ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রাচীনকালের অদ্ভুত সব চিকিৎসা

প্রকাশিত: ০৭:১৮, ২৭ এপ্রিল ২০১৮

প্রাচীনকালের অদ্ভুত  সব চিকিৎসা

মলের তৈরি মলম যা বলা হচ্ছে তা সত্যিই সত্যিই ছিল। প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতায় বিভিন্ন প্রাণীর মল ক্ষত সারানোর কাজে ব্যবহার হতো। ইবারের প্যাপিরাস নামক নথিতে এমনি কিছু আজব চিকিৎসার কথা লিপিবদ্ধ করা আছে। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে কুকুর, হরিণ এবং গাধার মতো প্রাণীদের মল শুধুমাত্র চিকিৎসা নয় বরং প্রেতাত্মা দূরে রাখার কাজেও ব্যবহার হতো। কিছু মিসরীয় মেয়েরা তাদের যোনির ভেতরে কুমিরের মল গর্ভনিরোধক হিসেবে ঢুকিয়ে রাখত। রক্তমোক্ষণ রক্তমোক্ষণ এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে কারও শরীর থেকে রক্ত বের করে দেয়া হয়। ব্রিটিশ কলম্বিয়া মেডিকেল জার্নাল অনুযায়ী, খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০-৩৭০ অব্দে এই রক্তমোক্ষণ পদ্ধতি খুব জনপ্রিয় ছিল। গ্রিক, এশিয়ান, আরব এমনকি ইউরোপীয়রা বিশ্বাস করত যে রক্ত, শ্লেষ্মা, কালো পিত্ত ও হলুদ পিত্ত হলো মানবদেহের চারটি গুরুত্বপূর্ণ দ্রবণ এবং এই দ্রবণগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রাখতে তারা এই পদ্ধতি ব্যবহার করত। এই চারটি উপাদানের ভারসাম্যহীনতা একটি মানুষকে অসুস্থ করতে পারে বলে মনে করা হতো। মাইগ্রেন এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যার সমাধান হিসেবে মানুষের দেহ থেকে অর্থাৎ শিরা অথবা ধমনী থেকে রক্ত বের করে দিয়ে রোগের চিকিৎসা করা হতো। হিস্টোরি ডটকমের একটি আর্টিকেল অনুযায়ী, রক্তমোক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে একবার জর্জ ওয়াশিংটনের জীবন বঁাঁচানো হয়েছিল এবং খুব অল্প দিন আগেই এই পদ্ধতির বিলুপ্তি ঘটে। জোঁক চিকিৎসা জোঁকেরা রক্তমোক্ষণ পদ্ধতির উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে সেই প্রাচীনকাল থেকে এবং বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ, চর্মরোগ, দাঁতের রোগ, স্নায়ুবিক সমস্যার সমাধানে জোঁক চিকিৎসা ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থাতেও জোঁকের ব্যবহার রয়েছে। জোঁকের দেহের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পেপটাইড এবং প্রোটিন ক্ষত জায়গার রক্তের ভারসাম্য রক্ষার্থে অত্যন্ত কার্যকরী। এমনকি ক্যান্সার, আর্থ্রাইটিস, হৃদরোগ এবং উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগ নিরাময়কারী ওষুধ তৈরিতে জোঁকের জুড়ি নেই আজও। মূত্রপান প্রাচীনকালে মিসর, গ্রিস এবং রোমে মূত্রপান ছিল বিভিন্ন ধরনের পেটের রোগের বহুল প্রচলিত সমাধান। বিভিন্ন ভারতীয় এবং চীনা ইতিহাসে সোনালী রঙের মূত্রের অনেক ঔষধি গুণের কথা উল্লেখ করা আছে। তাছাড়া প্রাচীনকালে এটি কাপড়-চোপড় ধোয়া এবং দাঁত সাদা করার কাজে ব্যবহৃত হতো। মাথার খুলি ছিদ্র করা আপনার যদি কখনও তীব্র মাথাব্যথা হয় আপনি কি সমাধান হিসেবে মেশিন দিয়ে আপনার খুলি ছিদ্র করার কথা ভাববেন? এটা আজগুবি বলে মনে হলেও প্রাচীনকালে তীব্র মাথাব্যথা এবং বিভিন্ন স্নায়ুবিক