ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

রাস্তাঘাট মেরামত দরকার, দরকার উচ্চ মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি মোকাবেলা

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ১৮ মে ২০১৮

রাস্তাঘাট মেরামত দরকার, দরকার উচ্চ মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি মোকাবেলা

পরিকল্পনামন্ত্রী আ. হ. ম. মোস্তফা কামাল একটি সুখবর দিয়েছেন। আগামী অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৮-১৯ সালে ‘জিডিপি’ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা হবে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। এই লক্ষ্যমাত্রার কথা উল্লেখ করে তিনি অবশ্য আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এটা হবে ধারাবাহিক অগ্রগতি। তিনি মনে করেন আগামীতে বিনিয়োগ বাড়বে। কারণ, আগের মত এখন আর গ্যাস বিদ্যুতের সঙ্কট নেই। উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থাও অটুট রয়েছে। শুধু পরিকল্পনামন্ত্রী নন, অর্থমন্ত্রীও প্রতিদিন আগামী বাজেটের নানা খবর দেশবাসীকে দিয়ে যাচ্ছেন। বাজেটের আকার, উন্নয়ন, কর ব্যবস্থা, কর্পোরেট কর হ্রাস, সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদ হ্রাস ইত্যাদি বিষয়ে তিনি দেশবাসীকে মোটামুটি একটা ধারণা দিয়ে যাচ্ছেন। সে সব ধারণা দুইমন্ত্রী দিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন সেসব সম্পর্কে আমরা মোটামুটি ওয়াকিবহাল। এসব করণীয় সম্পর্কে কারও কোন দ্বিমত নেই। তবে তাদের কথিত করণীয়ের সঙ্গে আরও অনেক করণীয় যোগ করতে হবেই বলে বিশ্বাস। যেমন মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য ছিল মাত্র ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। একটি রিপোর্টে দেখলাম এই লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ করা হয়েছে। না করা ছাড়া উপায় নেই। আমাদের অর্থনীতি আমদানিনির্ভর। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে আবার পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। জ্বালানি তেল, ধাতব পদার্থ ও কৃষি পণ্যের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডলারের মূল্য টাকার বিপরীতে বৃদ্ধি পেয়েছে অর্থাৎ আমাদের টাকার মূল্য অবমূল্যায়িত হচ্ছে। আবার প্রধান আমদানি উৎস চীন ও ভারতেও মূল্যস্ফীতি ঘটছে বেশি হারে। এর মানে ওইসব দেশ থেকে এখন যেসব আমদানি হবে তার মূল্য বেশি পড়বে। এদিকে কাগজে দেখছি বোরো ফসল বাম্পার হলেও শেষ মুহূর্তে অনেক কৃষক তাদের ফসল ঘরে তুলতে পারেননি। আবার বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের শত আশ্বাস সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে যথারীতি ব্যবসায়ীরা পবিত্র রোজার পূর্ব মুহূর্তে বাজার দর চড়িয়েছেন। এসব আলোচনা করছি কেন? কারণ ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে তার মধ্যেই ২০১৮-১৯ অর্থবছর শুরু করতে হবে। এমতাবস্থায় ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কাজ কঠিনতর হবে বৈকি! কঠিনতর মানে কি এই যে, এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে না, আমি তা মনে করি না। তবে অনেকগুলো বাধা এখনই দেখছি। এসব অবশ্যই দূর করে আমাদের এগোতে হবে। একটা বড় বাধা যোগাযোগ। পরিকল্পনামন্ত্রী বলছেন, আগামী বছর বিনিয়োগ বাড়বে। গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যা আগের মতো নেই। কিন্তু সমস্যা তো দেখা দিচ্ছে অন্যত্র। সারা দেশের রাস্তাঘাটের সমস্যা খুবই খারাপ। ঢাকা শহরের অবস্থা সবারই জানা। প্রতিবছরই উন্নয়নের কথা বলে মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে রাস্তাঘাট কেটে, গর্ত খুঁড়ে এমন অবস্থার সৃষ্টি করা হয় যার ফলে শহরে