ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

গণমানুষের জন্য শেখ হাসিনার লড়াই

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ২০ মে ২০১৮

গণমানুষের জন্য শেখ হাসিনার লড়াই

॥ দ্বিতীয় পর্ব ॥ শেখ হাসিনা সম্প্রতি তার রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে বলেছেন, ‘বাল্যকাল থেকে আমি দেশের রাজনৈতিক উত্থান-পতন এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। আমার বাবা ও তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীদের অপরিসীম নির্যাতনের আমি সাক্ষী। আমার বাবা তাঁর জীবনের বিরাট একটি অংশ জেলে কাটিয়েছেন। যখনই জেলের বাইরে ছিলেন, রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও দলের সাংগঠনিক কাজে নিজেকে তিনি ব্যস্ত রেখেছেন। আমার মাকে দেখেছি বাবার রাজনৈতিক সাথী হিসেবে এবং বাবার অনুপস্থিতিতে পর্দার আড়াল থেকে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে দলীয় আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। আমাদের পারিবারিক পরিবেশে আমার রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়। ১৯৬২ সালের দুর্বার ছাত্র আন্দোলন এবং স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবির সমর্থনে দেশব্যাপী গণআন্দোলনের সময় আমি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। সারাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতাÑ ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক ও জনসাধারণ তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাবির সেøাগান নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। আমি বিক্ষোভ-মিছিল ও সভায় যোগ দিয়েছি, গণবিরোধী শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছি। ষাটের দশকের উত্তাল দিনগুলোতে কোন রাজনীতি-সচেতন বাঙালীর পক্ষে রাজনীতির মূলধারা থেকে বিচ্যুত থাকা সম্ভব ছিল না। কাজেই আমিও নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারিনি।’ ’৬০-এর দশকের শেষ দিকে বঙ্গবন্ধু যখন জেলে ছিলেন তখন তিনি ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারে শেখ হাসিনাকে তার গোপন বার্তাবাহিকা হিসেবে ব্যবহার করতেন। শেখ হাসিনা ছাত্র আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৬৬-৬৭ সালে তিনি ইডেন কলেজ (বর্তমানে বদরুন্নেসা মহাবিদ্যালয়) ছাত্রী সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সহ-সভানেত্রী নির্বাচিত হয়ে তার জনপ্রিয়তা প্রমাণ করেন। নিজের কলেজে তিনি ছাত্রলীগ শাখার সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীকালে তিনি ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় শাখার সদস্যা এবং রোকেয়া হল শাখার সেক্রেটারি হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। ১৯৬৯ সালের আইয়ুববিরোধী গণঅভ্যুত্থানে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামকালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তার মা, ভাই, বোন ও স্বামীসহ তাকে কারারুদ্ধ করে। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ভারত সরকার, বিশেষ করে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, বিদেশে অবস্থানরত শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার শারীরিক নিরাপত্তা সম্পর্কে শঙ্কিত বোধ করেন। তারা উভয়ে আততায়ী কর্তৃক নিহত হতে পারেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের জনগণ বঙ্গবন্ধুর ওপর যে আস্থা স্থাপন করেছিল তা অতুলনীয়। তার হৃদয়বিদারক মৃত্যুর পর তারা সে ধরনের আস্থা স্থাপনের উপযুক্ত ব্যক্তির অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু থেকে শেখ হাসিনার সভানেত্রী পদে নির্বাচন পর্যন্ত প্রায় ছ-বছরকাল আওয়ামী লীগ জনগণের পূর্ণ আস্থাভাজন ব্যক্তির সন্ধান দিতে পারেনি। রাজনৈতিক অঙ্গনে শেখ হাসিনার প্রবেশ উপযুক্ত মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিল। বঙ্গবন্ধুর কর্মী ও সমর্থকরা আওয়ামী লীগ পার্টি এবং প্রবীণ ও প্রগতিশীল নবীন নেতৃবৃন্দের কার্যকলাপ লক্ষ্য করছিল। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৭৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর লন্ডনের কনওয়ে হলে বেগম রাজিয়া মতিন চৌধুরীর সভানেত্রীত্বে বঙ্গবন্ধুর অনুসারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী, নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের এক সম্মেলনে সর্বইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠিত হয়। এই উপলক্ষে বাকশাল, আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা আবার এক প্ল্যাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ হন। ১৯৮০ সালের আগস্ট মাসে লন্ডন অবস্থানকালে শেখ হাসিনার সঙ্গে যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী বঙ্গবন্ধুর অনুসারী ও আওয়ামী লীগ কর্মীরা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপন করেন। তাঁকে গণসংবর্ধনা জ্ঞাপন এবং বঙ্গবন্ধুর পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী পালন উপলক্ষে ১৬ আগস্ট পূর্ব লন্ডনের ইয়র্ক হলে বিপুল জনসমাগম হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তি সংগ্রামের পর প্রবাসী বাঙালিদের লন্ডনে এর চেয়ে বড় সমাবেশ আর অনুষ্ঠিত হয়নি। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি এবং স্যার টমাস উইলিয়ামস, কিউ সি, এমপি, প্রধান বক্তা হিসেবে যোগ দেন। তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে আগত তিনজন আওয়ামী লীগ নেতা, ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে ড. কন্রাড্ উড এবং দুজন শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য বক্তৃতা দেন। আরও দুজন শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্যÑ পিটার শোর ও জেমস্ লামন্ডÑ সমাবেশে উপস্থিত থাকতে অসমর্থ হওয়ার লিখিত বাণী পাঠান। স্যার টমাস আরও বলেছিলেন, যাদের হাতে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের রক্তের দাগ রয়েছে তাদের বিচার করতেই হবে। শুধু বিচার করলেই চলবে না, বিচার করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হওয়াও প্রয়োজন। জাতির পিতাকে হত্যার ফলে বাংলাদেশের বহু লোক লজ্জিতবোধ করেন বলে তিনি সুনিশ্চিত। হত্যাকারীদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত এই লজ্জা দূর করা যাবে না। স্যার টমাস জোর দিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর সম্মানহানি নাকচ করার জন্য হত্যাকারীদের উপযুক্ত বিচার হওয়া অবশ্য প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে তিনি ১৯৬৮ সালে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জয়লাভ করে বঙ্গবন্ধুর কালিমালিপ্ত সম্মান পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মধ্যেই বাংলাদেশের অঙ্কুর নিহিত ছিল বলে তিনি মনে করেন। সাংবাদিক সম্মেলনে সন্ ম্যাকব্রাইড, শেখ হাসিনা, মোহাম্মদ সেলিম (প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলীর পুত্র) এবং সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম (প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলামের পুত্র) উপস্থিত ছিলেন। ॥ তিন ॥ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এক রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে। প্রেসিডেন্ট সাত্তারকে সরিয়ে দিয়ে সে সামরিক আইন জারি করে রাজনৈতিক কার্যকলাপ, বিক্ষোভ, সভা-সমিতি ও ধর্মঘট বেআইনি বলে ঘোষণা করে। সভা-সমিতির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সাভারে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস পালন করে। এই উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সভা জেনারেল এরশাদ ও সামরিক আইনবিরোধী সর্বপ্রথম জনসমাবেশে পরিণত হয়। জাতীয় স্মৃতিসৌধের পাদদেশে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন : ‘এই সামরিক শাসন মানি না, মানবো না।’ ১৯৮২ সালের ২৫ মার্চ যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের উদ্যোগে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে বাংলাদেশ থেকে সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবিতে এক বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। বিক্ষোভকারীরা শেখ হাসিনাসহ দলের নেতৃবৃন্দের নিরাপত্তা দাবি করেন। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিও তারা জনান। [সাপ্তাহিক জনমত, লন্ডন, ৪ এপ্রিল ১৯৮২] ১৭ মে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। এদিন তিনি মাতৃভূমিতে ফিরে এসেছিলেন কেবল একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে জীবনযাপনের উদ্দেশে নয়, জাতীয় রাজনীতির হাল ধরতে, সেনাশাসনের কবল থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনতে। দেশের মাটিতে পা রাখার দিন থেকেই শুরু হয় তার নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামী জীবন, সাড়ে তিন দশকের অধিক সময় ধরে যা বিস্তৃত। শেখ হাসিনা রাষ্ট্র, সমাজ, দেশ, বিশ^ সম্পর্কে চিন্তাধারার উত্তরাধিকার আমাদের জন্য প্রতি মুহূর্তে রেখে চলেছেন। শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশে ফিরে না এলে ক্ষমতার মদমত্ততার ও আত্মম্ভরিতার অবসান হতো না। এ কথা মোটেই বাড়িয়ে বলা হবে না, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের নির্মীয়মাণ ইতিহাসে শেখ হাসিনা নিজের জায়গা নিজে করে নিয়েছেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ বলেছিলেন, শেখ হাসিনা যখনই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সিঁড়িতে পা রেখেছিলেন তখনই বুঝে নিয়েছিলেনÑ ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু পথ’। তার পথে পথে পাথর ছড়ানো ছিল। শুধু পাথর নয়; এক পর্যায়ে দেখা গেল ‘পথে পথে গ্রেনেড ছড়ানো’। শেখ হাসিনা জেনে গিয়েছিলেন, চলার পথে অনেক বাঁক থাকে, চোরাস্রোত থাকে, অনির্দিষ্ট আর অলক্ষ অনেক উপাদানে জড়িয়ে থাকে ইতিহাসের অনির্ধারিত গতিপথে। অথচ শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৩৭ বছর অতিক্রমের পর প্রশ্ন থেকে যায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তার যথাযথ মূল্যায়ন কি করেছেন? বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই গানের কথা মনে পড়েÑ ‘শুনে তোমার মুখের বাণী/আসবে ঘিরে বনের প্রাণীÑ/হয়তো তোমার আপন ঘরে/পাষাণ হিয়া গলবে না।’ বিশ^সংসার জয় করে এলেও নিজের দেশের অনেকের পাষাণ হৃদয় গলাতে পারেননি। ওই গানেই বলা আছে, ‘তা বলে ভাবনা করা চলবে না।’ এভাবেই শেখ হাসিনার পথচলা। বাংলাদেশের জন্য শেখ হাসিনা জরুরী ছিলেন, জরুরী থাকবেন। (সমাপ্ত) লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
×