ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন ধানের দামে খুশি কৃষক;###;শিলাবৃষ্টি ও ব্লাস্টের ক্ষতি খুবই কম ;###;হাওড় এলাকায় দ্রুত ধান ঘরে তোলার জন্য মাইকে আহ্বান জানানো হচ্ছে

বোরো হবে ২ কোটি টন ॥ রেকর্ড ফলন

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২৬ এপ্রিল ২০১৮

বোরো হবে ২ কোটি টন ॥ রেকর্ড ফলন

কাওসার রহমান ॥ দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ। যতদূর চোখ যায় শুধু সোনালি আভা ছড়ানো ধানের শীষ। মাঝেমধ্যেই চোখে পড়ে আধা পাকা ধানের শীষের সমারোহ। আর কিছু দিনের মধ্যেই আধা পাকা ক্ষেতগুলোও ছড়াবে সোনালি আভা। সেই কাক্সিক্ষত ফসল ঘরে তোলার স্বপ্নে বিভোর কৃষক। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, নানা শঙ্কা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে এ বছর সারাদেশে বোরো ধানের রেকর্ড বাম্পার ফলন হয়েছে। তাদের আশা, ব্লাস্ট কিংবা শিলাবৃষ্টি সত্ত্বেও এবার প্রথমবারের মতো দেশে বোরোর উৎপাদন ২ কোটি টনে গিয়ে দাঁড়াবে। কারণ ব্লাস্ট কিংবা শিলাবৃষ্টিতে ফসলের সামান্যই ক্ষতি হয়েছে। বিপরীতে সারাদেশেই বোরো আবাদের আওতা এবং উৎপাদন বেড়েছে। ফলে বড় কোন দুর্যোগ না হলে এবার মোট বোরোর ফলন দুই কোটি টনে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। আর কৃষি বিভাগের এই আশাবাদ সত্যি হলে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনে একটি মাইলফলক অর্জিত হবে। হাওড়বাসী অবশ্য সবার আগে সেই বাম্পার ধান কাটার উৎসবে মেতে উঠেছে। ইতোমধ্যে হাওড়াঞ্চলের সাত জেলায় পুরোদমে ধান কাটা শুরু হয়েছে। দুই বছর পর আবার ধান কাটার মহোৎসবে মেতে উঠতে পেরে হাওড়বাসী ভীষণ আনন্দিত। সারাদেশের মতো, এবার হাওড়বেষ্টিত ৭টি জেলায় শুধু ধানের আবাদই বাড়েনি, ফলনও অনেক বেড়েছে। যা গত বছরের ফসলহানির ক্ষতি অনেকটাই পুষিয়ে দেবে বলে কৃষকরা মনে করছে। এ বছর সারাদেশে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪৭ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে। অনুকূল আবহাওয়া এবং ধানের চড়া দামের কারণে কৃষক এবার বোরো আবাদের দিকে বেশি মনোযোগ দেয়। ফলে সারাদেশে বোরো আবাদ ৪৮ লাখ হেক্টর ছাড়িয়ে যায়। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, বাজারে চালের উচ্চ মূল্যই কৃষকদের বোরো আবাদে আকৃষ্ট করেছে। গত দুই মৌসুমেই ধানের দাম বেশি থাকায় তারা এবার কোন জমিই পতিত রাখেনি। কারণ আলুর চেয়ে এখন ধান বেশ লাভজনক। তাছাড়া বিদ্যুতের সরবরাহ ভাল থাকার কারণে কৃষকরা সঠিক সময়ে জমিতে সেচ দিতে পেরেছে। সার ব্যবস্থাপনাও ছিল পর্যাপ্ত। জমিতে পোকামাকড়ের আক্রমণ ছিল না বললেই চলে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছর বন্যার পর ফসলের মাঠ যেমন উর্বর হয়েছে, তেমনি এবার আবহাওয়াও ছিল বোরো চাষের জন্য অনুকূল। সেই সঙ্গে পানি সরবরাহ স্বাভাবিক ছিল। পাশাপাশি ছয় লাখ কৃষককে প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। যার ফলে এবার শুধু বোরো আবাদই বাড়েনি, ফলনও খুব ভাল হয়েছে। এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে কৃষক বোরোর এই বাম্পার ফলন ঘরে তুলতে সক্ষম হবে। কৃষকের কথাতেও এবার বোরোর বাম্পার ফলনের সত্যতা পাওয়া যায়। রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার রামনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের কিসমত ঘাটাবিল এলাকার কৃষক মামুন মিয়া বলেন, ‘জমি দেখলে মনটা ভরে যায়। কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এবার আমরা ধানের বাম্পার ফলন ঘরে তুলতে পারব।’ তিনি বলেন, ‘আল্লাহ রহমতে এখন পর্যন্ত ধানে তেমন কোন পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা যায়নি। আশা করছি, গত কয়েক বছরের চেয়ে এবার ভাল ধান পাব।’ এখন পর্যন্ত বড় কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলেও সম্প্রতি শিলাবৃষ্টিতে ফসলের কিছু ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া দেশের কোন কোন এলাকায় বোরো ধানের ক্ষেত্রে ব্লাস্ট রোগ দেখা দিয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতি খুবই নগন্য। আর এ পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলায় ৪৯৩ হেক্টর জমিতে ব্লাস্ট রোগ দেখ দিয়েছিল। এর মধ্যে ৪৬৯ হেক্টর জমির ব্লাস্ট রোগ গমন করা হয়েছে। বাকি ২৪ হেক্টর জমির ব্লাস্ট রোগ দমনের পর্যায়ে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ‘ব্লাস্ট রোগের ব্যাপারে এবার আমরা আগে থেকেই সতর্ক ছিলাম। এ বিষয়ে নানাভাবে সচেতন করেছি। তাদের মাঝে লিফলেট বিতরণ করেছি, মাইকিং ও উঠান বৈঠক হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে কৃষকদের সর্বক্ষণ পরামর্শ দিচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় মাইকিং করছে। ফলে এবার ব্লাস্ট রোগ অনেকটাই দমন করা সম্ভব হয়েছে। কেবলমাত্র ২৪ হেক্টর জমি অদমনকৃত অবস্থায় আছে। যা দমন করার জন্য কৃষকদের সব ধরনের সহায়তা করা হচ্ছে।’ গত বছর এই সময়টায় বিষাদে তিক্ত ছিল হাওড় পাড়ের মানুষের জীবন। গত বছর অকাল বন্যা ভাসিয়ে নিয়েছিল কৃষকের কষ্টে বোনা স্বপ্নের ধান। তখন ছিল শুধু কৃষকের কান্না আর হাহাকার। তবে প্রকৃতি এবার দু’হাত ভরে দান করেছে কৃষকদের। বাতাসে দোল খাচ্ছে সোনারাঙা পাকা ধান। তা দেখে কষ্টের সেই দিনগুলোর কথা ভুলে, আবারও নতুন স্বপ্ন দেখছেন তারা। সেই হাওড়েই এখন চলছে চলছে ধান কাটার উৎসব। শুধু ব্রি-২৮ নয়, এখন ব্রি-২৯ ধানও কাটা শুরু হয়ে গেছে। ধান কাটাকে কেন্দ্র করে কিষান-কিষানীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে হাওড়াঞ্চল ও গ্রামীণ জনপদ। কর্ম ব্যস্ততায় এখন হাওড়ে হাওড়ে বইছে বাংলার সেই চিরাচরিত রূপ। একদিকে বাম্পার ফলন অন্যদিকে ফসল হারানোর সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যাওয়ায় কৃষকরা ধান কাটা, মাড়াই-ঝাড়াই ও ধান গোলায় তোলার কাজে এতটুকু সময় নষ্ট করতে নারাজ। গত বছরের ফসল হারা কৃষকরা এখন আর পেছনে ফিরতে চায় না। প্রত্যেকটি হাওড়েই এখন বোরো ফসল কাটার ধুম পড়েছে। আর ১৪-১৫ দিনের মধ্যেই কৃষকরা তার ফসল ঘরে তুলতে পারবে। এ প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ মহসীন বলেন, হাওড়ে ধান আবাদের প্যাটার্ন আমরা পরিবর্তন করার চেষ্টা করছি। বেশি ফলনের আশায় হাওড়ের কৃষকরা ব্রি ধান-২৯ বেশি আবাদ করে। এতে উৎপাদন বেশি হলেও ধান কাটতে সময় বেশি লাগে। কিন্তু কৃষকদের জন্য ঝুঁকি থেকে যায়। তাই আমরা তাদের বুঝিয়ে ব্রি-২৮ জাতের ধান আবাদে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছি। এতে আমরা অনেকটা সফল হয়েছি। তিনি বলেন, আগাম জাতের ধান আবাদের কারণেই এখন হাওড়ে ধান কাটার উৎসব চলছে। আশা করছি, মে মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই হাওড়বাসী তাদের উৎপাদিত সব ধান ঘরে তুলতে সক্ষম হবে। মোহাম্মদ মহসীন বলেন, আমরা এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সফল হয়েছি সুনামগঞ্জে। ওখানে ৬৫ শতাংশ জমিতেই ২৮ জাতের ধান আবাদ হয়েছে। আর ৩৫ শতাংশ জমিতে ২৯ ও হাইব্রিড জাতের ধান আবাদ হয়েছে। জনাব মহসীন বলেন, ২৮ ধান আবাদের সুবিধা হলো, এই ধান ১৪০ দিনে কাটা যায়। আর ২৯ জাতের ধান কাটতে হয় ১৬০ দিন পর। ২০ দিন আগে ২৮ জাতের ধান কাটা যায় বলে আগাম বন্যার ঝুঁকিও অনেকটা কমে যায়। তাই আগামী বছরগুলোতে শুধু হাওড়াঞ্চলে আমরা কৃষকদের ২৮ জাতের ধান আবাদে উৎসাহ দেব। উল্লেখ্য, মৌলভীবাজার জেলাতেও এবার ২৮ জাতের ধান বেশি আবাদ হয়েছে। এ জেলাজুড়ে আবাদকৃত বোরো ধানের মধ্যে ব্রি-২৮ ধান ৬০ ভাগ ও ব্রি-২৯ জাতের ধান ৪০ ভাগ জমিতে আবাদ হয়েছে। এ বছর সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে সজাগ দৃষ্টি ছিল হাওড়ের দিকে। শুধু ধান আবাদের সহযোগিতাই নয়, সেই ধান যাতে নির্বিঘেœ কৃষক ঘরে তুলতে পারে সে ব্যাপারে সচেষ্ট ছিল সরকার। কৃষি বিভাগ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হয়েছে কৃষকদের। ঘন ঘন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষকদের আরও দক্ষ ও সচেতন করা হয়েছে। পাশাপাশি কৃষি পুনর্বাসনের আওতায় প্রান্তিক কৃষককে বীজ, সার ও নগদ ১ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মরত সব ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া আছে। বন্যা দেখা দিলে আধা পাকা এবং খাওয়ার উপযোগী ধান কেটে নেয়ার কৌশলও বলে দেয়া হয়েছে। তাছাড়া যদি আগাম বন্যা হয়, তাহলে তা প্রথমে সুনামগঞ্জে হবে। তার দুই-তিন দিন পর কিশোরগঞ্জে ঢলের পানি আসা শুরু করবে। এবার এমন কিছু হলে দুই-তিন দিনের মধ্যে দেশি প্রযুক্তির মাধ্যমে সঙ্কট উত্তরণের চেষ্টা করা হবে। অন্যদিকে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রেও সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর নজরদারি ছিল। ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে সরকারের এই কঠোর নজরদারি থাকায় বাঁধ গুলোর অবস্থাও ভাল রয়েছে। আবার ধানকাটা মৌসুমের আগেই ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজও সমাপ্ত হয়েছে। এতে কৃষক অনেকটা স্বস্তিতে আছে। আগাম বন্যায় ফসলহানির সম্ভাবনা অনেকটাই কেটে গেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিবাহী প্রকৌশলী মোঃ আক্তারুজ্জামান জানিয়েছেন, এবার আগাম বন্যা এলেও ধানের তেমন ক্ষতি হবে না। কারণ ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ৯০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। বাঁধ গুলোও মজবুত করে নির্মাণ করা হয়। বন্যার আগাম হুমকি থেকে ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে হাজার কোটি টাকার বোরো ফসল রক্ষা করা হয়েছে। হাওড় উন্নয়ন পরিষদ নেত্রকোনার সভাপতি স্বাগত সরকার শুভ বলেন, অন্য বছরের