চলাচল করা এক দুরূহ ব্যাপার হয়ে উঠে। এবারের অবস্থা আরও খারাপ। এখন রোজা। তারপর ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি। ঢাকা শহর যদি চলাচলযোগ্য না হয় তাহলে ধর্মপ্রাণ লোকদের কষ্টের শেষ থাকবে না। এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের অবস্থা ভয়াবহ। একটি সরকারপক্ষীয় কাগজের খবরের শিরোনাম: ‘পণ্যবাহী গাড়ির ভাড়া দ্বিগুণ’। খবরের ভেতরে বলা হয়েছে পণ্যবাহী গাড়িগুলোকে রাস্তাতেই থাকতে হচ্ছে দুই-দিন দিন। ভীষণ যানজট। এত যানজট যে চট্টগ্রাম থেকে বাইরে ট্রাকচালকরা যেতেই চাইছে না। অথচ উত্তরবঙ্গের চাল এদিকে না আসলে উপোস থাকতে হবে। আবার চট্টগ্রামের আমদানিকৃত মাল উত্তরবঙ্গসহ দেশের সর্বত্র না পৌঁছালে পণ্যের মূল্য বাড়বে, বাড়ছে। ইতিমধ্যেই যে চালের দাম পড়তে শুরু করেছিল তা আবার উর্ধমুখী। চট্টগ্রাম থেকে দেশের অন্যত্র যাওয়ার গাড়ির ভাড়া ট্রিপ পিছু ৪-৫ হাজার টাকা বেড়েছে। এই হচ্ছে সমস্যার একদিক। অন্যদিকে খবর হচ্ছে দেশের ১২ হাজার কিলোমিটার রাস্তা চলাচল অযোগ্য। একটি রিপোর্টে দেখলাম, এ রাস্তা মেরামত করা জরুরী হয়ে পড়েছে। একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, এর জন্য ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রয়োজন হবে ১২ হাজার কোটি টাকা। তার মানে প্রতি কিলোমিটার রাস্তার জন্য এক কোটি টাকা। খুবই বড় বিষয় বটে। উল্লেখ্য, আমাদের দেশে এখন আর রাস্তা নতুন করে নির্মাণের কিছু সবিশেষ নেই। রাস্তাঘাটের উন্নয়ন যথেষ্ট হয়েছে। এমনও আছে যে, প্রভাবশালীদের বাড়ি-ঘর নয় উঠান পর্যন্ত রাস্তাঘাট গিয়েছে। আনাচে-কানাচে পর্যন্ত রাস্তা আছে। মুশকিল হচ্ছে রাস্তা থাকা নয়, রাস্তা তো চলাচলযোগ্য হতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, সারা দেশের প্রায় সর্বত্র কোন রাস্তাই সর্বাংশে চলাচল যোগ্য নয়। খানা-খন্দে ভরপুর। এই সমস্যা সম্পর্কে কথা উঠতেই এক পরিচিত বন্ধু বললেন, নির্মাণের অবস্থা এমন হয়েছে যে, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ‘বিল্ডিং’ ৫-৬-৭ বছরের বেশি যায় না। সিমেন্ট, ইট, রড খুলে খুলে পড়ে। রাস্তাঘাটের অবস্থাও তাই। এমনিতেই আমরা হচ্ছি বৃষ্টির দেশ। বৃষ্টিতে, বন্যার জলে রাস্তাঘাট নষ্ট হয়। তারপর নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ ও মেরামতের কাজের গুণগত মান ‘হরিবল’ হওয়ায় কোন রাস্তাই সারা বছর চলাচলযোগ্য থাকে না। আমার বাসস্থানের পাশের রাস্তার ওপর দিয়ে হাঁটা খুবই কঠিন। সিমেন্ট উঠে গেছে বহু আগেই। খাঁড়া খাঁড়া কতগুলো পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে প্রতিদিনই বয়স্করা আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছেন। মুশকিল হচ্ছে সারা দেশেরই একই অবস্থা। প্রায় প্রতিদিনই খবরের কাগজে দেশের কোন না কোন অঞ্চলের রাস্তার দুরবস্থার কথা ছাপা হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে একটা সমস্যার কথা বলতেই হয়। আমাদের কর্মকর্তাদের অনেকেরই ধারণা হয়েছে বড় বড় প্রজেক্ট করলেই চলবে। ছোট ছোট কাজের কোন প্রয়োজন নেই। অথচ ছোট ছোট রাস্তা যদি চালু না থাকে তাহলে বড় বড় অবকাঠামোও যে অচল ও অকেজো হতে বাধ্য তা আর বুঝিয়ে বলার দরকার আছে কি? এটা একটা বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। অথচ বোঝাই যায় রাস্তাঘাট নিয়মিত সংস্কার করা না হলে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হবে না। এই মুহূর্তে ১২ হাজার কিলোমিটার রাস্তা মেরামত করা প্রয়োজন। প্রয়োজন ১২ হাজার কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে কী এই টাকার সংস্থান হবে। আর এই সংস্থানের মাধ্যমে যদি রাস্তাঘাট মেরামত না হয় তাহলে কী ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে? এমতাবস্থায় সরকারের উচিত বড় বড় প্রকল্পের সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছোট কাজের প্রতিও নজর দেয়া। অধিকন্তু মানুষের সুখ-দুঃখ খুব বেশি জড়িত এসব ছোট ছোট জিনিসের সঙ্গে। আরেকটি বিষয়ের কথা উল্লেখ না করে আজকের আলোচনা শেষ করা যাচ্ছে না। ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন তো শুধু আমদানি দিয়ে হবে না। দেশীয় শিল্প যদি না বাঁচে তাহলে এই প্রবৃদ্ধি অর্জন কে করবে? আমি ‘স্কুল ফিডিং’ করে বাঁচানোর কথা বলছি না। বলছি অবৈধ কাজের খেসারত দিতে গিয়ে যদি শিল্পের ক্ষতি হয় তাহলে তো তার প্রতিকার দরকার। তাই নয় কী? মাস দুই-তিন আগে কাগজে ছাতার ওপর একটি স্টোরি দেখলাম। আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর পর বেশকিছু ছাতার ইন্ডাস্ট্রি গড়ে ওঠে। আমার মনে আছে ‘শরীফের’ ছাতার কথা। কারা এর মালিক জানি না। কিন্তু এই ব্র্যান্ডের ছাতা কী এখন আছে? কাগজে দেখেছি অসম ও অন্যায্য প্রতিযোগিতার মুখে চীনা ছাতার কাছে দেশীয় ছাতার শিল্প ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে। জুতোর বাজারেও এর প্রভাব আছে। ফুটপাথ ভর্তি বিদেশী চীনা জুতা। এ ধরনের ছোটবড় শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে কী ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে? না কি, শিল্প নয় সেবাখাত দিয়েই প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথ আমরা ধরতে যাচ্ছি। এই মুহূর্তের আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে শাড়ি, থ্রি-পিচ ইত্যাদির বাজার। দুই-তিন আগের একটি রিপোর্টে দেখলাম আমাদের বস্ত্র শিল্প বিরাট হুমকির সম্মুখীন। বিটিএমএ’র সহসভাপতি এক সংবাদ সম্মেলনে তার শিল্পের সঙ্গিন অবস্থা সম্পর্কে আমাদেরকে জানিয়েছেন। তার মতে এই মুহূর্তে ২০-২৫ হাজার কোটি টাকার কাপড়, সুতা স্থানীয় মিলগুলোতে আটকা পড়ে আছে। ৪০ শতাংশ উৎপাদিত কাপড়, সুতা অবিক্রীত। কারণ? কারণ সামনে ঈদ। ঈদের বাজার উপলক্ষে সারা দেশ বিদেশী জামা-কাপড়ে সয়লাব হয়ে গেছে। চীন, পাকিস্তান ও ভারতের জামা-কাপড়ে বাজার যখন সয়লাব। ‘বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশনের’ সহসভাপতি এ ব্যাপারে সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন। তার মতে, বন্ডেড ওয়্যার হাউজের সুবিধার অপব্যবহার করা হচ্ছে। অবৈধভাবে মাল বিদেশ থেকে আসছে। আবার এও সত্যি কথা যে, নিয়মিতভাবে আমদানিকৃত মালের সঙ্গেও প্রতিযোগিতা করে বস্ত্রকলসহ অনেক শিল্প তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারছে না। দেশবাসী প্রচুর মূল্য দিচ্ছে। তারা পণ্যের মূল্য বেশি দিচ্ছে ‘প্রটেকশনের’ নামে। এখন প্রশ্ন এসব সমস্যার সমাধান না করে কী আমরা উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারব? এটা তো নতুন বিনিয়োগের ঘটনা নয়। ইতিমধ্যেই গড়ে উঠা শিল্প দেশীয় বস্ত্র শিল্পকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছিল ‘ব্যাকওয়ার্ট লিঙ্কেজ’ ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে। এখান থেকে রফতানিমুখী গার্মেন্টস খাতে কাপড় যাবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে উল্টো। রফতানিমুখী গার্মেন্টস কারখানা বিনাশুল্কে মাল এসে ‘বন্ডেড ওয়্যারহাউজের’ সুবিধার অপব্যবহার করে সব মাল খোলা বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। মার খাচ্ছে দেশীয় শিল্প। এই অভিযোগই করছেন ‘বিটিএমএ’ নেতা। এর সমাধান কী? এই শিল্পে তো কয়েক হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে। ব্যাংক ঋণ আছে কমপক্ষে ৪-৫ হাজার কোটি টাকা। উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে এসব সমস্যার সমাধানও দরকার। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×