ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বুঝলাম উনি খুব শীঘ্রই উঠবেন না। তখনই গান ধরলো বারের একজন শিল্পী ‘জাত গেল জাত গেল বলে ...’ লালন গীতি। আমারও খুব প্রিয়। এখানে কয়েকজন শিল্পীই গান করে। কারো উচ্চারণ ভুল, কারো তাল কেটে যায়। আবার কেউ কেউ ভালো গায়, দেখতেও ভালো

গল্প-বার-এ বসে শোনা গল্প ॥ দেওয়ান শামসুর রকিব

প্রকাশিত: ০৮:২৯, ১৮ মে ২০১৮

গল্প-বার-এ বসে শোনা গল্প ॥ দেওয়ান শামসুর রকিব

-‘মৃত্যু’ বিষয়টা নিয়ে আমি কদিন ধরে ভাবছি। এই ভাবনাটির কোন যোগসূত্র নেই। সেদিন সকাল বেলা উঠেই আমার মনে হলো আজ আমি মারা গেলে কি হবে? কিচ্ছু হবে না। প্রতিদিনই তো বাংলাদেশে গড়ে মরছে প্রায় ১২ থেকে ১৫ জন। এর বেশিরভাগই হচ্ছে রোড এক্সিডেন্ট আর খুন। প্রতিদিন হাসপাতালে অথবা ধরুন বাসায় কতজন রোগী মারা যাচ্ছে তা কিন্তু এই হিসাবে নেই। মানে কি দাঁড়াচ্ছে। আমি মারা গেলাম কি না গেলাম কোন অর্থ নেই। তারপর ‘মৃত্যু’র চিন্তা আমাকে ছাড়ছে না। কিন্তু আত্মহত্যা করব এমনটিও ভাবনায় নেই। -তাহলে আপনি মৃত্যুর কথা ভাবছে কিভাবে? আবাক হয়েই প্রশ্ন করলাম আমি। -সেটাই ভাবনার বিষয়? আত্মহত্যা নয়, কিন্তু ‘মৃত্যু’ চিন্তা সারাক্ষণ আমাকে ঘিরে থাকে। সেদিন মনে হলো আমি মারা গেলে কোন সমস্যাও নেই। আমি বিয়ে করিনি। আমার বাবা-মা আছেন। ভাই বোনরা আছেন। তারা কাঁদবেন হয়তো কয়েকদিন। তারপর যেই কে সেই। কারণ আমাদের ঢাকা শহরের জীবনযাপন খুব প্রতিযোগিতামূলক আর ঘটনা বহুল। সেখানে আমার মতো সাধারণ মানুষ মারা গেলে কিছু কি হবে? আমি সেলিব্রেটি হলে না হয় কথা ছিল। কর্পোরেট অফিসের আমি একজন সিনিয়র মোস্ট ম্যান। এই রকম সিনিয়র ম্যান কতজন আছে সারাদেশে। চতুর্থ পেগটির শেষ করলেন মাহবুব আনাম। পঞ্চম পেগের অর্ডার দিলেন। বুঝলাম উনি খুব শীঘ্রই উঠবেন না। তখনই গান ধরলো বারের একজন শিল্পী ‘জাত গেল জাত গেল বলে ...’ লালন গীতি। আমারও খুব প্রিয়। এখানে কয়েকজন শিল্পীই গান করে। কারো উচ্চারণ ভুল, কারো তাল কেটে যায়। আবার কেউ কেউ ভালো গায়, দেখতেও ভালো। ভাবতে অবাক লাগে এই শিল্পী এখানে কেন? এতো সিনেমার ভালো প্লেব্যাক করতে পারতো? সবার ভাগ্যে কি আর বিজয় মুকুট ওঠে। আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম মাহবুব আনাম চুপ হয়ে গান শুনছেন। একটু পরেই এক হাজার একটি নোট বের করে আয়োজনকে দিলেন শিল্পীকে দেয়ার জন্য। ঢাকা শহরে অনেক বারেই এখন ড্রিংকের সঙ্গে লাইভ গান শোনার ব্যবস্থা আছে। আমি এমনই বারে আসতে পছন্দ করি। এখানে এসে দেখলাম অনেকেরই সেই ভালোলাগা থেকে আসা। বুঝলাম গানের সঙ্গে লোকদের রেসপন্স দেখে। কেউ তালি দিচ্ছে, কেউ ওয়ানমোর কবলে রিকোয়েস্ট করছে, কেউবা গানের তালে নাচার চেষ্টা করছে। ওয়েটার পঞ্চম পেগটি দিয়ে গেছে একটু আগে। নিজের মতো করে সোডাওয়াটার আর আইস মিশিয়ে চুমুক দিলেন পেগে। -যা বলছিলাম। বলেই আবার শুরু করলেন তিনি-আমার চিন্তাটা আসার পেছনে একটা পালানোর মনোবৃত্তি আছে। আমি একটু ভাবুল, আমি মারা গেছেন, দেখবেন আপনার আর কিছু করতে হচ্ছে না। চাকরিতে সময় মতো যাওয়ার টেনশন, বসদের মনমতো নির্দেশ পালন করা, কলিগদের সাথে ভালো সম্পর্ক রেখে চলা, চাকরিতে ইম্পেটেন্স পাওয়া-না পাওয়ার কষ্ট, মাস গেলে বেতন নিয়ে খরচের চিন্তা ইত্যাদি সববিষয় থেকে আপনি মুক্ত হয়ে যাবেন। এর থেকে আর আরাম দায়ক কি হতে পারে। কিন্তু ‘মৃত্যু’ সবসময় পাওয়া যায় না। ‘মৃত্যু’ ঘটতে হয়। না হলে মুক্তির কথা বলছি, মুক্তি মিলবে না। -আপনি তো তাহলে আত্মহত্যার কথাই বলছেন। জানতে চাইলাম আমি। -আত্মহত্যা ছাড়া মৃত্যুকে ডাকা যায় না কথাটি সত্য। বলেই পেগে চুমুক দিলেন, একটু ভাবলেন। আজ আপনাকে একটি দৃশ্যের কথা বলবো, চলতি গাড়িতে আপনি বমি করতে দেখেছেন। -দেখবো না কেন? প্রতিটি মানুষটি এটি দেখেছে বলে আমার ধারণা। -কিন্তু তারা কি প্রতিদিনই দেখে? -মানে? আমার আশ্চর্য হওয়ার পালা। -আমি প্রতিদিনই দেখি। দেখতে খুবই খারাপ লাগে তারপরও দেখতে হয়, দেখা হয়ে যায়। পরবর্তীতে একটি আমার ভাবনায় যোগ হলো। -কি রকম? আমি প্রশ্ন না করে পরলাম না। -আহ গান বন্ধ করলো কেন? মাহবুব আনাম বিরক্ত প্রকাশ করলেন। আপনিই বলুন ওরা পালা করে চার থেকে পাঁচজন গান করে। বিরতি কেন? লাইভ মিউজিকের ক্ষেত্রে প্রতি বারেই এক নিয়ম তা নয়। আজ আমরা যে বারে বসে আছি সেখানে প্রায় দশটার দিকে দশ মিনিটের বিরতি। এই নিয়ে উৎসাহী; শ্রোতাদের মৃদু আপত্তি সত্ত্বেও ঠিকই বিরতি চলছে। আলো-আধারি পরিবেশ থেকে লাইটগুলো জ্বলে ওঠে। এই দশ মিনিট বারে একটু বেশি আলোকিত থাকে। -ওরা তো নিয়ম বদলাবে না। আপনি কি যেন বলছিলেন। -নাহ এই বারেই আসা বন্ধ করে দিতে হবে। আমরা কজন তো নিয়মিত আসছি। যথেষ্ট টাকা ব্যয় করি, প্রচুর টিপস দেই, আমাদের কথা শুনবে না। রাগ ঝরে পরে মাহবুব আনামের গলা দিয়ে। আমি চুপ করে বসে থাকি। আমি ছাপোষা মানুষ এই বিতর্কে না জড়ানোই ভালো। এখানে অনেকেই আসেন শিল্পীদের প্রচুর টিপস দেন। মাহবুব আনাম সেই দলে পড়েন। খানিকক্ষণ চুপ হয়ে থাকেন মাহবুব আনাম। হতে পারে আমার সাপোর্ট না পেয়ে তিনি আর কথা বাড়াতে পারেননি। একটু পরেই তিনি আবার বলতে শুরু করলেন-আপনি কি রিসেন্টলি বমি করেছেন? -আমিও ভাবনায় পড়ি। আমি শেষ কবে বমি করেছি মনে পড়ছে না। খালি মনে আছে ছোট বেলায় জ্বর খুব বেশি হলে বমি হতো। অবশ্য জ্বরের সঙ্গে মাথা ব্যথার একটি সম্পর্ক আছে। আমি ভেবে দেখলাম প্রচ- শরীর নিংড়ে যখন বমি হয় তখন যে কষ্ট লাগে কি বলবো আপনাকে। আমি বমি করি। মদ খাওয়ার পর বমি করি। কখন যে কষ্ট লাগে মনে হয় আর জীবনে খাব না। তখন মনে হয় জানটা বোধ হয় বেরিয়ে গেল। এই বমি করতে গিয়েই মনে হলো এখন যদি আমি মারা যাই। এই ভাবনা থেকে ‘মৃত্যু’ চিন্তা এলো আমার মনে। ঠিক বললাম কি? ফ্রয়েডের স্বপ্ন তত্ত্ব বা স্বপ্ন ব্যাখ্যা পড়েছেন। আমি আমার ‘মৃত্যু’ চিন্তার কারণ খুঁজছি। আবাক ব্যাপারটি কি জানেন, আমি কিন্তু ঠিকই ঘুমাচ্ছি। ‘মৃত্যু’ চিন্তা নিয়ে কেউ কি ঘুমাতে পারে বলে মনে হয় না। আমার ‘মৃত্যু’ চিন্তা আর ঘুম পাশাপাশি চলছে। জন্মিলে মরিতে হবে-এই কথাটি জানা সত্ত্বেও লোকজন ‘মৃত্যু’কে ভয় পায়। ‘মৃত্যু’ নিয়ে ভাবনা কাজ করে না। সাবারই ‘মৃত্যু’ থাকা উচিত। একটি পরিকল্পনাও থাকা যেতে পারে। যেমন আপনার লাশ কি করবেন। সেদিন মনে হলো আমার বডিটা মেডিক্যালে দিয়ে দিব। পোলাপানরা কাটাছেড়া করবে। কি ভালো হবে না। -আপনার কি আসলেই ‘মৃত্যু’ ভীতি নেই? আমি কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করি। -না। মৃত্যুই সত্য। সত্য যে কঠিনই হোক, তাহারে লও সহজে। ঠিক বলতে পারলাম না তবে কবিগুরু এই রকমই বলেছিলেন। চলি ব্রাদার। মাহবুব আনাম বিল দিয়ে চলে গেলেন। আমি বসে থাকি। নিজেকে কেন জানি একা মনে হচ্ছে। ভীষণ একা। এটাই কি ‘মৃত্যু’ ভয়!
×