সমস্যার সমাধান করতে খুবই ছোট এবং সূচালো ড্রিল মেশিন দিয়ে মাথার খুলি ছিদ্র করা হতো। এ ধরনের চিকিৎসার ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষের মৃত্যু ঘটত। গ্রিস, আফ্রিকা, পলিনেশিয়া এবং আমেরিকাতে আজ থেকে ৭০০০ বছর আগে এই অদ্ভুত চিকিৎসার প্রচলন ছিল। এমনকি এই অদ্ভুত চিকিৎসা ১৯ শতকের গোড়ার দিকেও বহুল প্রচলিত ছিল। ফিতাকৃমি ডায়েট ভিক্টোরীয় যুগের সবচেয়ে জঘন্যতম এক পদ্ধতি ছিল ফিতাকৃমির মাধ্যমে ওজন বা শারীরিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। মেয়েরা তাদের শরীরের গড়ন ঠিক রাখতে ফিতাকৃমির ডিম খেত যা পরবর্তীতে তার পেটে গিয়ে কৃমিতে পরিণত হতো এবং তার ভক্ষণ করা খাবার খেয়ে তাকে শরীরের গড়ন ঠিক রাখতে সাহায্য করতো। কোন মানুষ তার ইচ্ছামতো খাদ্য গ্রহণ করতে পারত কেননা শেষমেশ ওই ফিতাকৃমি তার পেটের অতিরিক্ত খাবার খেয়ে ফেলবে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর তথ্য হলো এই পদ্ধতি এখনও প্রচলিত আছে। এই পদ্ধতির অবলম্বনের ফলে সেই প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ অপুষ্টি, পেটব্যথা, ডায়রিয়া, বমিভাব, রক্তস্বল্পতা এবং জ্বরের মতো রোগ ঐতিহ্যের মতো নিজের দেহে বহন করে নিয়ে আসছে। মৃতদেহ থেকে তৈরি ওষুধ প্রাচীনকালে মরা মানুষের মাথার খুলি গুঁড়া করে তৈরি করা হতো বিভিন্ন ধরনের ওষুধ। সেই রোমান জনগোষ্ঠী থেকে শুরু করে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের রাজত্বকালের সময় পর্যন্ত মরা মানুষ থেকে ওষুধ তৈরির প্রথা প্রচলিত ছিল। এমনকি মিসরের বিভিন্ন পিরামিডে মৃতদেহ চুরির ঘটনা ঘটত বলে জানা যায়। ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিকার্ডো সাগ বলেন, ‘মানবদেহের মাংস, হাড়, রক্ত প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, এমনকি আধুনিক চিকিৎসাও এর ব্যতিক্রম নয়।’ পাদের গন্ধ শোঁকা ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে কালাজ্বর নিরাময় করতে চিকিৎসকেরা এই পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন। তাছাড়া সেই সময়ের মারাত্মক রোগ প্লেগ চিকিৎসায় এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো। মানুষজন পাত্রে সংরক্ষিত পাদের গন্ধ গ্রহণ করত অথবা কোন দুর্গন্ধময় প্রাণী বাড়িতে কোন পাত্রে সংরক্ষণ করত। যদিও এই পদ্ধতি সে সময় বহুল প্রচলিত ছিল কিন্তু প্লেগ চিকিৎসায় এটা কোন কাজে আসেনি। মরা ইঁদুরের মলম প্রাচীন মিসরীয় জনগোষ্ঠী বিভিন্ন রোগের সকল সম্ভাব্য নিরাময় খেঁাঁজার চেষ্টা করেছিল। তারা এক পর্যায়ে মরা ইঁদুর দিয়ে এক ধরনের মলম তৈরি করা শুরু করে যা কাশি, দাঁতব্যথা এবং অন্যান্য রোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত হতো। ব্রিটেনে ইঁদুর ব্যবহৃত হতো আঁচিল চিকিৎসার কাজে। ইঁদুর অর্ধেক করে কেটে আক্রান্ত স্থানে লাগিয়ে দেয়া হতো নিরাময়ের উদ্দেশ্যে। পরবর্তীতে এই পদ্ধতি বিলুপ্ত হয়ে যায়। পারদের পানীয় ইদানীং আমরা জানি পারদ একটি বিষাক্ত ধাতু যা দৃষ্টিহীনতা, স্নায়ুক্ষয়, শ্রবণশক্তিহীনতা, পেশী দুর্বলতা ইত্যাদি সমস্যা তৈরি করে থাকে। পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা পারদের ক্ষতিকর দিকের কথা প্রচার করে আসছে অনেক আগে থেকেই। কিন্তু প্রাচীন গ্রীক, ইরানী এবং চীনারা বিশ্বাস করত যে, পারদের পানীয় পান বা পারদ ত্বকে লাগানো জীবনের সময়কাল বৃদ্ধি করে থাকে এবং এটি সিফিলিসের মতো রোগ প্রতিরোধ করে। কিন শিন হুয়াং নামে একজন চীনা রাজা চিরকাল বেঁচে থাকার জন্য অধিকমাত্রায় পারদ গ্রহণের ফলে মারা যান। চোখের ভেতরে দাঁত বসিয়ে দেয়া অন্ধত্বজনিত চিকিৎসার কাজে প্রাচীনকালে চোখের ভেতরে দাঁতের একটি অংশ বসিয়ে দেয়া হতো এবং এই পদ্ধতি আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থাতেও প্রচলিত আছে। প্রথমে রোগীর একটি দাঁত তুলে নিয়ে তাতে একটি লেন্স ড্রিল করে বসানো হয়। তার আগে দাঁতটি তার গালের মধ্যে সাময়িক একটি সময়ের জন্য বসানো হয় যাতে দাঁতটি তার নিজস্ব রক্ত সরবরাহ ব্যবস্থা তৈরি করে নিতে পারে। তারপর সেটি লেন্সের সঙ্গে লাগিয়ে চোখে বসিয়ে দেয়া হয়। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি চক্ষু হাসপাতালের চিকিৎসক শ্যানন ওয়েবার এবং গ্রেগ মোলোনি এই ধরনের জটিল সার্জারি করে থাকেন। পেঁয়াজ দিয়ে গর্ভধারণ পরীক্ষা প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতায় পেঁয়াজ দিয়ে গর্ভধারণ পরীক্ষা করার রীতি প্রচলিত ছিল। কোন নারী গর্ভবতী কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য তার যোনিতে পেঁয়াজ ঢুকিয়ে দেয়া হতো। পরদিন সকালে যদি তার মুখ দিয়ে পেঁয়াজের গন্ধ পাওয়া যেত তাহলে মনে করা হতো যে ওই নারী গর্ভবতী। হেমিগ্লোসেকটমি হেমিগ্লোসেকটমি এমন এক পদ্ধতি যা প্রাচীনকালে তোতলামি সারানোর কাজে ব্যবহৃত হতো। রোগীর জিহ্বার কিছু অংশ কেটে ফেলে তোতলামি নিরাময় করা হতো এবং এই পদ্ধতিতে কোনরকম অচেতন করে নেয়ার ব্যবস্থা ছিল না। ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দের দিকে প্রুশিয়ান সার্জন জেএফ ডিফেনবাখ ছিলেন এই পদ্ধতির অন্যতম অনুসারী এবং তিনি বিশ্বাস করতেন যে এই পদ্ধতিতে সার্জারির ফলে রোগী স্বাভাবিকভাবে কথা বলার ক্ষমতা লাভ করে। ঘুমপাড়ানি সিরাপ ঊনবিংশ শতাব্দীতে কোডিন, আফিম এবং হেরোইনের সংমিশ্রণে এক প্রকার সিরাপ তৈরি করা হতো যা শিশুদের ঘুমপাড়ানি ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হতো ব্যাপকভাবে। এই সিরাপটি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তখন ব্যাপকহারে বিখ্যাত করে তোলা হয়। ১৮০০ সালের মাঝের দিকে এটি বাজারে বেশ চাহিদা তৈরি করে নেয়। ১৯৩০ সাল অবধি সিরাপটি বাজারে তার চাহিদা ধরে রাখে যদিও পরবর্তীতে এটির সত্যতা সবাই জেনে যায়। লার্ভা পদ্ধতি আমেরিকান গৃহযুদ্ধের আগে অবধি সংক্রমিত ক্ষত নিরাময়ের কাজে লার্ভার ব্যবহার বহুল প্রচলিত ছিল, কেননা লার্ভাগুলো মরা টিস্যুগুলো খেয়ে ফেলত এবং সুস্থ টিস্যুগুলো সুরক্ষিত থাকত। পদ্ধতিটি এতটাই কার্যকরী ছিল যে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় এখনও এই পদ্ধতি প্রচলিত আছে। যখন খুব শক্তিশালী এ্যান্টিবায়োটিকও কাজ করে না তখন এই ছোট্ট মাছির বাচ্চাগুলো মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে। তথ্যসূত্র : রিডার্স ডাইজেস্ট
×