ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

গোলাম সারোয়ার

জেরুজালেম, মহাকালের অগ্নিগর্ভ

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ২০ মে ২০১৮

জেরুজালেম, মহাকালের অগ্নিগর্ভ

আবারও রক্তাক্ত হলো জেরুজালেম। এটিই মানব ইতিহাসের স্মরণযোগ্য কালের সেই নগরী যেটি একাধারে অধিবিদ্যার নগরী, সংঘর্ষের ভরকেন্দ্র, তিন ধর্মের পুণ্যভূমি। এটি মুগ্ধতার, ষড়যন্ত্রের, গোঁড়ামির, অন্ধবিশ্বাসের আর ভণ্ডামিরও নগরী। বিশ্ব ইতিহাসের ভারশঙ্কু আধ্যাত্মিকতার এই নগর এবার রক্তাক্ত হলো ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠান সত্তর বছর পর জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থানান্তরের প্রতিবাদে জেগে ওঠা ফিলিস্তিনীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। এই অন্যায় ফিলিস্তিনীরা মেনে নেয়েনি, বিশ্বও মেনে নেয়নি। সেটা দূতাবাস উদ্বোধন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত দেশগুলোর প্রত্যাখ্যানের ভিতর দিয়েই বিশ্ববাসী দেখেছে। আমরা দেখলাম, তেল আবিব ৮৬টি দেশকে আমন্ত্রণ জানালেও মাত্র ৩৩টি দেশ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছে। তার মানে এখনও বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষের বিবেক জাগ্রত, এখনও গায়ের জোরের পৃথিবীতে সত্যের স্বপ্ন মরে যায়নি। মানুষ ভুলে যায়নি, ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাই ছিল একটি জবর দখল। এটি অবৈধ এবং ১৯১৭ সালের ২ নবেম্বরে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থান জেমস বেলফোর ঐ লক্ষ্যে ফিলিস্তিনীদের ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে প্রতিশ্রুতির ঘোষণা দেন, সেটও ছিল অবৈধ। তবুও জেরুজালেমকে উভয় ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র ও পুণ্যভূমি হিসেবে বিবেচনা করে নগরটিকে জাতিসংঘের নিজস্ব ক্ষমতার আওতায় রাখার জাতিসংঘের যে প্রস্তাব ছিল, তা মানলেও এখানে শান্তির আশা ছিল। কিন্তু ইসরাইল এবং তার মিত্ররা যে এটি মানবে না যুক্তরাষ্ট্রের এই অন্যায় পদক্ষেপে তা আবারও সামনে চলে এলো। ইসরায়েল জেরুজালেমকে তাদের চিরন্তন রাজধানী মনে করে। শুধু তাই নয়, জায়নিস্ট ইহুদিরা দাবি করেন তাদের প্রতিশ্রুত পবিত্র ভূমি মিসরের নীলনদ থেকে ইরাকের ফোরাত নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। তার মানে জায়নিস্ট ইহুদিদের আন্দোলন ও মিশন জেরুজালেমেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। তাঁরা সমগ্র ফিলিস্তিন, লেবানন, জর্দান, মিসর, সৌদি আরব, সিরিয়া ও ইরাকসহ এই বিশাল ভূখণ্ড দখল করার স্বপ্ন দেখে। এই স্বপ্নের ভিত্তি হলো তাঁদের ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মীয় পুরাণ উপকথা। গল্পটি হলো আজ থেকে প্রায় তিন হাজার আটশ বছর আগের। সে সময় প্রাচীন মেসোপটেমিয়া থেকে আব্রাহাম নামের এক ব্যক্তি কেনানে চলে আসেন যা বর্তমানে ফিলিস্তিন। আব্রাহাম জিহোবা নামের এক ঈশ্বরের পুজো করতেন। তিনি বিশ্বজগতের মালিক এক ঈশ্বর জিহোবার উপাসনা করলে জিহোবা তাঁকে এবং তাঁর জাতিকে একটি শান্তির দেশ উপহার দিবেন। তাই তিনি তাঁর পরিবার নিয়ে কেনানে চলে আসেন। ইসলামের ইতিহাসে ইনিই হযরত ইব্রাহিম পয়গম্বর। ইব্রাহিমের দু’জন স্ত্রী ছিলেন। প্রথম স্ত্রী সারাহ, যাঁর গর্ভে জন্ম নেন আইজ্যাক, মুসলিমরা যাঁকে বলেন হযরত ইসহাক। দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরার গর্ভে জন্ম নেন হযরত ইসমাইল। ইসমাইলের জন্মের পর নবী ইব্রাহিম বিবি হাজেরা এবং শিশুপুত্র ইসমাইলকে কেনান থেকে ১২২২ কিলোমিটার দূরে মক্কায় রেখে আসেন। ইসমাইলের বংশধরগণ বর্তমানে আরব জাতি। আর ইসহাকের সন্তান জ্যাকব বা ইয়াকুব। জ্যাকবের আরেক নাম ইস্রায়েল এবং তাঁর বারোজন পুত্রের নামে বনী ইস্রায়েলের বারোটি গোষ্ঠীর জন্ম হয়। তার ভিতরে ইয়াহুদার ছেলেমেয়েদের বলা হয় ইহুদি। এই পুরাণিক গল্প মতে তাঁরা যদি নীলনদ থেকে ফোরাত নদী পর্যন্ত এই বিশাল ভূ-খণ্ড দখলের স্বপ্ন দেখে থাকেন তাহলে তো পৃথিবীতে অনন্ত সংঘাত লেগেই থাকবে! বিজ্ঞানীদের ধারণামতে প্রাইমেট বর্গের অন্তর্গত হোমিনিডি গোত্রের মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল আফ্রিকার ইথিওপিয়ায় প্রায় দুই লাখ বছর আগে। এক লাখ পঁচিশ হাজার থেকে ষাট হাজার বছরের ভিতরে সেখান থেকে একটি দল এশিয়া ও ইউরোপে প্রবেশ করে। তার মানে মানুষের উদ্ভবের তুলনায় আব্রাহামের কেনানে আসার সময় যৎসামান্য। তিনি ব্রোঞ্জযুগে ফিলিস্তিনে আসেন। তিনি তাঁর বংশধরদের প্রতিশ্রুত ভূমির একটি গল্প বলতেই পারেন। কিন্তু জেনেসিসের গল্প থেকেই প্রমাণিত যে, আব্রাহাম ঐ বিশাল ভূ-খণ্ডের খরিদসূত্রে মালিক হননি। তিনি যখন সেখান পৌঁছান তখন সেটা বিরান ভূমিও ছিল না। সেটা আবাদী ভূমি ছিল এবং সেখানে আদিবাসীরা ছিল। তাদের সঙ্গে ইস্রায়েলের বংশধরদের বহু সংঘাতের ইতিহাসও আছে। ইহুদী বীর এবং বিশ্বের প্রথম আত্মঘাতী হামলাকারী স্যামসনের ৩০০০ ফিলিস্তিনিকে হত্যার ইতিহাস বিশ্ব আজও মনে রেখেছে। তার মানে ফিলিস্তিনি-ইস্রায়েলীদের এই সংঘাত স্মরণকালের ইতিহাস ধরেই চলছে এবং ফিলিস্তিনীরাই ছিল সেই অঞ্চলের আদিবাসী। কিন্তু কে কোন অঞ্চলের আদিবাসী এটি বলে আধুনিক যুগে কোন জাতির ওপর নিগ্রহ চালানোর সুযোগ নেই। তাহলে তো আধুনিক শ্বেতাঙ্গদেরকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মেক্সিকো, অস্ট্রেলিয়া ইত্যাদি দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। কারণ এগুলোতে মাত্র পাঁচশ বছরের ভিতরেই তাদের পূর্বপুরুষরা প্রবেশ করেছেন। তাই বিশ্বের শান্তির জন্যে ইসরাইলকে এই পৌরাণিক কাহিনীর স্বপ্ন ছাড়তে হবে। আধুনিক পৃথিবীতে এই রোগের স্বপ্নদ্রষ্টা হলেন অস্ট্রিয়ান ইহুদি সাংবাদিক থিওডর হার্জেল। তিনি তাঁর ‘দ্য জিউস স্টেট বা ইহুদি রাষ্ট্র’ নামের যে বইটি লিখেন, তাই হলো মধ্যপ্রাচ্যের গত সত্তর বছরের সংঘাতের জ্বালানির ইন্ধন। আমরা শুধু তাই মনে করি না, আমরা মনে করি বর্তমান বিশ্বের সব সংঘাতেরও মূল কারণ ইহুদিদের এই প্রতিশ্রুত পিতৃভূমির ধারণা। ইসরাইল রাষ্ট্রটি অবৈধভাবে দখল করে কায়েম করার কারণে এবং এই রাষ্ট্রের সীমানা ক্রমে বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা থেকেই পৃথিবীতে সংঘাতে ইন্ধন যোগাচ্ছে ইহুদি থিংক ট্যাঙ্কগুলো। তারা আশির দশকের শেষ পর্যন্ত স্নায়ুযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েতদের শীতলযুদ্ধে ব্যস্ত রেখে ইসরাইল রাষ্ট্রের সীমানা বাড়িয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধের শেষে তাঁরা বিশ্বের সমরবিদদের নতুন ধারণা দেন হান্টিংটনের ‘সভ্যতার সংঘাত’ তত্ত্ব। সেই মোতাবেক বিশ্বের দৃষ্টি ইসলামী সন্ত্রাসের দিকে ব্যস্ত রেখেছে এবং ইসলামসহ কিছু ধর্মকে সন্ত্রাসায়নে ইন্ধনও উস্কে দিয়েছে এবং এই কাজে তারা সফলও হয়েছে। ইসরায়েলকে বুঝতে হবে, গত সত্তর বছর ধরে তারা যে তেজের জীবন যাপন করছেন, তাদের কিং ডেবিড আর সলোমনের সময় বাদ দিলে ইতিহাসে তারা কখনোই তেজের পৃথিবীতে ছড়ি ঘুরাতে পারেননি। সুতরাং ছড়ি ঘোরানো তাদের ইতিহাসের সঙ্গে যায় না। বরং তারাই ছিল ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে নির্যাতিত নিপীড়িত আর উৎপীড়িত জাতি, অবশ্যই একত্ববাদের জন্য আর ধর্মনিষ্ঠার জন্য। খ্রিস্টপূর্ব ৭২২ অব্দে আসিরীয়দের আক্রমণে তারা মরেছিল হাজারে হাজারে আর বাকিরা হয়েছিল গোলাম। ৫৬১ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ব্যাবিলনীয়দের আক্রমণে তারা হয়েছিল লণ্ডভণ্ড আর ৭০০০০ হয়েছিল কৃতদাস। তারপর ৭০ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট টাইটাস তাদের উপর চালিয়েছিল গণহত্যা। তারপর থেকে প্রায় দুই হাজার বছর তারা পৃথিবীর পথে পথে ঘুরতেছিল আর প্রতিটি শতাব্দীতে কোন না কোন জাতি কর্তৃক মার খাচ্ছিল। সর্বশেষ গত শতাব্দীতে মিলিয়ন মিলিয়ন ইহুদীকে হত্যা করেছিল জার্মান জাতি, অবশ্যই অন্যায়ভাবে। হিটলারের নাৎসী বাহিনী জঘন্য হলোকাস্টে প্রায় ষাট লাখ ইহুদিকে হত্যা করেছিল পাইকারি হারে। তাদের এই লাঞ্ছনায় মানুষ হিসেবে আমরা উৎফুল্ল হতে পারি না, পারবও না। আর তাই মানবজাতি সেই গণহত্যার পর তাদের প্রতি করুণা