তুলনায় এবার বাঁধ সংস্কার কাজ অনেকটা ভাল হয়েছে। এ বছর ধানের ফলনও ভাল হয়েছে। কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা না দিলে ফসলের বাম্পার ফলন হবে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, হাওড়াঞ্চলের জেলাগুলোয় এবার ৯ লাখ ১৫ হাজার ৯২৪ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জে এক লাখ ৬৫ হাজার ৫০০ হেক্টর, সুনামগঞ্জে দুই লাখ ২৪ হাজার, নেত্রকোনায় এক লাখ ৮২ হাজার ৪০০, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক লাখ সাত হাজার ৫৫২, সিলেটে ৭৪ হাজার ১২০, মৌলভীবাজারে ৫২ হাজার ৩৫২ এবং হবিগঞ্জে এক লাখ ১০ হাজার হেক্টর রয়েছে। আর এ থেকে চাল উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৫ লাখ ২৬ হাজার ৩০৭ টন। তবে গত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হাওড়াঞ্চলের কৃষক এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে বোরো আবাদ করেছে। হাওড়বেষ্টিত ৭টি জেলায় সব মিলিয়ে ৯ লাখ ৪৬ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। আর শুধু হাওড় এলাকায় বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৪৬ হাজার হেক্টর। আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৪৮ হাজার হেক্টর জমিতে। বোরো ধানের বাম্পার ফলনে হাওড়ের কৃষকদের চোখেমুখে আনন্দের ছাপ। ইটনার ইরাবিরা হাওড়ের কৃষক মহির উদ্দিনের বলেন, গতবার ৫০০ কাঠা জমিতে বোরো চাষ করেছিলাম। এবার চাষ করেছি ১২০০ কাঠা জমিতে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে, কম করে হলেও ১২শ’ মণ ধান পাবো। গত বছর কোন ধান ঘরে তুলতে পারিনি। তাই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আমার মতো অনেক কৃষকই এবার বেশি জমিতে ধান চাষ করেছেন। সুনামগঞ্জের কৃষক আলাউদ্দিন শেখ বলেন, ‘এবার যে ধান হয়েছে তা ঠিকমতো ঘরে তুলতে পারলে এবং সরকার দাম ভাল দিলে গতবারের দুঃখ কিছুটা হলেও ভুলতে পারব। তবে এখন সামনের কয়েকটা দিন খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় বন্যার পানি, ঝড়, শিলাবৃষ্টির ভয় আছে। ভালোয় ভালোয় পার করতে পারলে মনে শান্তি আসবে।’ জমির পাকা ধানে কাচি টান দিতে দিতে হাওড় পাড়ের সন্দ্র কুমার দাস বলেন, ‘গতবার তো ধানের গোটা দেখি নাই, এইবার ধানও হাতে পাইছি। কিছু ২৮ ধান কাটছি, এর মধ্যে এক মণ ধান এক হাজার টাকায় বিক্রিও করেছি।’ তিনি জানান, এবার ২৮ ধান প্রতি একরে ৩০ থেকে ৩২ মণ হবে। ২৯ ধান হবে প্রতি একরে ৪৫ থেকে ৪৭ মণ। হাওড়াঞ্চলে ধানের বাম্পার ফলন হলেও শ্রমিক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। কৃষকরা জানান, ইতোমধ্যে হাওড়ের ধান প্রায় ৬০ ভাগেরও বেশি পেকে গেছে। কিন্তু শ্রমিক সঙ্কটের ফলে সময়মতো ধান কেটে মাড়াই দেয়া যাচ্ছে না। চড়া দাম দিয়েও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এবার ফাল্গুনের আগেই পাবনা-সিরাজগঞ্জ, কুমিল্লা, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন এলাকার শ্রমিক সর্দাররা এসে গৃহস্থদের কাছ থেকে শ্রমিক নিয়ে আসার জন্য অগ্রিম টাকা নিয়ে গেছে। কিন্তু অনেক সর্দারই শ্রমিক নিয়ে আসেনি। এমনকি গৃহস্থদের ফোনও রিসিভ করছে না। ফলে জেলার বাইরে থেকে শ্রমিক এনে ধান কাটানো