ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি মাহাথির

প্রকাশিত: ০৪:৪০, ১৫ মে ২০১৮

আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি মাহাথির

আধুনিক মালয়েশিয়া তৈরি করার দক্ষ নির্মাতা মাহাথির মোহাম্মদ আজও সে দেশের জনগণের হৃদয়ে যে দীর্ঘস্থায়ী আসনে আসীন আছেন তার যথাযথ উত্তর দিল সময়। যুগোপযোগী মালয়েশিয়াকে গড়তে যে শ্রম, মেধা, সময়ই শুধু নয়, তার চেয়েও বেশি গভীর দেশাত্মবোধে তাড়িত হয়ে আধুনিকতার বলয়ে দেশটিকে যেখানে নিয়ে গেছেন তা কেবল অবিস্মরণীয়ই নয়, এক যোগ্য নেতৃত্বেরও দৃঢ় অভিব্যক্তি। দারুণ ক্ষমতাধর মাহাথিরকে নতুন মালয়েশিয়া উপহার দিতে কট্টর একনায়কের ভূমিকায়ও নামতে হয়েছিল। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। দূরদর্শী এই রাষ্ট্রনায়ক আন্তর্জাতিক বিশ্বে স্বদেশের মর্যাদাকে যে মাত্রায় উদ্দীপ্ত করেছিলেন তা শুধু অনুকরণীয় দৃষ্টান্তই নয়, মাতৃভূমিকে উচ্চতর মানে নিয়ে যাওয়ার এক বলিষ্ঠ দৃঢ় প্রত্যয়ও বটে। গত শতাব্দীর আশির দশকে মালয়েশিয়া কোনভাবেই বাংলাদেশের তুলনায় অগ্রগামী অঞ্চল ছিল না। ত্যাগ, তিতিক্ষা, নিষ্ঠা, মাতৃভূমির প্রতি অবিচলিত নিবেদন তাকে এক সময় নেতৃত্বের শীর্ষেই শুধু নিয়ে যায়নি, দেশটির ইতিহাসে অভাবনীয় রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকায়ও উজ্জ্বল করেছে। ’৮০, ’৯০-এর দশকে তাবৎ বিশ্ব প্রত্যক্ষ করল একটি অনুন্নত দেশ কিভাবে পর্যায়ক্রমিক ধারায় নতুন সময়কেই স্পর্শ শুধু করছে না সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যেও তৈরি হচ্ছে এক নিবিড় একাত্মতা, সে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান যেই হোক না কেন। সব মানুষের এমন মিলনের সার্বজনীন চেতনা শুধু কবি-সাহিত্যিকদের সৃজনভা-ারে সংরক্ষিত থাকে। কঠিন বাস্তবের অভিঘাতে সেই মিলনগ্রন্থি কল্পনাই করা যায় না। দুনিয়াজুড়ে বৈষম্য শুধু মানুষে মানুষে নয়, নারী-পুরুষের ফারাক দৃষ্টিকটুভাবে প্রত্যক্ষ। শুধু কি তাই? ধর্ম, বর্ণ, জাতিভেদ আর বিত্তের কঠিন নিগড়ে শৃঙ্খলিত মানবজীবন আজ উ™£ান্ত, দিশেহারা। আর মাহাথির মোহাম্মদ সেখানে কি নজির দেখালেন বিশ্ববাসীকে? ধর্মের বিভেদকে তোয়াক্কাই করলেন না, সমতাভিত্তিক নারী-পুরুষের অবস্থান এই দেশটির বিশিষ্ট পর্যায়। দেশকে গভীরভাবে ভালবেসেও আন্তর্জাতিক বিশ্বে উন্নীত হতে গেলে অন্য দেশেরও সুষ্ঠু সমন্বয় একান্ত আবশ্যিক। সেই বোধে চীনা এবং ভারতীয়দের অবস্থানও মালয়াদের মতোই সংহত। ১৯৮১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত দাপটের সঙ্গে শাসন করা এই কিংবদন্তি অগ্রনায়ক এক সময় হরেক রকম অভিযোগের শিকার হয়ে তার যথার্থ উত্তরসূরি তৈরিতে নজর দিলেন। যদিও আগে কখনও এ নিয়ে তাকে বিচলিত হতে দেখা যায়নি। টানা ২২ বছরের শাসনের ইতিহাসে দক্ষ হাতে রাষ্ট্রযন্ত্র সামলাতে গিয়ে বিভিন্ন সময় তাকে