ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মহাকাশে বঙ্গবন্ধু জয়ের হোক জয়

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ২০ মে ২০১৮

মহাকাশে বঙ্গবন্ধু জয়ের হোক জয়

১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে সংঘটিত বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে বর্বরতম প্রক্রিয়ায় রাজনীতির পটপরিবর্তনে পরাজিত শক্তি এই ধারণা পাকাপোক্ত করার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল যে, তারা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সার্থকতার সেখানেই পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছে। তাদের উপলব্ধিতে এটি হয়ত স্পষ্ট ছিল নাÑ ইতিহাস-বাস্তবতা এবং সত্যেও কঠিন বহিঃপ্রকাশ কখনও রুদ্ধ করা যায় না। বর্তমান বাংলাদেশ তারই উজ্জ্বল উদাহরণ। দীর্ঘ সামরিক শাসনকালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠিত এ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ হয়েছিল প্রচ- নেতিবাচক বিশ্লেষণে চরম আক্রান্ত। বিশ্ব পরিম-লে দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি, পরিবারতন্ত্র, অনৈতিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, মঙ্গা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, জঙ্গী-মৌলবাদ, কূপম-ূকতা, অনাধুনিকতা ইত্যাদিও পৃষ্ঠপোষকতায় অন্যতম সভ্যতাবিরোধী রাষ্ট্র হিসেবে বিরূপ পরিচয়ে মর্যাদাহীন হয়ে পড়েছিল। মজার বিষয় হচ্ছে এই জাতির জনকের সুযোগ্য তনয়া গণতন্ত্রের মানসকন্যা মানবতার জননী দেশরতœ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান বাংলাদেশ সামষ্টিক আর্থ-সামাজিক সকল নিয়ামক বিবেচনায় উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে সমাদৃত। ইতোমধ্যেই সততা, সুশাসন, নান্দনিকতা, আধুনিকতা, অসাম্প্রদায়িকতার বিশ্ব প্রতিকৃত সফল রাষ্ট্রনায়কদের অন্যতম শীর্ষস্থানে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে দেশ-জাতি-দেশবাসীকে করেছেন গৌরবান্বিত এবং উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের বিশ্বনাগরিক মর্যাদায় সমাসীন। ২০০৮-২০০৯ সালে দেশের কোন মানুষ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি বাংলাদেশ অল্প সময়ের মধ্যেই ডিজিটাল রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হবে। ১২ মে ২০১৮ দেশের জন্য গৌরবের নতুন এক অধ্যায়ের শুরু। বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে মহাকাশ জয় করে বিরল সম্মান অর্জনের মাধ্যমে নতুন মাইলফলক স্থাপিত হলো। গৌরবের সঙ্গে গৌরবের সম্মিলন ঘটিয়ে লাল-সবুজ পতাকায় বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু শোভিত বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপিত হয়েছে এমন এক অত্যুজ্জ্বল যুগান্তকারী স্থান থেকে তথা কেনেডি স্পেস সেন্টারের ৩৯-এ লঞ্চ কমপ্লেক্স যেখান থেকে ১৯৬৯ সালে আমেরিকার এ্যাপোলো-১১ মহাকাশ যান চাঁদে পৌঁছে দিয়েছিল পৃথিবীর প্রথম মানব সন্তানকে। এ যেন এক কল্পনা বিলাসীর কল্পলোকে ভাসমান কোন ভেলা। এতদিন এই ধরিত্রীর বুকে ‘বাঙালীর বঙ্গবন্ধু-বিশ্ববন্ধু শেখ মুজিব’ নামের যে অবিসংবাদিত বিশ্বনেতা নানা উচ্চারণে সম্বোধিত ছিলেন, তিনি আজ মহাকাশেও তাঁর সেই বিশাল ব্যক্তিত্বকে উড়িয়ে দিয়েছেন এবং নতুন মাত্রিকতায় বাংলাদেশকে নন্দিত করেছেন। দেশবাসী অবগত আছেন