নিজস্ব সংবাদদাতা, নওগাঁ ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত ‘সবার জন্য বাসস্থান’ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘জমি আছে, ঘর নাই’ আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের কাজে নওগাঁর বদলগাছীতে ব্যাপক অনিয়ম ও ঘুষ বার্ণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিষয়টি সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেছেন এলাকাবাসী।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ উপজেলার ৩ টি ইউনিয়নে আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের আওতায় গৃহহীন পরিবারের জন্য ১শ’টি আধাপাকা ঘর বরাদ্দ এসেছে। এরমধ্যে মথুরাপুর ইউনিয়নে ৯৭ টি, আধাইপুর ইউনিয়নে ২ টি ও বদলগাছী সদরে ১টি ঘর। প্রতিটি ঘর ও টয়লেটসহ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ টাকা।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)কে সভাপতি করে পাঁচ সদস্যের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির মাধ্যমে গত তিন মাস থেকে এসব ঘর নির্মানের কাজ করা হচ্ছে। ঘর বরাদ্দ থেকে শুরু করে ঘর তৈরীতে চলছে নানান অনিয়ম। নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে পিলার তৈরী করা হয়েছে। ঘর নির্মাণ শেষ না হতেই ঘরের জানালা, দরজার কাঠে ফাটল দেখা দিয়েছে।
যাদের জমি আছে ঘর নাই, সেসব অসহায় ব্যক্তিরা ঘর পাবার কথা থাকলেও টাকার বিনিময়ে দেয়া হয়েছে স্বচ্ছলদের। যারা চাহিদা মতো টাকা দিতে পারেননি, তারা ঘর পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আবার সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে ৫-১০ হাজার টাকা করে।
এ প্রকল্পের আওতায় ঘর নির্মাণে ১ লাখ টাকার মধ্যে সম্পন্ন করে সুবিধাভোগীদের বুঝিয়ে দেয়ার কথা। কিন্তু ঘর তৈরীতে পিলার, টিন, কাঠ, রিং ও মিস্ত্রী খরচসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র নিয়ে আসতে সুবিধাভোগীদের অতিরিক্ত ১ হাজার টাকার মতো গুনতে হয়েছে। আর এসব অনিয়ম ও ঘুষ বার্ণিজ্যের সঙ্গে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার যোগসাজসে স্থানীয় ইউপি মেম্বার আবুল কালাম আজাদ ও পরিমল মন্ডল এবং শেখ ফরিদ পিন্টু নামে এক ব্যক্তি জড়িত বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
জানা গেছে, মথুরাপুর ইউনিয়নের চাঁপাইনগর গ্রামের লুৎফর রহমানের পুত্র শেখ ফরিদ পিন্টু। তিনি ওপরে যোগাযোগ ও তদবির করে আশ্রয়ন-২ প্রকল্পের কাজ তার এলাকায় নিয়ে এসেছেন বলে জানানো হয়। তবে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের কাগজপত্রের সঙ্গে তার কোন সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।
আর এ প্রকল্পের কাজ নিয়ে আসার দাবী করে শেখ ফরিদ পিন্টু ও তার সহযোগীরা সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ। এছাড়া টিন, ইট, বালু, সিমেন্ট, পিলার ও রিং নিয়ে আসার ভাড়া বাবদ আরো প্রায় ১ হাজার টাকা করে গুনতে হয়েছে সুবিধাভোগীদের। আবার উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আব্দুল করিমের বাড়ি বগুড়া জেলায় হওয়ায় তার এলাকার মিস্ত্রীদের নিয়ে এসে প্রকল্পের কাজ করে নিচ্ছেন।
