ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ খোশ আমদেদ মাহে রমাদান

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ১৮ মে ২০১৮

প্রসঙ্গ ইসলাম ॥ খোশ আমদেদ মাহে রমাদান

আরবী বর্ষ গণনায় নবম মাস মাহে রমাদানুল মুবারক। এটা একটি চান্দ্র সন। চান্দ্র সনে বছর হয় প্রায় ৩৫৪ দিনে। আর সৌর সনে বছর হয় ৩৬৫ দিনে। চান্দ্র সনের কোন নির্দিষ্ট ঋতুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা নেই যে কারণে প্রতি তিন বছর অন্তর চান্দ্র সনের পরিবর্তন ঘটে। তাই আমরা রমাদান মুবারককে কখনও গ্রীষ্মকালে পাই কখনও শীতকালে পাই। এই বছর ২০১৮ সালে রমাদান এসেছে গ্রীষ্মের দাবদাহে। আমরা অন্তরের সমস্ত পবিত্রতার আবেগে আপ্লুত হয়ে রমাদান মুবারককে জানাচ্ছি খোশ আমদেদ। ৬২৪ খ্রিস্টাব্দ মুতাবিক দ্বিতীয় হিজরির ১ রমাদান ছিল ১ মার্চ। আল্লাহ জাল্লা শানুহু রমাদান মাসকে নির্ধারণ করে দেন সিয়াম পালনের জন্য। সিয়ামের মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন। আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন ‘ওহে তোমরা যারা ইমান এনেছ তাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেয়া হলো যেমন বিধান দেয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের যাতে তোমরা তাক্ওয়া অর্জন করতে পার। (লা আল্লাকুম তাত্তাকুন) সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৩। সিয়াম সৃষ্টির আদিকাল থেকেই বিভিন্ন রূপে প্রচলিত ছিল। মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম আলাইহিস সালাম এবং আদি মাতা মা হাওয়া আলাইহাস সালাম। আল্লাহর একটা হুকুম অমান্য করার জন্য জান্নাত থেকে তাদের বহিষ্কৃত হয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করেন। হযরত আদম আলাইহিস সালাম শ্রীলঙ্কার একটি পাহাড় চূড়ায় এবং মা হাওয়া আলাইহাস সালাম জিদ্দার একটি সমতল ভূমিতে প্রায় ৩৫০ বছর ধরে তাদের ভুলের জন্য মাফ চেয়ে তওবা-ইস্তেগফার করেন। তারা বলেন, রব্বানা জালামনা আনফুসানা অইল্লাম তাগফিরলানা অতারহামনা লানা কুনান্না মিনাল খাছেরিনÑ ‘হে আমাদের রব আমরা আমাদের নিজেদের ওপর জুলুম করেছি। আপনি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি দয়া না করেন তাহলে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব।’ এই দীর্ঘকাল তাঁরা সিয়াম অবস্থায় ছিলেন। অতঃপর তারা প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওছিলা দিয়ে ক্ষমা চাইলে আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করেন। প্রত্যেক নবীর আমলেই সিয়াম রীতির প্রচলন ছিল। যেমন হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তায়ালা প্রথমে ৩০ দিন লাগাতার সিয়াম ও ইতেকাফ্্ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ৩০ দিন পূর্ণ হয়ে গেলে আরও ১০ দিন সিয়াম ও ইতেকাফ করার নির্দেশ দেন। অর্থাৎ মোট ৪০ দিন লাগাতার সিয়াম ও ইতেকাফ করার নির্দেশ দেন। ৪০ দিন পূরণ হয়ে গেলে হযরত মূসা আলাইহিস সালামের নিকট তওরাত কিতাব নাজিল হয়। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট রমাদান মুবারককে সিয়ামের জন্য নির্ধারণ করে দেয়ার পূর্বে তিনি এবং তার সাহাবায়ে কেরামগণ আশুরার সিয়াম পালন করেছিলেন। রমাদান মুবারকে মাসব্যাপী দিবা ভাগে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সিয়াম পালন করা ফরজ হয়ে যায়। তখন আশুরার সিয়াম উত্তম নফল সিয়াম হিসেবে বিবেচিত হয়। ইসলামে সিয়ামের যে বিধান রয়েছে তা সত্যিকার অর্থে সংযমী হওয়ার আত্মউন্নয়ন করবার, আত্মশুদ্ধি অর্জন করবার, সহমর্মিতা অর্জন করবার, সাবধানী জীবন লাভ করবার, ধৈর্যশীল ও বিনয়ী হওয়ার প্রশিক্ষণ প্রদান করে। সিয়ামকে ফরজ করে যে আয়াতেকারীমা প্রথমে নাজিল হয় তাতে দেখা যায়, সিয়াম পালন করাকে আল্লাহ জাল্লা শানুহু এই জন্য ফরজ করেছেন যে, এর দ্বারা সিয়াম পালনকারী তাকওয়া অবলম্বনে অভ্যস্ত হতে পারবে। ইসলাম হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত এবং মনোনীত একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। এ জীবন ব্যবস্থা মানুষকে প্রগতিশীল করে তোলে, মানুষকে সত্য-সুন্দর পথে পরিচালিত করে এবং পরিপূর্ণ সামরিক মূল্যবোধ মানুষকে উজ্জীবিত করে, এ জীবন ব্যবস্থা আল্লাহর সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক সুদূঢ় করে। এ জীবন ব্যবস্থা ধারণ এবং এর বিধিবিধান পালন করার মধ্য দিয়েই কেবল আল্লাহর মনোনীত বান্দায় উন্নীত হওয়া যায়। জীবন ব্যবস্থা অনুযায়ী তাকওয়া অবলম্বন করা অবশ্য কর্তব্য। বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, হে লোক সকল! তোমরা শোনো, আজ আমার পদতলে অন্ধকার যুগের সমস্ত কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস, অনাচার, শিরক্্ কুফর দলিত হলো। তিনি তার সেই ভাষণে এও বলেন, হে লোক সকল! তোমরা শোনো, কোন অনারবের ওপর কোন আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কোন আরবের ওপর কোন অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কোন কালোর ওপর কোন সাদার শ্রেষ্ঠত্ব নেই, কোন সাদার ওপর কোন কালোর শ্রেষ্ঠত্ব নেই, সবাই আদম থেকে এবং আদম মাটি থেকে। শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হচ্ছে তাকওয়া। একবার ফারুকে আযম উমর ইবনুল খাত্তাব রাদি আল্লাহু আনহু বিশিষ্ট সাহাবী হযরত উবায় ইবনে কাব রাদি আল্লাহু তায়ালা আনহুর কাছে তাকওয়ার সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা জানতে চাইলে তিনি তাকে পাল্টা জিজ্ঞাসা করলেন : আপনি কি কখনও কণ্টকাকীর্ণ রাস্তা অতিক্রম করেছেন? হযরত উমর রাদি আল্লাহু তায়ালা আনহু বললেন, হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, কিভাবে সেই রাস্তা অতিক্রম করলেন? হযরত উমর রাদি আল্লাহু তায়াল আনহু বললেন, অতি সাবধানতার সঙ্গে দ্রুত যে পথ পাড়ি দিয়েছি, হযরত উবায় ইবনে কাব রাদি আল্লাহু তায়ালা আনহু তখন বললেন, এটাই তাকওয়া। এ বিবরণ থেকে আমাদের সামনে তাকওয়া সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা উদ্ভাসিত হয়ে যায়। এর দ্বারা এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে সাবধানতার সঙ্গে জীবন পরিচালনা করাই হচ্ছে তাকওয়া। ইসলামে পরিপূর্ণভাবে দাখিল হতে হলে অবশ্যই তাকওয়া অবলম্বন করতে হবে। রমাদানুল মুবারকে সিয়াম পালনের মাধ্যমে সেই তাকওয়া অবলম্বনের প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণ লাভ করার সুযোগ লাভ করে সিয়াম পালনকারী। যা করলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন, আল্লাহর রসুল নারাজ হন এমন কাজ না করার মধ্যে তাকওয়ার তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। তাকওয়া অবলম্বনের মূল অর্থ হচ্ছে : হালালকে গ্রহণ করা, হারামকে বর্জন করা, সকল প্রকার গোনাহ থেকে নিজেকে রক্ষা করা, সন্দেহযুক্ত জিনিস ও কর্ম পরিহার করা, আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় করা এবং আল্লাহর নিকট সত্যিকার অর্থে আত্মসমর্পণ করা। কোরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে, হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় কর এবং তোমরা আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) না হয়ে মরো না (সূরা মায়িদা : আয়াত-৩৫)। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিয়ামকে জাহান্নামের আগুন থেকে নিজেকে রক্ষা করার ঢাল বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, সিয়াম জাহান্নামের আগুনের ঢালস্বরূপ, যতক্ষণ সায়িম সিয়াম ত্যাগ না করে। ঢাল যেমন তীর-তলোয়ার প্রভৃতির আঘাত প্রতিহত করে তেমনি সিয়াম জাহান্নামের আগুনকে প্রতিহত করে। (ইবনে মাজাহ)। হযরত আবু হুরাইরা রাদি আল্লাহু তায়ালা আন্্হু থেকে বর্ণিত একখানি হাদিসে আছে যে, হযরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে উদ্দেশ করে বলেন, আল্লাহ তায়ালা আমার উম্মতকে রমাদান মাসে বিশেষ পাঁচটি জিনিস দান করেন যা অন্য কোন নবীর উম্মতকে দান করেননি। আমার সিয়াম পালনকারী উম্মতের মুখের গন্ধ, আল্লার নিকট মিল্কের সুগন্ধি থেকেও অধিক সুগন্ধি, তাদের জন্য রমাদান মাসে সব জীবজন্তু এমনকি পানির মাছও কল্যাণ কামনা করে। প্রত্যেকটি জান্নাতকে সুসজ্জিত করে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমার বন্ধুরা সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে অতিসত্বর তোমাদের দিকে আসছে। রমাদান মাসে শয়তানকে বন্দী করে রাখা হয়। ফলে সে অন্যান্য মাসের মতো মুমিন বান্দাদের প্ররোচিত করতে পারে না, রমাদানের শেষ রাতে আল্লাহ তায়ালা সিয়াম পালনকারীদের ক্ষমা করেন (বায়হাকী)। রমাদানের সিয়ামের পাশাপাশি সেহরি, ইফতার ও তারাবিহর গুরুত্বও অপরিসীম। এই রমাদান মাসের শেষ দশকে ইতেকাফ করার মধ্যে অশেষ সওয়াব রয়েছে। বিশেষ করে লায়লাতুল কদরকে ইতেকাফের মাধ্যমে অন্বেষণ করা সহজ হয়। যুগশ্রেষ্ঠ সুফী কুতবুল আলম হযরত মাওলানা শাহ্ সুফী তোয়াজউদ্দীন আহমদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন : ইতেকাফ হালতে শবে কদরকে অতি নিকট থেকে অবলোকন করা যায়। লায়লাতুল কদর উম্মতে মুহম্মদীর জন্য আল্লাহ জাল্লা শানুহুর একটা খাস উপহার। এই রাত ইবাদত-বন্দেগীর মধ্য দিয়া অতিবাহিত করতে পারলে হাজার মাস ধরে লাগাতার ইবাদত-বন্দেগী করলে যে সওয়াব পাওয়া যেত তার চেয়েও অধিক সওয়াব লাভ হয়। কোরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে : লায়লাতুল কাদরী খায়রুম মিন আলফি শাহরÑ লায়লাতুল কদর হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেয়। মাহে রমাদানে দান-খয়রাত করলে ৭০ গুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যায়। মাহে রমাদানে সিয়াম পালনের পাশাপাশি যে কোন ভাল কাজ করলে অশেষ সওয়াব লাভের সুযোগ আসে, যে কারণে আরবী চান্দ্র সনের নবম মাস এই রমাদান সর্বাধিক মুবারক মাসের এবং সর্বোত্তম মাসের বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে। রমাদান শব্দটি মূলত আরবী রমাদান শব্দের ফারসি উচ্চারণ। রমাদান শব্দের শব্দমূল হচ্ছে রসদ যার অর্থ গ্রীষ্মের প্রচন্ড উত্তাপ, পুড়ানো ইত্যাদি। সিয়াম পালনের মাধ্যমে সিয়াম পালনকারী তার পাপরাশি পুড়াতে সমর্থ হয় এই মাসে। রমাদান ও সিয়ামের মাহাত্ম্য সেখানেই এবং এর তৎপর্য এরই মধ্যে নিহিত রয়েছে। লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ
×