ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ নির্বাচনের রাজনীতি ॥ বাম লজ্জা ও আদর্শহীনতার পরাজয়

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ২০ মে ২০১৮

সিডনির মেলব্যাগ ॥ নির্বাচনের রাজনীতি ॥ বাম লজ্জা ও আদর্শহীনতার পরাজয়

খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের জয় আওয়ামী লীগের কর্মী সমর্থক ও ভালবাসার মানুষজনদের মনে ভরসা জোগাবে। এটা নিশ্চিত যে আবদুল খালেকই জিতবেন। তাঁর জনপ্রিয়তা ও তাঁর আত্মবিশ্বাস দেখে মনে হচ্ছিল তিনি হারবেন না। অন্য দিকে হেরে যাওয়ার ভয় নিয়ে লড়েছেন মন্জু। তাঁর ভয়ের সবটাই অলীক বা কল্পনাপ্রসূত ছিল না। বাংলাদেশের যে কোন নির্বাচনে সরকারী দলের জোর থাকে। তবে সে জোর জবরদস্তিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বিরোধী দলও যে জয়ী হয় সেটা আওয়ামী লীগ দেখিয়েছে একাধিকবার। আবার ছিয়ানব্বই সালের আওয়ামী সরকারের পর বিএনপি জিতেছিল নির্বাচনে। সরকার যদি কেয়ার টেকার সরকারকে বাগে রাখতো সেটা হতে পারতো না। শুধু তা কেন এই সেদিনও বেশ ক’টি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে ভোটে জিতেছিল বিএনপি প্রার্থীরা। তবে তাদের ভাষা পরিবেশ ভেদে ভিন্ন। জিতলে বলেন, দেখলেন তো আমরাই আসলে জনপ্রিয়। হারলে বলেন, সরকারী দলের কারণে তাদের জোর জবরদস্তি আর ভোট চুরির জন্য হেরেছি। এই অভিযোগ আমাদের জীবদ্দশায় শেষ হবে বলে মনে হয় না। ভোটের পর সরকারী দলের আত্মতুষ্টির বাইরে একটি খবর দেখলাম। জানি না কতটা সত্য। তবে এই কারণেই শেখ হাসিনাকে ভালবাসি। এই খবরের ভেতর দিয়ে তিনি ফের তিয়াত্তরের কথা মনে করিয়ে দিলেন। তখন আমরা যৌবনের দোরগোড়ায়। স্বাধীন দেশের প্রথম নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়েছিলেন ঢাকার সূত্রাপুর-কোতোয়ালি থেকে। তাঁর বিরুদ্ধে জয়ী কেউ হতে পারতো না। পারবেও না। কিন্তু চমকে দিয়ে বেশ ভোট পেয়েছিলেন জাসদের মেজর জলিল। সে খবর জানার পর বঙ্গবন্ধু নাকি তাঁর কাছের মানুষদের ধমক দিয়ে বলেছিলেন তিনি কোনভাবেই বুঝতে পারেননি মেজর জলিল এতগুলো ভোট পেতে পারেন। শেখ হাসিনাও নাকি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন মন্জুর লাখের বেশি ভোট প্রাপ্তিতে। এ বিস্ময় প্রকাশ যথাযথ। কারণ, সরকারের এত সাফল্য এত অগ্রযাত্রার পরও বিএনপির এত ভোট পাওয়া চমকপ্রদ। বিএনপি মূলত এখন মাঠে নেই। তাদের অভিযোগ তাদের মাঠে থাকতে দেয়া হয় না। এই লেখা যখন লিখছি তখন তাদের মহাসচিব মির্জা ফখরুল স্বীকার করে নিয়েছেন তাঁদের ব্যর্থতা আন্দোলনের পরও তারা খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে পারেননি। অথচ আমরা দেখেছি মূলত কোন আন্দোলনই করতে পারেনি তারা। তাদের আন্দোলনের নামে আগের জ্বালাও পোড়াও মানুষ মারা মানুষ নেয়নি। সে কারণে এবং প্রশাসনের কঠোরতায় তারা মাঠে বা দেশে অরাজকতা তৈরি করতে পারেনি এবার। হয়তো এটাকেই আন্দোলন বলতে চান মির্জা ফখরুল। তারপরও বিএনপি প্রার্থীর এত ভোট পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর যদি রিঅ্যাকশন থাকে তো অবাক হবো কি কারণে? তবে আমার লেখার মূল বিষয় সেখানে বামদের ভয়ানক পরিণতি। এখন বাম বলে আসলে কিছু আছে কি-না সেটাও একটা বিবেচনার বিষয়। পুরো বিশ্বে বাম বলে যারা আছেন তারা কোণঠাসা। কিন্তু রাজনীতিহীন আমাদের এই ক্যাঙারুর দেশেও তারা আছে। বিশেষত তারুণ্যে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে গেলেই দেখি বাম ছাত্র সংগঠনের পোস্টার। পোস্টার ও ব্যানারবিহীন এই দেশে তারা রঙিন পোস্টারে বা লিফলেটে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখে। যার কারণ তারুণ্যে বাম বা সাম্যের প্রতি মনোযোগ। সে জায়গাটা কি আছে বাংলাদেশে? সিপিবিকেই আমরা ধরে