সমালোচনার ঝড়েও আক্রান্ত হতে হয়। ষোড়শ শতাব্দীর আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক ম্যাকিয়াভেলির একটি বাণী আজও যে কতখানি বাস্তবসম্মত এবং প্রাসঙ্গিক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তার মতে সব ক্ষমতাই মানুষকে বিকৃত করে, চরম ক্ষমতা মানুষকে চরমভাবেই বিকৃত করে। সবক্ষেত্রে কর্তৃত্ব মানুষকে বিকৃত করে না, বরং একজন রাষ্ট্রনায়কের পক্ষে ক্ষমতাকে সুসংহত করে দেশকে সার্বিক উন্নয়নের শামিলও করাতে হয়। মাহাথিরকে প্রয়োজনে আধুনিকতার বলয়ে কিংবা নতুন সময়ের বলিষ্ঠ পথিক হিসেবে এমন অনেক কিছু করতে হয়েছিল যা প্রচলিত ধারাকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। এক সময়ের পশ্চাৎপদ মালয়েশিয়াকে বিশ্বজনীনতার উদাত্ত আহ্বানে সাড়া দিতে কিছুকাল তো অপেক্ষা করতে হয়েছিল। যা কিনা নতুনের সঙ্গে সনাতনের বিরোধ কিংবা দ্বন্দ্ব। নতুন যুগের প্রতিনিধিদের সেই ঝড়-ঝাপটা শুধু মোকাবেলায়ই করতে হয় না, প্রয়োজনে কঠিন-কঠোর ভূমিকায় নবযুগকে অবারিতও করতে হয়। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মাহাথিরের পিতামহ ছিলেন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার বাসিন্দা। পেশায় জাহাজের নাবিক হওয়ার সুবাদে দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়াতেন। এক সময় স্থিত হয়ে মালয়েশিয়ায় আপন ঠিকানা তৈরি করেন। শুধু তাই নয়, মালয়া নারীকে বিয়ে করে পারিবারিক সম্পর্কও গড়ে ওঠে মালয়েশিয়ায়। এই শঙ্কর দম্পতির পুত্র মোহাম্মদ ইস্কান্দর, যিনি নয় সন্তানের জনক। মাহাথির মোহাম্মদ তার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। সুস্থ রাজনৈতিক ধারার সংগঠক মাহাথির তার শাসনকালের ইতিহাসে অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম কিংবা দুর্নীতির আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়াই দেশটিকে আধুনিক বিশ্বের কাতারে শামিল করান। সৎ সাহস, ন্যায়নিষ্ঠা, দেশাত্মবোধই শুধু নয়, আধুনিকতার সমস্ত সূচককে একীভূত করে নতুন মায়েশিয়া উপহার দেয়ার প্রচেষ্টায় নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিবেদন করলেন। সময়ের চাহিদা মেটালেন, ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরলেন, প্রকৃতির অবারিত দানকে সানন্দে আধুনিকতার অনুষঙ্গ করলেন। শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল সংশোধন আনলেন। পিছিয়ে পড়া পুত্রজায়াকে আধুনিক প্রশাসনিক নগরী হিসেবে ঢেলে সাজালেন। কৃষি সভ্যতার দেশকে ক্রমান্বয়ে শিল্পায়িত করার সমস্ত উপযোগ সংশ্লিষ্ট করলেন। শুধু তাই নয়, বিশ্ববাণিজ্যের সঙ্গে প্রবল প্রতিযোগিতায় ব্যবসায়িক উদ্যোগকে যোগ্যতমের হাতে ছেড়েও দিলেন। ফলে মালয়েশিয়ার অর্থনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা কিংবা প্রশাসনের সুসংহত ধারা বজায় থাকলেও