ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নজরুলের জীবন ও সাহিত্যে আর এক উল্লেখযোগ্য রমণী মিসেস এম রহমান। সেই সময়ের কঠোর অবরোধ প্রথা থেকে যে কয়েকজন হাতেগোনা মুসলিম নারী অন্তঃপুর থেকে বের হয়ে আসেন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য এই মিসেস এম রহমান। নজরুল-প্রমীলার বিয়েতে মা গিরিবালা ছাড়া আর যিনি সমস্ত সহযোগিতার

নজরুলের জীবন ও সাহিত্যে মাতৃবন্দনা

প্রকাশিত: ০৮:৩৮, ১৮ মে ২০১৮

নজরুলের জীবন ও সাহিত্যে মাতৃবন্দনা

নাজনীন বেগম ॥ বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের আবির্ভাব তৎকালীন সময়ের এক আলোকিত এবং যুগান্তকারী অধ্যায়। ১৮৯৯ সালে জন্ম নেয়া কবির শৈশব-কৈশোর অতিক্রান্ত হয় অবিভক্ত বাংলার হরেকরকম বিক্ষুব্ধ আর সংঘাতের উত্তাল সময়ে। ব্যক্তিগত জীবনও নির্বিঘœ আর শঙ্কাহীন ছিল না। বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে নজরুলের জন্ম সেটা তাকে নিয়ে যায় টানাপোড়েনের এক নির্মম অভিঘাতে। মাত্র ৯ বছর বয়সে পিতৃহীন নজরুল মাতৃ-সান্নিধ্য থেকেও প্রায় দূরেই ছিলেন। সীমাবদ্ধ পারিবারিক আঙিনা তাঁকে কখনও প্রলুব্ধ করতে পারেনি। শৈশব-কৈশোরের হরেকরকম ঝড়-ঝাপটায় নামতে হয় জীবনযুদ্ধের কঠোর অভিঘাতের পালাক্রমে। বিস্ময়কর এই বালক মক্তবে পড়া থেকে শুরু করে মোল্লার কাজ ও খাদেমগিরি করতেও পিছপা হয়নি। সব কিছুর মূলেই কি ছিল স্নেহময়ী জননীর একান্ত সান্নিধ্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার করুণ আখ্যান? নজরুলের জীবন ও সাহিত্যে মাতৃপূজার অনেক বাস্তব উপখ্যান সংঘটিত হলেও জন্মদাত্রী মায়ের সঙ্গে তেমন কোন বাঁধনই কখনও কারও চোখে পড়েনি। বালক নজরুলের গৃহত্যাগের প্রায় ১০ বছর পর মা জাহেদা খাতুনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত হয়। ১৯২০ সালে পল্টন থেকে ফিরে কবি একবার গ্রামের বাড়ি চুরুলিয়ায় যান। সেখানে মায়ের সঙ্গে দেখা করার কোন অনুভব অনুভূতি কবিকে তাড়িত করেনি। বলেই প্রচলিত। মা আর ছেলের এই বিপন্ন অবস্থা সম্পর্কে তেমন কোন কিছু জানা সম্ভব হয়নি। পরিণত বয়সেও নজরুল এই দুঃসহ সম্পর্কের রেশ টেনেছেন। মাতা-পুত্রের এই অনভিপ্রেত আলগা বাঁধন বিসদৃশ্য হলেও শেষ অবধি তা অতিক্রম করা কারও পক্ষেই সম্ভব হয়নি। বোধহয় সেই কারণে মাতৃস্নেহের এক নিরবচ্ছিন্ন আকাক্সক্ষা নজরুলের হৃদয়ে বরাবরই ছিল। ফলে মায়ের আদলে কোন নারীকে প্রত্যক্ষ করা নজরুল নিজেই তার পূজার অর্ঘ্য নিবেদন করে দিতেন। এসব মাতৃসমা মহিলার স্নেহের আবেষ্টনীতে নজরুল অতি সহজেই বাধাও পড়তেন। এঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য মা বিরজা সুন্দরী দেবী। কবিবন্ধু বীরেন্দ্র কুমারের মা এবং স্ত্রী প্রমিলা দেবীর কাকিমা। কবি দেশের অভ্যন্তরে প্রায়ই ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতেন। সেই ভাবে এক সময় কুমিল্লা যাওয়ার পথযাত্রায় বিরজা