হচ্ছে। এতে করে বাড়তি খরচও হচ্ছে। হাওড়ে একসঙ্গে অনেক জমির ধান পেকে যায়। এগুলো কাটতে বাইরে থেকে মানুষ ভাড়ায় আনতে হয়। আগে মজুরি হিসেবে তারা ধানের ভাগ নিত। কিন্তু এবার তারা টাকা চাইছে। ফলে অনেক কৃষককে জমিতে ধান রেখেই তার একটি অংশ বিক্রি করতে হচ্ছে। উৎপাদিত ধানের দাম নিয়েও কৃষকদের মধ্যে স্বস্তি ও অস্বস্তি দুই দেখা যাচ্ছে। বর্তমানে হাওড়াঞ্চলে এলাকাভেদে কাঁচা ধান ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। ৭০০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি করে স্বস্তিতে রয়েছে কৃষক। তারা মনে করেন, শেষ পর্যন্ত এ দামটাই যদি তারা পান তাহলেই খুশি হবেন তারা। তবে যারা প্রতিমণ ধান ৬শ’ টাকা থেকে ৬২০ টাকায় বিক্রি করছেন তাদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। তবে এশিয়ার বৃহত হাওড় হাকালুকির দুই লাখ মানুষ আবহাওয়া নিয়ে আতঙ্কে আছেন। হাকালুকি হাওড় পাড়ের ভুকশিমইল ইউনিয়নের কৃষক মাসুক মিয়া জানান, গত বছরের অকাল বন্যায় তলিয়ে গেছে হাওড় পাড়ের কৃষকদের শতভাগ বোরো ধান। অর্থনৈতিক দৈন্যদশার পাশাপাশি সীমাহীন খাদ্য সঙ্কটে পড়া কৃষকরা এবার বোরো চাষ করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু ঘন ঘন বৃষ্টি তাদের মনে শঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে। আর ১০টা দিন সময় পেলেই তারা সব ধান ঘরে তুলতে পারবেন বলে আশা করছে। এদিকে হঠাৎ করেই সুনামগঞ্জের সুরমা নদীর পানি বাড়ায় দ্রুত ধান কেটে নিতে কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, গত ৩ দিনে সুনামগঞ্জ ও ভারতের মেঘালয়ে ৫৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে সুরমা নদীর পানি বেড়েছে এক ফুট। এভাবে নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে, জেলার সব হাওড়ের বাঁধের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিতের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই বিভিন্ন উপজেলায় মাইকিংসহ নোটিস দিয়ে আগাম বন্যার হাত থেকে ফসল রক্ষায় কৃষকদের দ্রুত ধান কাটার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। হাওড় ছাড়াও দেশের অন্যান্য স্থানেও আগাম জাতের বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সারাদেশেই পুরোদমে বোরো কাটা শুরু হবে কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও) বাংলাদেশের বোরো আবাদ ভাল হয়েছে বলে তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। সংস্থাটি বলেছে, অনুকূল আবহাওয়া এবং পর্যাপ্ত কৃষি উপকরণ ও পানি পেয়ে বাংলাদেশের বোরো আবাদ বেশ ভাল হয়েছে। ধানের আকর্ষণীয় দামও বোরো আবাদ ভাল হওয়ার পেছনে অবদান রেখেছে। আগামী দিনগুলোতে স্বাভাবিক আবহাওয়ার ওপরই নির্ভর করছে বোরো ধানের সম্ভাবনা। দেশের সার্বিক বোরো উৎপাদন সম্পর্কে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মহসীন বলেন, এ বছর বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৭ লাখ ২৫ হাজার হেক্টর জমি থেকে এক কোটি ৯০ লাখ ৪১ হাজার টন। কিন্তু বাস্তবে বোরো আওতাও বেড়েছে এবং ফলনও বেশ ভাল হয়েছে। ফলে আমরা আশা করছি, আবহাওয়াসহ সব কিছু ঠিক থাকলে এবার প্রথমবারের মতো দেশে ২ কোটি টন বোরো উৎপাদিত হবে।
×