যে, এই মহৎ কর্মযজ্ঞের পেছনে যার অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনি হলেন জাতির জনকের সুযোগ্য জামাতা বিশ্ববরেণ্য পরমাণু বিজ্ঞানী প্রয়াত এম এ ওয়াজেদ মিয়া এবং দেশরতœ শেখ হাসিনার যোগ্যতম পুত্র খ্যাতিমান তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। এক প্রচ- কৌতূহল ও আবেগের স্ফুলিঙ্গ দেশের মানুষকে ১০ মে ২০১৮ বৃহস্পতিবার শেষ রাতে তাড়িত করছিল এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের দৃশ্য পর্যবেক্ষণে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় উৎক্ষেপণস্থলে তাঁর নেতৃত্বে ৪২ জন বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য ছিলেন প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহম্মদ পলকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নির্ধারিত সময়ের সামান্য আগে উৎক্ষেপণ স্থগিত হয়। আশান্বিত হওয়ার যে বিষয়টি এখানে উল্লেখযোগ্য তা হলো তিনি যথাসময়ে বিশ্বেও সকল বাঙালী এবং অপেক্ষায় থাকা জনগণকে খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে পুরো ব্যাপারটি চমৎকারভাবে অবহিত করলেন। প্রথম প্রচেষ্টায় উৎক্ষেপণ স্থগিত হওয়া সম্পর্কে ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে লেখেন, ‘উৎক্ষেপণের শেষ মুহূর্তগুলোকম্পিউটার দ্বারা সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। হিসেবে যদি একটু এদিক-সেদিক পাওয়া যায় তাহলে কম্পিউটার উৎক্ষেপণ থেকে বিরত থাকে। আজ যেমন নির্ধারিত সময়ের ঠিক ৪২ সেকেন্ড আগে নিয়ন্ত্রণকারী কম্পিউটার উৎক্ষেপণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। স্পেসএক্স সবকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আগামীকাল একই সময়ে আবারও আমাদের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ বহনকারী রকেটটি উৎক্ষেপণের চেষ্টা চালাবে। যেহেতু এই ধরনের বিষয়ে কোন ঝুঁকি নেয়া যায় না, সেহেতু উৎক্ষেপণের মোক্ষম সময়ের জন্য অপেক্ষা করা খুব সাধারণ বিষয়, চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।’ (সমকাল ১২.০৫. ২০১৮) এটিই তো জনবান্ধব সরকারের জননন্দিত উপদেষ্টার প্রশংসনীয় কর্তব্য। প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে আশ্বস্ত করলেন ‘এটা নিয়ে কারও দুশ্চিন্তার কিছু নেই। ইনশাআল্লাহ স্যাটেলাইট অবশ্যই উৎক্ষেপণ হবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ আকাশে যাবে। আমরা যে আকাশও জয় করেছি এটাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার। অন্তত এটুকু বলব, কেউ যেন এটা নিয়ে মন খারাপ না করে।’ ১০ মে সমাবেশে তিনি আরও বলেছেন, সততার সঙ্গে রাজনীতি করেছি বলেই আজ পদ্মা সেতু নিজেদের অর্থায়নে করতে সক্ষম হয়েছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি। বহমান সময়ের গতিময়তায় আমরা জানি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি জীবনধারার পরিবর্তনকে শুধু স্পর্শ করে না, কার্যকর কর্মশক্তির যোগান দিয়ে জনজীবনকে করে দক্ষ এবং উৎপাদন করে অপার সম্ভাবনার মানবসম্পদ। আমরা এও জানি, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিবেশী দেশ ভারত আমাদের প্রভূত সাহায্য-সহযোগিতা করলেও তারাও ছিল অনেকটা অসচ্ছল এবং শক্তি-সম্পদের দিক থেকেও অনেক পিছিয়ে। তারা এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে সর্বাধিক প্রধান্য দিয়ে চাঁদে রকেট পাঠিয়ে পানির অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছে এবং মঙ্গল গ্রহে রকেট পাঠিয়ে এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে বিশ্বে সমাদৃত হয়েছে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কোরিয়া চার-পাঁচ দশক আগে উন্নয়ন মানদ-ে প্রায় আমাদের মতোই ছিল। কিন্তু তাদের অধিকতর দ্রুত সাফল্যের পেছনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অবদান অনস্বীকার্য। আমাদের হয়ত অনেকের জানা আছে যে, ১৭৬০-১৮৬০ সালের মধ্যে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব সংঘটনের ফলে বিরাজিত সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানসিক বলয়ে বিপুল উন্নয়ন সাধিত হয়েছিল। ১৮৮৪ সালে আরনল্ড টয়েনবী প্রণীত ‘খবপঃঁৎবং ড়হ ঃযব ওহফঁংঃৎরধষ জবাড়ষঁঃরড়হ রহ ঊহমষধহফ’ গ্রন্থটি দ্রুততর পরিবর্তন পটভূমিকে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি দিয়েছিল। বাষ্পীয় শক্তির ব্যবহার, যোগাযোগ ও পরিবহন, বিশেষ করে রেলপথের উন্নতি এই পরিবর্তনের বিকাশমানতাকে অধিকত্ব রান্বিত করে। দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব বলতে আমরা বুঝে থাকি বিদ্যুতের আবিষ্কার এবং ব্যবহার, যা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে উন্নয়নের এক প্রযুক্তিগত ধারা সৃষ্টি করেছে। একই শতাব্দীর প্রায় মাঝামাঝি সময় থেকে কম্পিউটার আবিষ্কার, বিপণন ইত্যাদি বিশ্বায়নের সূচনাকে নবতর অধ্যায়ে উন্নীত করে। সংস্কৃতির অসম অগ্রগতিতে বস্তুগত সংস্কৃতিকে এগিয়ে এবং অবস্তুগত সংস্কৃতিকে পিছিয়ে নেয়ার পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থা অনেক বেশি সমালোচিত ছিল। তবুও এটি নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, কেন্দ্র ও প্রান্তিক দেশসমূহের মধ্যে একটি আপেক্ষিক ভারসাম্য রক্ষায় এই তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের তাৎপর্যও উদ্ভাবন সভ্যতার ইতিহাসে সমুজ্জ্বল। শুরু হলো একবিংশ শতাব্দীর নতুন অভিযাত্রা চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির নব নব উদ্ভাবন এবং অপব্যবহারের প্রক্রিয়াকে সঙ্কুচিত করে যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে মানবিক কল্যাণ নিশ্চিতকরণ, যাকে এক কথায় বলা যায় ডিজিটাল বাংলাদেশ, ডিজিটাল বিশ্ব। যে চারটি মৌলিক ধারণাকে ডিজিটাল বাংলাদেশ তথা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রধান উপাদান হিসেবে বিবেচিত করা হয়েছে তা হলো : ক. কানেক্টিং বাংলাদেশ, খ. দক্ষ মানবসম্পদ, গ. ই-গবর্নমেন্ট এবং ঘ. ইন্ডাস্ট্রি প্রমোশন। ১২ ডিসেম্বর ২০১৭ সাল দেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় তথ্য ও প্রযুক্তিদিবস উদযাপনের মাধ্যমে যেসব উদ্যোগকে গুরুত্বসহকারে পুরো দেশে ছড়িয়ে দেয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে তা পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের মাধ্যমে শুধু মহাকাশ জয় নয়, প্রতিটি ক্ষেত্রে এর ব্যবহারকে সমৃদ্ধকরণ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করে নগর ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনের সব মঙ্গল নিশ্চিতকল্পে এটি আরও অধিকতর এগিয়ে যাক এটিই প্রত্যাশিত। লেখক : শিক্ষাবিদ, উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×