নেই আমাদের মূল বামশক্তি। এই সিপিবিকে দেখলে বুঝতে কষ্ট হয় এরা আমাদের যৌবনের নায়ক মনি সিং বা কমরেড ফরহাদের দল। সেই মনি সিংহ যিনি মৃত্যুর সময়ও বলেছিলেন তিনি সাম্য আর শ্রেণীহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে যাচ্ছেন। এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন মানুষ বাঁচে স্বপ্ন নিয়ে আর কমিউনিস্ট মারা যায় স্বপ্ন বুকে ধারণ করে। অথচ সে দলের প্রার্থী কিনা পেয়েছেন মাত্র পাঁচশ ভোট। এই বাস্তবতার কারণ কি কোনদিন খতিয়ে দেখবে সিপিবি? বাংলাদেশের রাজনীতিতে মৌলবাদের প্রসার মৌলবাদী তৎপরতার বিরুদ্ধে তাদের কি ভূমিকা সে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কতকাল হয় তাদের না আছে কোন শক্ত ভূমিকা না কোন উদ্যোগ। মাঝখানে দু-একবার ঢাকায় লালপতাকা মিছিল করলেই কি আর দল চাঙ্গা হয়? আমি ঠাট্টা করে বলি এই বামেরাই একদিন বাকশাল ভুলে খাল কাটাকে সমর্থন করেছিল। সেই খালে যদি আজ কুমির থাকে তো বাম ব্যাঙকে ভোট দেবে কে? এই সেদিনও ঢাকায় ছাত্র-ছাত্রীদের ভেতর যে ক্রোধ আর কোটা বিরোধিতার নামে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা সে ব্যাপারেও কোন শক্ত ভূমিকা রাখেনি তারা। ছাত্রছাত্রীদের যে বয়স তাতে তাদের সাম্য ও শ্রেণীহীন সমাজের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু বরাবরের মতো দোদুল্যমানতায় থাকা মূল বাম শক্তি সুযোগ মিস করেছে। যারা ভোটার মানে মূলত যারা মধ্যবয়সী ও মধ্যবিত্ত তাদের ভেতর বামভীতি এখন প্রকট। একদিকে ধর্মের নামে বাড়াবাড়ি আরেক দিকে জঙ্গীবাদের উৎপাতে বামেরা কবেই মুছে গেছে। বেরিয়ে আসার কোন চেষ্টা আছে বলেও মনে হয় না। থাকলে তারা সরকারের অযৌক্তিক বিরোধিতা বা বিএনপির পথ ধরে বিরুদ্ধবাদিতার পরিবর্তে সত্যিকার গঠনমূলক পথে যেতো। তাহলে অন্তত মানুষ জানতো তাদের হয়ে কথা বলছে বামেরা। এই যে পাঁচশ ভোট এটা প্রার্থীর জন্য যতটা লজ্জার তার চেয়েও বেশি আদর্শবাদীদের জন্য আত্মঘাতী। মানুষ বিকল্প হিসেবে জামায়াত-বিএনপিকে ভাবছে অনেককাল থেকে। বরং তারা এখন এদের ব্যাপারে সাবধানী। সে সাবধানতার কারণেই খালি জায়গাটা বামশক্তির দখল নেয়া ছিলো যুক্তিযুক্ত। তারা যে পারেনি এবং মারাত্মকভাবে ব্যর্থ সেটাই প্রমাণিত হলো আবার। কোথায় চলেছি আমরা? আওয়ামী লীগের পর কোন শক্তিকে স্বাগত জানাচ্ছে মানুষ? রাজনীতিতে তো একাধিক দল থাকতেই হয়। সে দল কি চিরকাল মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের হাতেই থেকে যাবে? না এরশাদের মতো সেনানায়কের হাতে? যার সকালের কথা আর বিকেলের কথায় কোন মিল নেই। যার ইচ্ছে অনিচ্ছা বা দল সবই ব্যক্তির খুশি। যার না আছে কোন রাজনৈতিক পড়াশোনা না কোন রাজনৈতিক আদর্শ। তাই বামদের কাছে মানুষের চাওয়া থাকাটা অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু তারা বারংবার লেজুড়বৃত্তি আর অস্বাভাবিক বিরোধিতা করতে গিয়ে পথ হারাতে হারাতে আজ ক্লান্ত। তাদের এই ক্লান্তি সমাজের জন্য হয়তো কোন বিষয় না। তবে আমাদের তারুণ্য আর যুবশক্তির জন্য নিরাশার। বাম আদর্শ পুরো দুনিয়ায় এখন আর কাজ করে না। কিন্তু এমনও না যে তারা মুছে গেছে। আমাদের সমাজে নির্বাচনে তাদের এই পরাজয় লজ্জাজনক ভোট পাওয়া প্রমাণ করছে বাম দল বা বামশক্তিকে বামাতি বলাটা কতটা জায়েজ। খুলনার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় দলটিকে ভোট বা নির্বাচনের ব্যাপারে পজেটিভ শক্তি যোগাবে আশা করি। সাথে এটাও চাই নিভু নিভু বাম শক্তির আলো আরও একবার জ্বলুক। প্রকৃত বিরোধী দলের মতো আচরণ করুক তারা। বিএনপি বা জামায়াতের হাত থেকে মুক্তি মিলুক ঝিমিয়ে পড়া রাজনীতির। না হলে আদর্শ বলে যে কিছুই থাকবে না আর। রাজনীতি কি সে সত্য বুঝতে পারেছে? [email protected]
×