাদেশকে নিবিড় করে নিয়েছিলেন। বাঙালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী বেলাল চৌধুরী রেখে গেছেন অজ¯্র অমর বহুকীর্তি। লিখেছিলেন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে, “আমার সর্বাঙ্গ ছেঁকে ধরেছে মাছির মতো/বিস্ফোটক দগদগে ঘা পুঁজ আর শটিত গরল/গোপন পাপের শরশয্যায় শুয়ে আমি/নিদারুণ তৃষ্ণায় ছটফট করছিÑ হায়রে জলধারা। কিন্তু এবার ওরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞÑ নিষ্কৃতি নেই আমার/নির্বাসনে মৃত্যুদ-Ñ ঠা-া চোখে দেখছি আমি/নীল কুয়াশায় ঢাকা পড়েছে আমার দেহ।” কবি বেলাল চৌধুরী আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু রয়ে গেছে তার সেলাই করা ছায়া। তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
×