শ্যামপুর গ্রামের শুকলাল সাংবাদিকদের বলেন, আগে পাট কাঠির (সিনট) বেড়ার ঘরে থাকতাম। এখন সরকার থেকে পাওয়া ঘরে থাকছি। তবে ঘর নিতে মথুরাপুর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড মেম্বার পরিমল মন্ডল ও শেখ ফরিদ পিন্টু পাঁচ হাজার টাকা নিয়েছেন। এছাড়া টিন, ইট, বালু, সিমেন্ট, পিলার ও রিং নিয়ে আসতে ১ হাজার দিতে হয়েছে। আর টাকা না দিলে ঘর পাব না। এজন্য টাকা দিয়েছি। একই গ্রামের ফুলেশ্বরী বলেন, আমরা গরীব মানুষ। বেড়ার ঘরে থাকি। দিন আনা, দিন খাওয়া। আমাদের কাছ থেকে টাকা চেয়েছিল। টাকা দিতে না পারায় ঘরও পাইনি। অথচ শ্যামপুর গ্রামের উত্তরপাড়ার হিরামন সারা বছর ঘরের ধানের ভাত খায়। পাঁচ বিঘা জমি ও পাওয়ার টিলার আছে।
টাকার বিনিময়ে তাকে ঘর দেয়া হয়েছে। লক্ষ্মিকুল গ্রামের জিল্লুর রহমানে স্ত্রী রোজিফা বলেন, ঘরের পিলার নিয়ে আসতে ৯৫০ টাকা দিতে হয়েছে। এছাড়া টয়লেটের রিং নিয়ে আসতে আরো ২শ’ টাকা লাগবে এবং ৬ জন মিস্ত্রীকে চারদিন ধরে দুইবেলা খাবার দিতে হয়েছে। যেখানে আমার ঘরটি তৈরী করা হয়েছে সেখানে বন্যায় ডুবে যায়।
আমরা নিজেরা মাটি ফেলে সেখানে উঁচু করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কোন সুযোগ দেয়া হয়নি। সামনে বন্যায় ঘর ডুবে যাবে। এখন ঘর ভেঙে তো আর তৈরী করার সাধ্য আমার নেই। এজন্য মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেছে।
এছাড়া শ্যামপুর গ্রামের হিরামন, থুপশহর গ্রামের উজ্জল হোসেন, জোসনা, মাহমুদপুর গ্রামের সাইদুল হোসেন, ঝরনাসহ কয়েকজন বলেন, প্রত্যেককে ঘর নিতে পাঁচ হাজার টাকা স্থানীয় ইউপি মেম্বার আবুল কালাম আজাদ ও পরিমল মন্ডল এবং শেখ ফরিদ পিন্টুকে দিতে হয়েছে। এছাড়া টিন, ইট, বালু, সিমেন্ট, পিলার ও রিং নিয়ে আসতে আরো প্রায় ১ হাজার দিতে হয়েছে। বিষয়টি সুষ্ঠু তদন্তের সাপেক্ষে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন সুবিধাভোগীসহ এলাকাবাসী। তবে এসব বিষয়ে স্থানীয় ইউপি মেম্বার আবুল কালাম আজাদ ও পরিমল মন্ডল কোন মন্তব্য করতে চাননা।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) আব্দুল করিম তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ অস্বীকার করে সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমানে বাজারে ঘর তৈরীর সরঞ্জামগুলোর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ঘরটি করতে গেলে প্রায় ১ লাখ চার হাজার টাকার মতো লাগবে। আর ঘরপ্রতি যে ১ লাখ টাকা বরাদ্দ তা কোন ভাবেই করা সম্ভব না। ইতোমধ্যে প্রায় ৯৫ শতাংশ কাজ হয়েছে। যা হয়েছে তা বাংলাদেশের কোথাও এরকম কাজ করা হয়নি। যে খরচ গুলো নিয়েছে সেটা শুনেছি। তবে সরঞ্জামগুলো নিয়ে যাওয়ার খরচ কে দিবে সে বিষয়ে শিডিউলে কোন উল্লেখ নাই।
বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও প্রকল্পের সভাপতি মাসুম আলী বেগ সাংবাদিকদের বলেন, এখন পর্যন্ত কেউ কোন অভিযোগ নিয়ে আসেনি। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আগামীতে উপজেলার অন্য ইউনিয়নগুলোতে বরাদ্দ সাপেক্ষে ঘর তৈরী করা হবে। তবে ঘর তৈরীতে যদি কমিটির কেউ অনিয়মে জড়িত থাকে তাহলে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: