ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আধুনিক মহাকাব্য -শাহাদাৎ সরকার

প্রকাশিত: ০৮:১৯, ১৮ মে ২০১৮

আধুনিক মহাকাব্য -শাহাদাৎ সরকার

এবারের একুশে বইমেলায় নব্বইয়ের অন্যতম কবি সায়ীদ আবুবকরের ‘মুজিবনামা’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে কিছু সাহিত্য-সমালোচকের মুখে কুলুপ এঁটে দিলেন বলতেই হয়। কেননা, এই সকল সাহিত্য-সমালোচকগণ মনে করতেন, বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মহাকাব্য লিখা আর সম্ভব নয়। তার পেছনে তাঁরা কতগুলো কারণ দাঁড় করাতেন। যাই হোক, সেই কারণগুলো আলোচনা বা ব্যাখ্যা করার ইচ্ছা এখানে আমার নেই। তবে এ কথা ঠিক যে কোন সৃষ্টিশীল কাজ সমালোচকের অগ্নিদৃষ্টি সাপেক্ষ নয়। তা স্রষ্টার মন সাপেক্ষে। আর তাই এই একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এসে আমরা হাতে পেলাম কবি সায়ীদ আবুবকরের আসামান্য সৃষ্টিকর্ম ‘মুজিবনামা’ নামীয় মহাকাব্য। বাংলা সাহিত্যে আধুনিক কবিতার জনক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাতে সৃষ্টি হয়েছিল প্রথম সাহিত্যিক মহাকাব্য ‘মেঘনাদবধ কাব্য’। তাঁর এই সৃষ্টিকর্মে মধ্যে লুকিয়ে আছে উনিশ শতকীয় বাঙালী সমাজের চিন্তার স্ফুরণ। যদিও তিনি কাহিনী সংগ্রহ করেছিলেন ভারতীয় পুরাণগ্রন্থ রামায়ণ থেকে। আর রামায়ণ শুধু পৌরাণিক মহাকাব্যই নয়, পাশাপাশি সনাতন ধর্মালম্বীদের ধর্মীয় গ্রন্থরূপেও স্বীকৃত। আর সেই রামায়ণের থেকে মধুসূদন দত্ত কাহিনী নিলেও ধর্মীয় কোন উদ্দেশ্য তাঁর মহাকাব্য সৃষ্টির প্রেরণা হিসেবে কাজ করেনি। বরং তার মধ্যে ছিল প্রগাঢ় দেশপ্রেম। বলা যেতে পারে দেশপ্রেম থেকেই তাঁর এই মহাকাব্য রচনার চেষ্টা। যা মধুসূদনকে দান করেছে অমরতা। আর শুধু মধুসূদন দত্ত নয়; তাঁর পরবর্তীতে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন, কবি কায়কোবাদ ও ইসমাঈল হোসেন সিরাজী মহাকাব্য রচনার চেষ্টা করেছেন। তবে কেউ মধুসূদনের মতো সফলতা লাভে সক্ষম হননি, তা সমালোচকরা বলেই দিয়েছেন। যাই হোক, এই ইতিহাস বর্ণনা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিতে চাই এই সময়ের অন্যতম কবি সায়ীদ আবুবকরের সৃজিত মহাকাব্য ‘মুজিবনামা’র সঙ্গে। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মধুসূদন দত্ত ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ সৃজনের মধ্য দিয়ে যে জাগরণ ঘটাতে চেয়ে ছিলেন; তাতে তিনি সফল হয়েছিলেন। কবি সায়ীদ আবুবকরও দেশপ্রেম উদ্বুদ্ধ হয়ে সৃজন করলেন মহাকাব্য ‘মুজিবনামা’। ‘মুজিবনামা’ মহাকাব্যটি ১২টি স্বর্গে বিভক্ত। স্বর্গের নামকরণে তিনি কিছুটা মাইকেল মধুসূদন দত্তের রীতিকে অনুসরণ করেছেন। এই মহাকাব্যটির ১২ অধ্যায়ের বিস্তার করে আছেন বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ থেকে শুরু করে পনেরো আগস্টের হৃদয় বিদারক ঘটনাপঞ্জি ও তত পরবর্তী মুজিব তনয়াদের শোকের চিত্রের মধ্য দিয়ে কাব্যটির সমাপ্তি