কর্তৃত্বে ধর্মের ভিন্নতা কোন নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি। বিস্ময়কর হলেও এটা সত্য যে, সেখানে শিক্ষা ব্যবস্থাটা অনেকটাই ভারতীয়দের হাতে। তবে আধুনিক উচ্চ শিক্ষিত মালয়ারাও শিক্ষা কার্যক্রমের তাদের প্রয়োজনীয় ভূমিকা রেখেই যাচ্ছে না, সংখ্যায়ও দিন দিন বাড়ছে। শিক্ষার পরিপূর্ণ বলয় আধুনিক উন্নত বিশ্বের সঙ্গে প্রায়ই সমান্তরাল। যেমন আলাদা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় এখানে একেবারেই নেই। বরং মালয়েশিয়ার মূল চিকিৎসালয়টি বৃহৎ মালয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একীভূত। একইভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি এবং চিকিৎসা শাস্ত্রের আলাদা অনুষদ আছে, যাদের একাডেমিক কর্মপ্রক্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত এবং যা উন্নত বিশ্বের সঙ্গে মানানসই। আমাদের দেশ এখনও এই উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে অনেকটাই দূরে। মাহাথির আশি আর নব্বইয়ের দশকে এমন শিক্ষা ব্যবস্থাকে অনগ্রসর মালয়াদের জীবন আর মননে গেঁথে দিতে পেরেছিলেন, যা একজন দূরদর্শী কর্ণধারের পক্ষেই সম্ভব। সে দেশের অর্থনীতির নিয়ামক অংশ চীনাদের আধিপত্যে। আশ্চর্যজনকভাবে এই নিয়ে মালয়াদের সঙ্গে চীনাদের অভ্যন্তরীণ কোন বিবাদ নেই। চীনারা ব্যবসা-বাণিজ্যে কোন ধরনের ঝুঁকি কিংবা ঝামেলা ব্যতিরেকেই মালয়েশিয়ায় তাদের অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যায়। এমন দেশ গড়ার কারিগরকে সাধারণ জনগোষ্ঠী কি কখনও ভুলতে পারে? এ বছরের মে মাসের নির্বাচনের ফলাফল সেটাই জোরালোভাবে প্রমাণ করল। তা না হলে ৯০ অতিক্রম করা এক বয়োবৃদ্ধ সাবেক সরকার প্রধানের আধুনিক প্রজন্মের রায় পাওয়া কি এতই সহজ? মাহাথির নিজেও মনে করছেন তার এখনও অনেক কিছু করার আছে। মালয়ারা নিজ কর্তৃত্বে রেখেছে পুরো প্রশাসনিক দফতর। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী থেকে শুরু করে আমলা, এমনকি বৃহদাকার সরকারী প্রতিষ্ঠানের মূল দায়িত্বেও মালয়ারা। ধীর, স্থির, ঠা-া মাথা আর অবিচলিত লক্ষ্যে নতুন দেশ তৈরির যে নির্দেশনা তার কাছ থেকে এসেছিল সময়ের দুর্বার গতিতে সে দেশ আজ উন্নয়নের শীর্ষ শিখরে পৌঁছতে দেরি করেনি। তার শাসনে জাতিভেদ, ধর্মবিরোধ কিংবা নারী-পুরুষের ফারাক সেভাবে দৃশ্যমান হয়নি। যোগ্যতমরাই স্ব স্ব জায়গায় নির্বিঘেœ চলে এসেছে। কোন ধর্মীয় উৎসবের আমেজ কিংবা আড়ম্বর নেই। মুসলমানদের দুই প্রধান ঈদ-আয়োজন মালয়েশিয়ায় অদৃশ্য। কোরবানির সময় কোন পশুকে জবাই দিতেও দেখা যায় না। তবে ইসলামী নিয়ম অনুযায়ী কর্মজীবীদের বেতন থেকে একটা অংশ কেটে রাখা হয় দেশের উন্নয়ন খাতে ব্যয় করার লক্ষ্যে। বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় মালয়াতে অনেক সফরকারী অধ্যাপক আসেন বিভিন্ন দেশ থেকে। তাদের জন্য ক্যাম্পাসে বাসা বরাদ্দ থাকে। শিক্ষকদের জন্য নির্ধারিত বাসার ধারে-কাছেই থাকে ছাত্রছাত্রীদের আবাসিক ব্যবস্থা। ছাত্রী হলে কোন ধরাবাধা নিয়ম কিংবা নিরাপত্তা বেষ্টনীও নেই। ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রী হাত ধরাধরি করে হাঁটছে নিরাপদে-নিশ্চিন্তে। কোন উচ্চবাক্য কিংবা হৈ-হুল্লোড়ের মতো কিছুই ঘটে না। সবকিছু এতই নিয়ম-শৃঙ্খলার অধীন যাতে করে কেউই এসব ভাংতে সাহস কিংবা আগ্রহীও হয় না। কি অদ্ভুত সাবলীলতায় দেশের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গনকে থরে থরে সাজিয়েছেন এই প্রবাদপ্রতিম দেশনায়ক। আর তাই প্রায়ই ১৫ বছর পর যখন তিনি আবারও তার জায়গায় আসতে চেয়েছেন সাধারণ মানুষ আর সময়ের প্রজন্ম তাকে আন্তরিক অভিনন্দনে স্বাগত জানিয়েছে। তার বয়স, কর্মক্ষমতা কিংবা মেধাশক্তির কিছুটা হলেও ক্ষয়িষ্ণুতাকে দেশের নাগরিকরা আমলেই নেয়নি। দেশপ্রেমিক মালয়ারা আজও মনে করে এই অকৃত্রিম আর বলিষ্ঠ নেতার প্রয়োজন এখনও অনেক বেশি। ১৫ বছর আগে ছেড়ে দেয়া আসন যা তৈরি হয়েছিল তিল তিল করে দীর্ঘ ২২ বছর ধরে তাকে পুনরায় জয় করার যে দুর্জয় সাহস সেটাই এই শক্তিমান রাষ্ট্রনায়ককে নিয়ে যাবে হয়তবা আরও এক অনন্য উচ্চতায়। এখন শুধুই সময়ের অপেক্ষা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কিংবা বিরোধকে পাশ কাটালেও এ কথা অকপটে বলা যায়, ১৫ বছর আগে মাহাথির যে অবস্থানে দেশটিকে রেখে যান সে জায়গায় কি এখনও আছে? বিশ্বজুড়ে মৌলবাদ-জঙ্গীবাদ কিংবা নির্যাতন-নিপীড়নের যে মহড়া সার্বিক অঙ্গনে উত্তাপ সম্প্রসারিত করছে তার আঁচ কি এই ছোট্ট দেশটির সীমানায় লাগেনি? যার কারণে নাজিব রাজাকের মতো শক্তিধর শাসকরা তাদের তৈরি করা আসন পুনরায় মাহাথিরকে দিয়ে দিতে হলো? ১৫ বছর খুব কম সময় নয়। অর্জন করতে বছরের পর বছর চলে যায়, কিন্তু বিসর্জনের বেলায় কখনও সময়ক্ষেপণ হয় না। আমরা আধুনিক নগর বিনির্মাণ করতে গিয়ে অকারণে, অপ্রয়োজনে প্রকৃতির নিঃস্বার্থ দানকে নষ্ট করে ফেলি। ফলে প্রকৃতি যেমন বিপর্যয়ের মুখে পড়ে, একইভাবে তার কোলে লালিত সন্তানরাও নিরাপদে, নির্বিঘেœ থাকতে পারে না। এই চির সত্যটি মাহাথির অনুভব করতে পেরেছিলেন। আধুনিক সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা, সুরম্য অট্টালিকা, বিলাসবহুল হোটেল, তার সঙ্গে দর্শনীয় টুইন টাওয়ার সব মিলিয়ে তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়ায় দেশটি যে মাত্রায় নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছে তা সত্যিই বিস্ময়ের। একইভাবে প্রকৃতির ওপর কোন অন্যায়-অবিচার না করে তা সুরক্ষিত রাখা সেটাও যেন এক পরম আরাধ্য বিষয়, যা আধুনিক মননের এই স্থপতিকে নিসর্গপ্রেমিকের মর্যাদায়ও দাঁড় করায়। দ্বৈত সম্মিলনের এই অগ্রগামী পুরুষ মালয়েশিয়াকে শেষ অবধি কোথায় নিয়ে যান সেটাই এখন দেখার বিষয়। লেখক : সাংবাদিক
×