ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নিরঞ্জন মণ্ডল

একুশে মে ১৯৭১ বধ্যভূমি ডাকরা

প্রকাশিত: ০৩:৪০, ২১ মে ২০১৮

একুশে মে ১৯৭১ বধ্যভূমি ডাকরা

মা, মাটি ও মানুষ নিয়ে বাঙালী জাতির অমর অভিযাত্রার নাম একাত্তর। একাত্তর মানে মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ মানে আত্মত্যাগ। মুক্তিযুদ্ধ মানে রক্ত লাশ-করোটি কঙ্কাল। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালী জাতির চেতনার অংশ। দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধে, এদেশের বিভিন্ন এলাকায় বাঙালী জনগোষ্ঠীর ওপর চলে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। তাতে অংশ নেয় পাকহানাদার বাহিনীর সঙ্গে তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী। সেই হত্যাযজ্ঞ সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক ঘটনা। আমিও সেই কলঙ্কময় একটি সংখ্যালঘু নিধনযজ্ঞের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে শরীরে ক্ষত নিয়ে এখনও বেঁচে আছি। সেদিনও ঘটনাস্থল বধ্যভূমি ডাকরার মাটিতে আমার শরীর থেকে রক্ত ঝরেছিল। সেই অভিজ্ঞতার কথা আজকে বলব। আজকে যে শিহরণময় অভিজ্ঞতার কথা বলছি, একাত্তরে তা ছিল কল্পনাতীত। আমার ব্যক্তি মানসপট থেকে সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনও মুছে যায়নি। বরং ৪৭ বছর ধরে দগদগে ক্ষতের মতো জ্বল জ্বল করছে আমার বুকের ভেতর। ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ, এই ১৮ দিন সারাদেশ উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটতে থাকে। ২৫ মার্চ পাকিস্তানী বাহিনী ঢাকাসহ সারাদেশে গণহত্যা শুরু করে। পাকবাহিনীর এ দেশীয় দোসররা শুরু করে বর্বরতা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ। এমন কোন জঘন্য অপরাধ ছিল না- যা তারা সেদিন করেনি। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নেমে আসে চরম নির্যাতন। নিজ জন্মভূমিতে সতত বিপন্ন হয়ে পড়ে তাদের জীবন। সাত পুরুষের বাস্তুভিটে ফেলে ছিন্নমূল শেওলার মতো ঘাটে ঘাটে ভেসে বেড়ায় তারা। একে একে গবাদিপশু হয় নিরুদ্দেশ। খড়ের গাদা হয় ভস্মীভূত। ধান চাল টাকা পয়সা চলে যায় লোভী লুটেরার দখলে। হাতছাড়া হয় কাঁসা-পিতল। খাট-পালঙ্ক পৌঁছে যায় দুর্বৃত্তের ঘরে। ঘর বাড়ি হয় উধাও। শূন্য হয় ভিটেমাটি। পথে পথে পরিবার পরিজন। সম্ভ্রম বাঁচাতে বউ-ঝিরা অন্তরালে। এসব স্মৃতিমালা আজ চার যুগ পরেও আবার সবার সামনে তুলে আনছি এই কারণে যে, বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধটা যাতে কেবল একাত্তরের গ-গোল না হয়ে থাকে। আমাদের সন্তান-সন্ততিদের স্মরণ করিয়ে দেয়া যেন বিস্মরণের অন্ধকারে হারিয়ে না যায় আমাদের সেই কষ্টের-বেদনার-সংগ্রামের দিনগুলো স্মৃতি। সাম্প্রদায়িকতার বলী সেই মানুষগুলোর আর্তনাদ-হাহাকার আর যেন পুনর্বার