ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘বায়োরিদম’ অনুযায়ী ক্যান্সার চিকিৎসা

প্রকাশিত: ০৮:৩৩, ১৮ মে ২০১৮

‘বায়োরিদম’ অনুযায়ী  ক্যান্সার চিকিৎসা

শরীরের ভিতরে যে ঘড়ি আছে, তার ছন্দেই আমাদের জীবন চলছে। ক্যানসারের মতো দুরূহ রোগে জোরালো সব ওষুধের সাইড এফেক্ট কমানোর জন্যও নাকি ‘বায়োরিদম’ ব্যবহার করা সম্ভব, যেমন দিনের বদলে রাতে ওষুধ দিয়ে। প্যারিসের পোল ব্রুস ইউনিভার্সিটি ক্লিনিকের গবেষকরা এমন তথ্য জানিয়েছেন।। ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ফ্রঁসিস লেভি, পোল ব্রুস ইউনিভার্সিটি ক্লিনিকের গবেষক। প্রায় তিন দশক ধরে ক্যান্সার রোগীদের ‘ক্রোনোথেরাপি’ নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন তিনি? তিনি বলেন,আমাদের শরীরের অভ্যন্তরে একটি ঘড়ি আছে, যার কল্যাণে কিছু কিছু মানুষ একটু বেলা না হলে ঠিক চাঙ্গা হয়ে ওঠেন না। শরীরের কিছু কিছু দেহযন্ত্র দিনের বেলা বেশি সক্রিয় থাকে, অন্যগুলো রাতে। শরীরের বহু প্রক্রিয়া যেন একটি ২৪ ঘণ্টার ছন্দে কাজ করে। ফ্রঁসিস লেভি এই ‘বায়োরিদম’-এর উপর নির্ভর করে তাঁর রোগীদের ক্যান্সার চিকিৎসা চালান। ‘ক্রোনোথেরাপি’র অর্থ হলো, দিন বা রাতের বিশেষ বিশেষ সময়ে বিশেষ ধরণের ওষুধ দেওয়া। লেভির ভাষায়, ‘আমি ভোরে ওঠার লোক নই। ভোরবেলা উঠতে আমার ঘোর আপত্তি।’ তিনি বলেন, ‘ব্যাপারটা চিরকালই রহস্যময় ছিল। প্রথমদিকে আমরা ক্রোনোথেরাপির কর্মপ্রক্রিয়া সম্পর্কে কিছুই জানতাম না।’ লেভির গবেষণার ফলে পরিস্থিতি অনেকটা বদলে গেছে। প্রথম সমীক্ষাগুলো প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি আল্যাঁ পেরেনো’র মতো ক্যান্সার রোগীদের নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন। পেরেনো’র বয়স ৬০; বেশ বর্ধিত পর্যায়ের আন্ত্রিক ক্যান্সারের রোগী। সাধারণ চিকিৎসা তাকে সাহায্য করতে পারেনি। অপরদিকে রোগীর বায়োলজিক্যাল ক্লক অনুযায়ী ক্রোনোথেরাপি চলে বলে তা রোগীর শরীরের ওপর অনেক কম চাপ দেয়। লেভির মতে, ‘ওষুধটা কখন দেওয়া হচ্ছে, সে অনুযায়ী তার বিষক্রিয়া কম কিংবা বেশি হতে পারে। কারণ শরীরের যে প্রণালীটি ওষুধের বিষক্রিয়া রোধ করছে, সেটি চলে ঐ অভ্যন্তরীণ ঘড়ি অনুযায়ী।’ ওষুধের বিষক্রিয়া কমানোর জন্য রোগীদের একটি পাম্পের সঙ্গে যুক্ত করা হয়, যা বিশেষ বিশেষ সময়ে ওষুধের কার্যকরী উপাদানগুলো রোগীর শরীরে পাম্প করে। পেরেনোর চারটি ওষুধের একটি দেওয়া হয় দুপুরবেলা; অন্য তিনটি প্রধানত রাতে, যখন শরীরের সুস্থ কোষগুলোর বিভাজন ক্যান্সারগ্রস্ত কোষগুলোর তুলনায় কম হয়। ফলে সুস্থ কোষগুলোর ওপর ওষুধের প্রকোপও কম হয়; যার ফলে ওষুধের সাইড এফেক্ট বা আনুষঙ্গিক উপসর্গ কমে যায়। আল্যাঁ পেরেনো বলেন যে, তাঁর ক্ষেত্রে এই চিকিৎসার শুভ দিক বাকি সব অসুবিধাকে ছাড়িয়ে গেছে: ‘কিছু কিছু সাইড এফেক্ট বাদ দেওয়ার উপায় নেই, যেমন চুল পড়ে যাওয়া কিংবা খিদে কমে যাওয়া। কিন্তু এই সব অনুষঙ্গ প্রথাগত চিকিৎসার চেয়ে অনেক কম। আর চুল কমায় দুঃখেরই বা কী আছে। চুল পড়ার আওয়াজ তো আর শোনা যায় না, কাজেই ওতে আমার কিছু আসে যায় না।’ ক্রোনোথেরাপি আল্যাঁ পেরেনোর ক্যান্সারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করেছে। কিন্তু এই থেরাপি সব ক্যান্সার রোগীর ক্ষেত্রে কাজ করে না বলে বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে জানা গেছে। একজন পেশেন্টের ‘বায়োরিদম’ বিভিন্ন উপাদানের ওপর নির্ভর করে। দিবারাত্রির ছন্দ চোখে আলো ঢুকলে, মস্তিষ্কের একটি কেন্দ্রীয় ঘড়ির কাছে সংকেত যায়, যা আমাদের বায়োলজিক্যাল ক্লক-এর সময় নির্দিষ্ট করে। বস্তুত আমাদের জিন নির্ধারণ করে, আমরা দিনের মানুষ না রাতের মানুষ! আমরা কখন খাই বা চলাফেরা করি কিংবা ঘুমোই, তা থেকেও শরীরের ‘ছন্দ’ প্রভাবিত হয়। ফ্রঁসিস লেভি ও তাঁর সহকারীরা প্রত্যেক রোগীর ব্যক্তিগত অভ্যন্তরীণ ঘড়িটির সঙ্গে পরিচিত হবার চেষ্টা করেন। পেশেন্টের বুকে বসানো একটি সেন্সর থেকে মিনিটে মিনিটে গবেষকদের কাছে তথ্য পাঠানো হয়। যার মধ্যে পড়ে ত্বকের উপরিভাগের তাপমাত্রা, পেশেন্টের বর্তমান গতিবিধির পর্যায়, এমনকি পেশেন্ট বসে আছেন না শুয়ে আছেন, সে খবর পর্যন্ত। চিকিৎসকরা এভাবে পেশেন্টের বায়োরিদম নির্ধারণ করতে পারেন। যেমন তারা ঘুমোচ্ছেন, নাকি জেগে আছেন। ক্রোনোথেরাপির ভবিষ্যত উজ্জ্বল হতে পারে, কিন্তু আপাতত অধিকাংশ ক্যানসার রোগীর জন্য তা একটি আশাজনক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ছাড়া আর কিছু নয়। সূত্র : লাইফ সায়েন্স, ডয়েচ ভেলে
×