ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

একনায়কতন্ত্রীদের যুগ!

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ২১ মে ২০১৮

একনায়কতন্ত্রীদের যুগ!

পৃথিবীর দেশে দেশে এখন লৌহমানবদের শাসন চোখে পড়ছে। চীনে শি জিনপিং, রাশিয়ায় ভøাদিমির পুতিন, আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প, তুরস্কে এরদোগান, ফিলিপিন্সে রডরিগো দুতার্তে, হাঙ্গেরীকে ভিক্টর ওবরান থেকে শুরু অনেক দেশেই এই লৌহমানবদের দোর্দ- প্রতাপ দেখতে পাওয়া যাবে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে আমেরিকানরা উদারপন্থীদের বাদ দিয়ে ট্রাম্পকে বেছে নেয়। এই প্রবণতা শুধু আমেরিকায় সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বের সর্বত্রই পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষ অধিকতর গলাবাজ ও নিজেকে জাহির করা লোকদের নেতৃত্ব পছন্দ করছে। দুর্নীতিবাজ এলিট, মুমূর্ষু গরিব, বিদেশী, বর্ণগত, জাতিগত বা ধর্মীয় সংখ্যালঘু, রাজদ্রোহী রাজনীতিক, আমলা, ব্যাংকার বা বিচারপতি কিংবা মিথ্যাচারী রিপোর্টার- এদের মধ্য থেকে লৌহমানবদের আবির্ভাব ঘটছে। আজ আমরা লৌহ যুগে রয়েছি। এদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে শক্ত মানবটি হলেন রাশিয়ার পুতিন। সোভিয়েতের পতনের পর যখন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অযোগ্যতা-অকর্মণ্যতা গ্রাস করে নিয়েছিল সে মুহূর্তে ভøাদিমির পুতিন আবির্ভূত হন। তিনি সেই রাশিয়ার পুনর্প্রতিষ্ঠার আহ্বানে সাড়া দেন যে, রাশিয়া তিন শতাব্দী ধরে একটি সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। ৬৫ বছর বয়স্ক পুতিন রাশিয়ার পৌরুষ, শক্তিমত্তা, দম্ভের মূর্তরূপ। শক্তমানবদের এশিয়াজুড়ে দেখতে পাওয়া যাবে। চীনে ২০১২ সাল থেকে ক্ষমতায় বসেছেন শি জিনপিং। দুর্নীতি দমন অভিযানকে কাজে লাগিয়ে তিনি সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের পাশে সরিয়ে রেখেছেন এবং ঐতিহাসিক পরিসরে নিজের ক্ষমতা সুসংহত করেছেন। তিনি চীনের এক নতুন যুগের অভ্যুদয় ঘোষণা করেছেন। সেটা হলো সম্প্রসারণের এমন এক স্বর্ণযুগ যা চীনকে বিশ্বমঞ্চের মধ্যমণিতে পরিণত করবে। সম্প্রতি তিনি প্রেসিডেন্টের মেয়াদ উঠিয়ে দিয়ে আপাতত সর্বসম্মত দলীয় শাসনের অবসান ঘটিয়েছেন। কাজেই চীনের ক্ষমতা এখন কার হাতে সে ব্যাপারে কারোর কোন সন্দেহ নেই। ফিলিপিন্সে পথেঘাটে সহিংস অপরাধের দৌরাত্ম্য এমন হয়ে গিয়েছিল, মাদকের থাবা এমন হিংস্র হয়ে উঠেছিল যে, সেগুলো নির্মমভাবে দমনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন সাবেক মেয়র রডরিগো দুতার্তে। তার কথাবার্তা রূঢ়, তিনি তার নিজস্ব ব্র্যান্ডের বিচার পদ্ধতির দ্বারা এসব সমস্যার মোকাবেলা করে চলেছেন। থাইল্যান্ডে চরম রাজনৈতিক স্থবিরতার মধ্যে ২০১৪ সালে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে। জনগণের দিক থেকে তেমন কোন প্রতিরোধ আসেনি। নতুন নির্বাচনের বারংবার প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও জেনারেল প্রাইয়ুথ চান ওচা এখনও ক্ষমতায়। লাতিন আমেরিকার নিকারাগুয়ায় প্রেসিডেন্ট জেনারেল ড্যানিয়েল ওর্টেপা বিরুদ্ধবাদীদের কণ্ঠরোধ করে রেখেছেন এবং প্রেসিডেন্টের মেয়াদ বাতিল করেছেন। অর্থনৈতিক সঙ্কটকবলিত ভেনিজুয়েলায় প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো বিরোধী নেতাদের কারাগারে নিক্ষেপ করে প্রতিবাদের সম্ভাবনা নির্মমভাবে দমন করেছেন। অপরাধ ও দুর্নীতির দৌরাত্ম্যে ক্লান্ত বিপর্যস্ত ব্রাজিলের প্রায় ৪৫ শতাংশ মানুষ দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের সমর্থক বলে এক জরিপে দেখা গেছে। মিসরে লৌহমানবের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছেন জেনারেল আবদুল ফাতাহ আল সিসি। ২০১৩ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট মোরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করেন তার সমর্থনে রাজপথের বিক্ষোভকে নির্মমভাবে দমন করেন এবং পরের বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। গত বসন্তে তিনি বিপুল ভোটে আবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সৌদি আরবে এখন কার্যত সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। এলিটদের ঐকমত্যের শাসনের পরিবর্তে তিনি নতুন ধরনের একক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কায়েম করেছেন। তার নির্দেশে গত বছরের শেষদিকে কমপক্ষে ১৭ জন সৌদি শাহজাদা ও বেশ কয়েকজন অতি ধনাঢ্য ব্যক্তি কারাবন্দী হন। তুরস্কে রিসেপ তায়েপ এরদোগান ও তার দল ২০০৩ সাল থেকে ক্ষমতায়। তারা সেক্যুলার এলিট শ্রেণীর আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে রক্ষণশীল তুর্কীদের মধ্যে প্রবল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এরদোগান সবকিছুকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করছেন। বিরোধী দল ও বিপুলসংখ্যক সাংবাদিককে জেলে দেয়া তার আমলে যত হয়েছে তার আগে আর কখনও হয়নি। লৌহমানবের আবির্ভাব ইউরোপেও ঘটেছে। হাঙ্গেরীর প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান আরেক দফা নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। তবে তার গণতন্ত্র অভিনব রকমের অনুদার। সেখানে নির্বাচন অবাধ; কিন্তু নাগরিক অধিকারের অস্তিত্ব নামমাত্র। ওরবান মনে করেন মুসলিম অভিবাসী ও পাশ্চাত্যের উদার গণতন্ত্রের প্রবক্তারাই দেশের প্রতি হুমকি। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর থেকে মনে হয়েছিল উদার মূল্যবোধের যুগের সূচনা হয়েছে, যেখানে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মুক্তবাজার চিরস্থায়ী রূপ নেবে। অথচ বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার দিকে তাকালে তা মনে করার কারণ নেই। ইউরোপের দেশে দেশে এখন উগ্র ও ফ্যাসিবাদীরা মাথাচাড়া দিচ্ছে। যেমন ধরুন জার্মানি এঞ্জেলা মের্কেলের ১০ বছরের শাসন সর্বনিম্ন চরম দক্ষিণপন্থী দল অলটারনেটিভ ফর জার্মানি এখন তার দুর্বল কোয়ালিশনের প্রধান প্রতিপক্ষ। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ স্বদেশে ছাত্র ও সরকারী খাতের শ্রমিকদের ক্রুদ্ধ বিক্ষোভের সম্মুখীন এবং তার জনসমর্থন কমছে। জাপানের কেলেঙ্কারি জর্জরিত প্রধানমন্ত্রী শিনজো এ্যাবে তো আরও বেশি অজনপ্রিয়। অন্যদিকে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে তার রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য লড়ে চলেছেন। নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের জন্য এই নেতাদের যেমন নানা ধরনের সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়, অনেক ক্ষেত্রে দেনদরবার করতেও ছাড় দিতে হয়, লৌহমানবদের সেই সমস্যা নেই। তারাই সাধারণত চাপ সৃষ্টি করেন এবং তাদের সৃষ্ট ব্যবস্থাই এমন যে, তারা রাজনৈতিক খেলার নিয়মকানুনগুলো প্রয়োজনমতো বদলে দিয়ে নিজেদের রক্ষা করার সুযোগ পান। এক্ষেত্রে প্রযুক্তির অগ্রগতি তাদের কাজটাকে যতটা সহজ করে দিয়েছে অন্য আর কিছু দেয়নি। এক দশক আগে মনে হয়েছিল যে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে বিপ্লব রাষ্ট্রের চাইতে বরং জনগণের অধিকতর ক্ষমতায়ন ঘটাবে। সামাজিক নেটওয়ার্কগুলো ‘জনশক্তি’ সৃষ্টি করবে- যেমন আরব বসন্তের মতো গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হবে। কিন্তু বিশ্বের স্বৈরাচারীরা তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে প্রধান কুশীলবে পরিণত হয়েছেন। রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কঠোর থেকে কঠোরতর করার জন্য রাষ্ট্র এখন ইন্টারনেটের তথ্য-উপাত্তকে কাজে