ঘটেছে। আছে একটি মহান জাতির মহান নেতার নেতৃত্বে সংঘটিত মুক্তির আন্দোলনের কথা। কাব্যের কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসাবে আছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ফলে পাঠকের মনে হতে পারে একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে কাব্যগ্রন্থটির কাহিনীর বিস্তার ঘটছে; আসলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী চিত্রের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে বাংলাদেশের বাঙালী জাতির মুক্তির আকাক্সক্ষার কথা। অর্থাৎ এটি শুধু স্বাধীন বাংলাদেশের একজন মহানায়কের গতানুগতিক জীবনী নয়। বরং এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি স্বর্গে উঠে এসেছে সমগ্র বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তা। যা মধুসূদন দত্তের কাব্যেও ছিল। এমনকি মধুসূদন যে মেঘনাদবধ লিখলেন তাতে পৌরাণিক জীবনের নয় বরং সমকালীন জীবন বাস্তবতার ছাপ পায়। তদরূপ মুক্তিযুদ্ধপূর্ব-মুক্তিযুদ্ধকালীন ও মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের চিত্র ফুটে উঠেছে মহাকাব্যটিতে। এই কাব্যটিতে কবি অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহারে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তবে তিনি শব্দচয়নে মধুসূদনীয় হয়ে থাকেননি; বরং আধুনিক শব্দের ব্যবহারে তার কাব্যটি ব্যঞ্জনা লাভ করেছে। বীররস ও কারুণ রস যেমন আছে; পাশাপাশি অন্যান্য রসের সমাবেশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। কাব্যের শেষে যেমন শোকের ছাপ রয়েছে, রয়েছে পরিবারের সকল সদস্য হারানোর হাহাকার, সেই শোক আবার পরিণত হয়েছে শক্তিতে। পড়া যাক তেমনি একটি অংশ - ‘বেইমান!’ বলে, উঠলেন কেঁদে মুজিবদুলালী “সব বেইমান! সব বিশ্বাসঘাতক! কিন্তু এই আমি, জগত-বিখ্যাত পিতা স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কন্যা আল্লার ইচ্ছায় বেঁচে আছি পৃথিবীতে; আমার সন্তান জয় ও পুতুলের কসম, জন্মদাতা পিতার কসম, মায়ের কসম আর আমার প্রাণের ভাই জামাল-কামাল- রাসেলের কসম, কাউকে ছাড়বো না আমি, কাউকেই ছাড়বো না; সব ঘাতকেরই কল্লা আমি ছিঁড়ে নেবো এই হাতে; প্রতিটি মৃত্যুর নিখুঁত হিসেব বুঝে নেবো ঠিকই কড়ায় গন্ডায়, পাই- পাই করে, ঘাতক সে যেই হোক, টুটি তার ছিঁড়ে ফেলবোই।” ‘মহাশোকপর্ব’ : ‘মুজিবনামা’, পৃ. ১১৮-১১৯ ইনভেলাপ পাবলিকেশন এই মহাকাব্যটি প্রকাশ করে জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছে বলেই মনে করছি। কাব্যগ্রন্থটি সাদা অপসেট কাগজে আকর্ষণীয় প্রচ্ছদে মলাট বন্ধ করে পাঠকের সামনে হাজির করেছে ইনভেলাপ পাবলিকেশন। সেই জন্য আমার পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে জড়িত সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি এই মহাকাব্য উপহার দেয়ার জন্য। মহাকাব্যটির বিনিময় রেখেছেন মাত্র ৩০০ টাকা। আমি এই মহাকাব্যের বহুল প্রচার কামনা করছি।
×