ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১

প্রকাশিত: ০৭:৩৯, ২০ মে ২০১৮

স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১

মানুষের মহাকাশ অভিযানের অগ্রগতিকে প্রায় কয়েক যুগ এগিয়ে দিয়েছে ফ্যালকন-৯ নামের রকেট। বেসরকারী মহাকাশ গবেষণা ও স্পেস ট্রান্সপোর্টেশন কোম্পানি স্পেসএক্সের এই রকেটটিতে করেই গত ১১ মে শুক্রবার দিবাগত রাতে মহাকাশে পৌঁছায় আমাদের স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য নিজস্ব স্যাটেলাইট পাওয়ার গৌরব অর্জনে এই ফ্যালকন-৯ রকেটের রয়েছে বিশেষ ভূমিকা। শুধু বাংলাদেশ নয়, এই রকেটটির কল্যাণে মহাকাশ চলে এসেছে গোটা মানব জাতির হাতের মুঠোয়। সময়টা ২০০৮ সালে বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি কৃত্রিম উপগ্রহ নির্মাণ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করে। এরপর ২০০৯ সালে জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালায় রাষ্ট্রীয় কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের বিষয়টি যুক্ত করা হয়। বাংলাদেশের নিজস্ব কৃত্রিম উপগ্রহ উৎক্ষেপণের জন্য আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিটের (আইটিইউ) কাছে ইলেক্ট্রনিক আবেদন করে বাংলাদেশ। কৃত্রিম উপগ্রহ ব্যবস্থার নকশা তৈরির জন্য ২০১২ সালের মার্চে প্রকল্পের মূল পরামর্শক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘স্পেস পার্টনারশিপ ইন্টারন্যাশনাল’ কে নিয়োগ দেওয়া হয়। উপগ্রহ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে সম্প্রচার ও টেলিযোগাযোগ সেবা পরিচালনায় ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে একনেক সভায় দুই হাজার ৯৬৮ কোটি টাকার ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ’ প্রকল্প অনুমোদন পায়। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয় এক হাজার ৩১৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা, যা মোট ব্যয়ের প্রায় ৪৪ শতাংশ। এ ছাড়া ‘বিডার্স ফাইন্যান্সিং’ এর মাধ্যমে এ প্রকল্পের জন্য এক হাজার ৬৫২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এই প্রেক্ষিতে হংকং সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশনের (এইচএসবিসি) সঙ্গে প্রায় একহাজার ৪০০ কোটি টাকার ঋণচুক্তি হয় ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে। এক দশমিক ৫১ শতাংশ হার সুদসহ ১২ বছরে ২০ কিস্তিতে ওই অর্থ পরিশোধ করতে হবে। পৃথিবীর কক্ষপথে একটি স্যাটেলাইট বসাতে প্রয়োজন হয় সুনির্দিষ্ট অরবিটাল সøট। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে রাশিয়ার সংস্থা ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে এই অরবিটাল সøট ইজারা নিতে অনুমোদন দেওয়া হয় ২১৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর মাঝে স্যাটেলাইটের সার্বিক ব্যবস্থাপনার জন্য ‘বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড’ নামে একটি সংস্থা গঠন করা হয়। এই সংস্থা গঠনে মূলধন হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশ মহাকাশে খুলে দেয়া বিপুল সম্ভাবনার অংশীদার হয়ে উঠল। এই স্যাটেলাইট তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) এবং সম্প্রচার শিল্পের পাশাপাশি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশের এই প্রথম যোগাযোগ উপগ্রহ এখনো যেসব দুর্গম এলাকায় ইন্টারনেট ও টেলিকমিউনিকেশন সুবিধার আওতায় আসেনি সেইসব এলাকায় এই সুবিধা সম্প্রসারণে সহায়ক হবে। মহাকাশের ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমায় অবস্থান করে উপগ্রহটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আবহাওয়া পূর্বাভাস এবং পর্যবেক্ষণে দেশের সক্ষমতা সম্প্রসারিত করবে। উপগ্রহটি থেকে সার্ক দেশগুলোর পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মিয়ানমার, তাজাকিস্তান, কিরঘিজিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কিস্তান এবং কাজাকিস্তানের একটি অংশ সুযোগ নিতে পারবে। বাংলাদেশে অপ্রত্যাশিত কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বর্তমান টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা যদি কখনও ভেঙ্গে পড়ে তখন গোটা দেশব্যাপী এই যোগাযোগ ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্নভাবে সচল রাখা নিশ্চিত করতে স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। শুধু তাই নয়, স্যাটেলাইট ট্রান্সপন্ডার বিক্রির মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবে। বর্তমানে এই অন্যান্য স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এই সেবা পেতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। বিশেষ করে সম্প্রচার শিল্পের জন্য এসব স্যাটেলাইটের সহায়তা নিতে হয়। এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃত্রিম উপগ্রহের অধিকারী বিশ্বের ৫৭তম দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের ৩০টির বেশি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল সিঙ্গাপুর ও অন্যান্য দেশের স্যাটেলাইট ভাড়ায় ব্যবহার করছে। এতে বছরে ব্যয় হয় প্রায় ১৪ মিলিয়ন ডলার। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করবে এবং আশা করা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এর বাণিজ্যিক ব্যবহারে প্রধান ভোক্তা হবে। নতুন গঠিত বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিসিএল) ইতোমধ্যেই ট্রান্সপন্ডার ভাড়ার জন্য ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিন্সের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের অপর একটি পণ্য উল্লেখ করে বিটিআরসি বলেছে, ৪০টি ট্রান্সপন্ডারে মোট ১ হাজার ৬০০ এমএইচজেড ফ্রিকুয়েন্সি রয়েছে। বঙ্গবন্ধু-১ এর ফলে ডাইরেক্ট-টু-হোম (ডিটিএইচ) ভিডিও সার্ভিস, ই-লার্নিং, টেলি-মেডিসিন, পরিবার পরিকল্পনা, কৃষি খাতসহ দুর্যোগ উদ্ধারে ভয়েস সার্ভিসের জন্য সেলুলার নেটোয়ার্কের কার্যক্রম এবং এসসিএডিএ, এওএইচও এর ডাটা সার্ভিসের পাশাপাশি বিজনেস-টু-বিজনেস (ভিসেট) পরিচালনায় আরও সহজতর করবে।
×