লাগাচ্ছে। এই উদ্যোগ অনেক দেশেই সফল প্রমাণিত হয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আল খামেনির দৃঢ় নিয়ন্ত্রণে আছে পরিস্থিতি। তার সরকার অনেক আগে থেকেই ‘হালাল’ ইন্টারনেট সৃষ্টি করতে চেয়েছিল, যেখানে কর্তৃপক্ষ বিষয়বস্তু ও প্রত্যেক ব্যবহারকারীর পরিচিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। এটা হবে এমন এক নেট যা কর্র্তৃপক্ষ চাইলে বিশ্বব্যাপী ওয়েব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া যাবে। ২০১৬ সালে ইরানে জাতীয় তথ্য নেটওয়ার্ক চালু হয়। এ সময় বেশ কিছু সংবাদ এজেন্সি ও সংবাদ সাইট বন্ধ করে দেয়া হয় এবং কমপক্ষে এক শ’ ইন্টারনেট ব্যবহাকারীকে গ্রেফতার করা হয়। রাশিয়ায় কর্তৃপক্ষের কাছে বিতর্কিত বলে বিবেচিত ওয়েবপেজ ও কনটেন্ট নিষিদ্ধ করে নাগরিকদের অন্ধকারে রাখা হয়। গত বছরের মার্চে দেশব্যাপী সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হলে এই নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার জন্যই দেশবাসীর অনেকে তা জানতে পারেনি। রাষ্ট্রের অনুমোদন পাওয়া সাইটগুলোর কাছ থেকেই তারা যতটুকু জানবার জানতে পেরেছে। চীনের নেতারাও ‘গেট ফায়ারওয়াল’ দিয়ে সাইবার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছে। এই ফায়ারওয়াল দিয়ে হাজার হাজার ওয়েবসাইটে প্রবেশ আটকে দেয়া হয়। এর দ্বারা রাজনৈতিক স্পর্শকাতর বিষয় দেখার সুযোগ দেয়া হয় না। এমনকি কনটেন্ট বদলেও দেয়া যেতে পারে। যাই হোক, এটা আর অস্বীকার করার উপায় নেই যে, অশান্তি ও অস্থিরতা, সন্ত্রাস, যুদ্ধ নতুন প্রযুক্তির এই যুগে বিশ্বের দেশে দেশে লৌহমানব ও স্বৈরাচারের আবির্ভাব ঘটছে। এর পেছনে অনেক কারণই আছে। লৌহমানবদের অধিকাংশ এই ভানটুকু বর্জন করেছেন যে, জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী তারা দেশ শাসন করছেন। হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডের মতো দেশগুলোতেও স্বৈরাচারের পুনরাবির্ভাব ঘটছে, যে দেশগুলো মাত্র ২৫ বছর আগে সোভিয়েতের দমন-নিপীড়নের শৃঙ্খল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল। দেশে দেশে লৌহমানব ও স্বৈরাচারের উত্থানের এই প্রবণতা এক বৈশ্বিক বৈশিষ্ট্য হয়ে দেখা দিয়েছে। এতে সমৃদ্ধি ও সাক্ষ্যের সুনিশ্চিত পথ হিসেবে উদার গণতন্ত্র এবং বাজার অর্থনীতির ওপর মানুষের এতদিনের দৃঢ় বিশ্বাস নস্যাত হয়ে যাচ্ছে। ট্রাম্প, পুতিন, শি, এরদোগান, দুতের্তে, সিসি যা এখন করছেন ত্রিশ বছর আগে তা করলে আন্তর্জাতিক পরিসরে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হতো ‘আপনারা পথ থেকে সরে যাচ্ছেন’Ñ ইত্যাদি ইত্যাদি। আজ এ নিয়ে কেউ কিছু বলে না। লৌহমানব বা স্বৈরাচারী নেতারা এখন বৃহত্তর দায়মুক্তি নিয়ে কাজ করতে পারছেন। তাদের অন্তত আন্তর্জাতিক পরিসরে একঘরে হয়ে পড়া নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হচ্ছে না। স্বৈরাচারের এই প্রবণতা প্রতিটি দেশের নিজস্ব ইতিহাসের সঙ্গে সুনির্দিষ্টভাবে গ্রথিত। এর শিকড় রয়েছে আজকের বিশ্বের নিরাপত্তাহীনতা ও আশঙ্কার বিভিন্ন কারণের মধ্যে। সেই কারণগুলো হলো বিশ্বায়ন ও ক্রমবর্ধমান অসাম্য, প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি, সিরিয়ার মতো গৃহযুদ্ধের চরম সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলা-বিভ্রান্তি-গোলযোগ ইত্যাদি। পশ্চিমী উদারতাবাদের মতো মৌলিক মূল্যবোধের ধারক স্নায়ুযুদ্ধের প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আর এই পরিস্থিতিকে সামাল দিতে পারছে না। কারণ যে দেশগুলো অন্যদের কাছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আলোকবর্তিকা ছিল তারা নিজেরাই সেই একই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুর্বলতা ও অভ্যন্তরীণ সংঘাতের শিকার। সূত্র : টাইম
×