সুন্দরীর গৃহে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। ১৯২১ সালের ঘটনা। মাঝখানে অশান্ত নজরুলের জীবনে ঘটে আরও একটি দুর্ঘটনা। নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের বিয়ে নিয়ে যে বিপত্তি দেখা দেয় তাতে কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই দুঃসময়ে মা বিরজা সুন্দরীর পরম সেবা আর যত্নে নজরুল সুস্থ হয়ে ওঠেন। এর পরের ঘটনা বিরজা সুন্দরী স্নেহময়ী জননী রূপে নজরুলের জীবন ও সাহিত্যে চিরস্থায়ী জায়গা করে নেয়ার এক অভূতপূর্ব আখ্যান। যা দুই অনাত্মীয় দূরের মানুষের সম্পর্কে স্নেহের ছায়ায় একীভূত করে নিকট থেকে নিকটতর পর্যায়ে নিয়ে যায়। ‘ধূমকেতু’র মামলায় আটক হওয়ার পর ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে কবির বিক্ষুব্ধতার প্রকাশ ঘটে আমরণ অনশনব্রত পালন করার মধ্য দিয়ে। সে সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথসহ অনেকেই এই অনশন ভাঙ্গার অনুরোধ জানান নজরুলকে। মা জাহেদা খাতুনও কারাগারে ছুটে এসেছিলেন ছেলেকে অনশনের সঙ্কল্প থেকে সরিয়ে আনতে। কিন্তু কবি গর্ভধারিণী মায়ের সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করেননি। এক সময় এই অনশনব্রত থেকে কবি নিজেকে মুক্ত করেছিলেন মা বিরজা সুন্দরীর অনুরোধকে উপেক্ষা করতে না পেরে। সুতরাং বুঝতে অসুবিধা হয় না এই বিরজা সুন্দরীর জায়গা নজরুলের কাছে কতখানি ছিল। আপন মায়ের স্বাভাবিক মমতা থেকে দূরে থাকা কবির ভেতরে সব সময়ই মাতৃসান্নিধ্যের প্রবল আকাক্সক্ষা সুপ্তাবস্থায় বিরাজমান থাকত। সময়ে তা প্রকাশও হয়ে যেত। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ভঙ্গের আশঙ্কায় নজরুল-প্রমীলার বিয়েতে বিরজা সুন্দরীর আপত্তি থাকলেও তা শেষ অবধি চিরস্থায়ী সঙ্কটের রূপ নেয়নি। কারণ কবির সঙ্গে এই মায়ের সম্পর্কের টানাপোড়েন কখনও দৃশ্যমান হয়নি। পরবর্তীতে ও এই সুদৃঢ় বন্ধনের জের অব্যাহত থাকে। এক সময় ১৯২৬ সালে প্রকাশিত ‘সর্বহারা’ কাব্যগ্রন্থটি কবি বিরজা মাকেই উৎসর্গ করেন। উৎসর্গ কবিতায় কবির আকুল নিবেদন মা বিরজা সুন্দরীকে- সর্বসহা সর্বহারা জননী আমার তুমি কোনদিন কারো করনি বিচার, কারেও দাওনি দোষ। ব্যথা-বারিধির কূলে বসে কাঁদো মৌনা কন্যা ধরণীর এই মাতৃসমা মমতাময়ী নারী ১৯৩৮ সালে মারা যাওয়ার সময় মৃত্যুশয্যায় কবি তার পাশে ছিলেন। পরিচিত হওয়ার সূচনাকাল থেকেই জীবনের শেষ অবধি নজরুল এই স্নেহশীল নারীর মায়া-মমতা আর ভালবাসায় সিক্ত হয়েছেন, পূর্ণতা লাভ করেছেন সর্বোপরি মাতৃস্নেহের তীব্র আকাক্সক্ষায় পরিতৃপ্তও হয়েছেন। নজরুলের জীবনে আর এক স্নেহময়ী জননীরূপে আবির্ভূত হন স্ত্রী প্রমীলা দেবীর মা গিরিবালা দেবী। অকাল বৈধব্যের অভিশাপ নিয়ে কন্যা প্রমীলাকে নিজের স্নেহছায়ায় গড়ে তোলার কঠিন ব্রতে গিরিবালা দেবীর সংগ্রামী জীবনের অভিযাত্রা চলতে থাকে। এরই মধ্যে মেয়ে প্রমীলার