করে আবারও তাদের জন্যে একটি ভূমির দরখাস্ত করেছিল পরাশক্তিগুলোর কাছে। সেই হিসেবেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেলফোরের ওই ঘোষণা মতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিজয়ী যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ মিত্রশক্তিগুলোর কৃপায় তাদের ইসরাইল রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে ফিলিস্তিনে। তার মানে ইতিহাসে তারাই সবচেয়ে অসহায় জাতি। সেই জাতি আজ ডাকাতের ভূমিকায় অবর্তীর্ণ হলে তাদের একত্ববাদের খোদার কেমন লাগার কথা! মানুষ হিসেবে আমাদেরই বা কেমন লাগার কথা! দুর্বলকে করুণা করলে এমন হতে হয় বুঝি! কথা হলো, নেতানিয়াহু ইহুদি ইতিহাসের ডেবিড, সলোমন কিংবা স্যামসন নন, আর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও ইতিহাসের সাইরাস দ্য গ্রেট নন। চূড়ান্ত বিচারে ফিলিস্তিনীরা যুগ যুগ ধরে ভূমি রক্ষায় রক্ত দিতেছেন। এই অনন্ত সংগ্রাম তাঁরা মিসরীয়, ব্যাবিলনীয়, রোমান, মুসলিম, ক্রুসেডার, অটোমান, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোসহ হালের দখলদার ইসরাইলের বিরুদ্ধে স্মরণকালের ইতিহাস ধরে করেই যাচ্ছে। আর তাই পৃথিবী থেকে তাসমানিয়ার আদিবাসীরা, নিউজিল্যান্ডের মাওরিরা, আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানরা, অস্ট্রেলিয়ার অ্যাবরিজিনরা, দক্ষিণ আফ্রিকার হোরোরা বিলীন হয়ে গেলেও ফিলিস্তিনীরা আজও মুছে যায়নি। তারা আজও টিকে আছেন। ১৪ মে’র আন্দোলনেও তারা প্রাণ দিলেন ৫৮ জন। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে আরও ২ হাজার ৭০০ জন। কিন্তু তারা জীবন দিতে গিয়েছিল ৪০ হাজার। এই আন্দোলনে এক ফিলিস্তিনী প্রতিরোধ যোদ্ধাকে দেখলাম দুই পা নেই। হুইল চেয়ারে করে বজ্রমুষ্টি ধরে আন্দোলনে এসেছেন। ২৯ বছর বয়সী ফাদি আবু সালাহ ২০০৮ সালে ইসরাইলী বিমান হামলার প্রতিরোধে আন্দোলনে নেমে দুই পা হারিয়েছিল। আর এবার জাতিকে দিয়ে গেছেন প্রাণটাই। এই জাতিকে রোখার শক্তি পৃথিবীর কারোরই থাকার কথা নয়! ফিলিস্তিনীদের এ লড়াই সম্মিলিত জোটবদ্ধ রাষ্ট্রপুঞ্জের বিরুদ্ধে সর্বহারার লড়াই। আধুনিক বিশ্বেও সত্তর বছর টিকে থেকে তাঁরা প্রমাণ করেছে সর্বহারার শক্তি অনন্ত এবং অনিবার্য। এই লড়াইয়ে ট্যাঙ্কের প্রতিরোধে পাথর হাতে আর কামানের প্রতিকূলে মানবদেহের দান ধরে ফিলিস্তিনীরা দলিল দিয়ে যাচ্ছে, মানুষের প্রতিরোধের কাছে পৃথিবীর কোন অস্ত্রই টিকবে না। বিশ্বের শান্তির জন্যে আধুনিক বিশ্বের সব বিবেকবান মানুষের, সব মানবিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব আছে ইসরাইল-ফিলিস্তিনের এই অনন্ত সংঘাত বন্ধ করে তাদের সহাবস্থান নিশ্চিত করার। লেখক : গবেষক
×