সঙ্গে নজরুলের নিবিড় সম্পর্কের টানাপোড়নে সমাজ, সংসার এবং সংস্কার পথরোধ করে দাঁড়ায়। কিন্তু মা গিরিবালা দেবীর অসম সাহস, সংস্কারকে তোয়াক্কা না করার দুর্দমনীয় তেজ নজরুল-প্রমীলার বিয়েতে নির্ণায়কের ভূমিকায় নামে। ফলে শুধু বিয়ের পিঁড়িতে বসা নয় জীবনভর এই সংগ্রামী নারী পারিবারিক সম্পর্কের অচ্ছেদ্য বাঁধনে জড়িয়ে পড়েন। সুখে-দুঃখে, বিপদে-বিপর্যয়ে গিরিবালা সব সময়ই মেয়ের সংসারকে আগলে রাখার চেষ্টা করেন। ১৯৪২ সালে নজরুল বাকহীন হয়ে পড়লে এই গিরিবালাই কবির সেবা-যতেœর দায়িত্ব নেন। কারণ স্ত্রী প্রমীলা তখন পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী। নিজেই নড়া-চড়া করতে পারেন না স্বামীকে দেখবেন কি? ফলে গিরিবালাকেই কন্যা এবং নজরুলের যাবতীয় ভার বহন করতে হয়। এর পরও প্রথা সিদ্ধ সমাজ গিরিবালার পিছু ছাড়েনি। সাম্প্রদায়িক উৎপাতের বেড়াজাল ডিঙানো প্রায়ই অসম্ভব হয়ে উঠছিল। হরেকরকম দুর্নামের বোঝা কাঁধে নিতে হয়েছিল তাকে। স্বেচ্ছাচারিতা, বেহিসেবি সব ধরনের অপবাদ মাথায় নিয়ে কোনমতে নজরুলের সংসারে টিকে থাকলেও একসময় সে হালও তাকে ছাড়তে হয়েছিল। কারণ একদিন গিরিবালা তার ওপর অন্যায়ভাবে চাপানো অপরাধগুলো মানতে না পেরে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। এরপরে আর কখনও তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। নজরুলের জীবন ও সাহিত্যে আর এক উল্লেখযোগ্য রমণী মিসেস এম রহমান। সেই সময়ের কঠোর অবরোধ প্রথা থেকে যে কয়েকজন হাতেগোনা মুসলিম রমণী অন্তঃপুর থেকে বের হয়ে আসেন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য এই মিসেস এম রহমান। নজরুল-প্রমীলার বিয়েতে মা গিরিবালা ছাড়া আর যিনি সমস্ত সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি মিসেস রহমান। তিনি শুধু পর্দা প্রথাকে ভাঙতে পেরেছিলেন তা কিন্তু নয়, জ্ঞানে, সংস্কৃতি চর্চায়, নারীর অধিকার আদায়ে তৎকালীন সময়ে বলিষ্ঠ ভূমিকাও রেখেছিলেন। নজরুলের সঙ্গে নিবিড় মাতৃস্নেহের বন্ধনে জড়ানো এই রমণী কবির জীবনে উদ্দীপকের ভূমিকায় ছিলেন। তাকেও কবি মায়ের মর্যাদায় আপন হৃদয়ে স্থান দেন। নজরুল তার শ্রদ্ধাস্পদ হৃদয়ের অর্ঘ্য এই মাতৃসমা নারীকে নিবেদন করতে কুণ্ঠিত হননি। নজরুলের ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় নারী-বিষয়ক একটি পর্যায়ে ছিল যেখানে মিসেস রহমান নিয়মিত অগ্নিঝরা বক্তব্য উপস্থাপন করতেন বঙ্গললনাদের পক্ষ হয়ে। বিষের বাঁশি কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেন এই অনন্য নারীকে। উৎসর্গপত্রে লিপিবদ্ধ আছে নজরুলের হৃদয়ের বরমাল্যÑ তোমার মমতা-মানিক আলোকে চিনিনু তোমারে তুমি লাঞ্ছিতা বিশ্বজননী। তোমার আঁচল পাতা। মিসেস রহমানের অকাল মৃত্যু কবিকে শোকে মূহ্যমান করে দেয়। অসময়ে এই মহীয়সীর চলে যাওয়াকে স্মরণ করে লিখলেন ‘মিসেস এম রহমান’ নামে সুদীর্ঘ শোকগাঁথা।
×