ধ্বনিত না হয় বাংলার মাটিতে। আমার বিশ্বাস মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যক্তি জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা কেবল ব্যক্তিগত স্মৃতি নয়- তা হয়ে উঠতে পারে ইতিহাসের অংশ। ডাকরা গ্রামটি বাগেরহাট জেলা শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে, মংলা বন্দর থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তরে কুমারখালী নদীর তীরে। কুমারখালী পশুর নদীর একটি শাখা বিশেষ। নদীর দক্ষিণ পারে ডাকরা গ্রাম, ডাকরা বাজার। উত্তর পারে কালীগঞ্জ বাজার, বাঁশতলী গ্রাম। উপজেলা- রামপাল। ডাকরা বাজারের অনতিদূরে বহু পুরনো একটা কালীমন্দির রয়েছে। সেই মন্দিরকে ঘিরে বহু সংখ্যালঘু পরিবারের বাস। স্থানীয় ব্রাহ্মণ পরিবারগুলো মন্দিরের সেবায়েত। ব্রাহ্মণ পরিবারে বিনোদ বিহারী চক্রবর্তী (ন’ঠাকুর) নামে একজন কালীভক্ত সাক্ত সাধু ছিলেন। তাঁর বহু শিষ্য ছিল এতদঞ্চলে। তাঁর শিষ্যরা, আত্মীয়স্বজন এবং নিরাশ্রয় সংখ্যালঘু পরিবারগুলো আশ্রয় নেয় মন্দির প্রাঙ্গণে। উদ্দেশ্য একত্রিত হয়ে প্রতিবেশী দেশে নিরাপদ আশ্রয় প্রার্থনা। বিপন্ন মানুষের মিলন মেলা তখন ডাকরা কালীমন্দির। খবর পেয়েছিলাম আমাদের অগ্রবর্তী দল ইতিমধ্যে চুকনগর পৌঁছে গেছে। তাঁরা ন’ঠাকুরের নেতৃত্বে আমাদের বহর পৌঁছবার অপেক্ষায় আছে। কথা ছিল, ওখান থেকে ৩০ মে তারিখে আমরা একত্রিত হয়ে বশিরহাট সীমান্ত পেরিয়ে পশ্চিম বাংলা ঢুকব। চুকনগর থেকে সীমান্তের দূরত্ব মাত্র ২৩ কিলোমিটার। ২১ মে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত অসংখ্য নৌকার বহর এসে থামে ডাকরা কালীমন্দিরের কাছে। নৌকা ভর্তি পরিবার পরিজন সঙ্গে পোঁটলা-পুঁটলি। ভাটার অপেক্ষায় উদগ্রীব দুই সহস্রাধিক পরিবার। দিনটি ছিল ২১ মে, ১৯৭১, বাংলা ১৩৭৮, ৬ জ্যৈষ্ঠ, শুক্রবার দুপুর বেলা। কালীমন্দির প্রাঙ্গণে জমায়েত হওয়া সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে রাজাকারদের কাছে আগাম তথ্য চলে গিয়েছিল স্থানীয় পিস কমিটির সদস্যদের মাধ্যমে। এই তথ্যের কারণে রাজাকার কমান্ডার রজ্জব আলী ফকির সুপরিকল্পিতভাবে গণহত্যা চালাতে সমর্থ হয়। পার্শ্ববর্তী এলাকার সমস্ত পরিবার এখানে মিলিত হওয়ার ফলে প্রতিটি পরিবার থেকে কেউ না কেউ সেদিন হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছিল। সেদিনকার বাস্তব অবস্থাটা এ রকম ছিল- গুলির শব্দে সহসা সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। ঝাঁকে ঝাঁকে রাইফেল এবং শট্গানের গুলি এসে গাছপালার শরীরে আঘাত হানায়-চড়াৎ চড়াৎ শব্দে সবাই ছোটাছুটি শুরু করে। দুপুরের নিস্তব্ধতাবিদীর্ণ করে ধ্বনি ওঠে ‘নারায় তকবির আল্লাহ আকবর।’ একবার নয়, বার বার। শুরু হয় সমবেত আর্ত মানুষের অসহায় ক্রন্দন ধ্বনি। বাঁচাও বাঁচাও বলে কাতর-মিনতি। রাজাকার বাহিনী এমনভাবে আক্রমণ শুরু করে যাতে কেউ পালাতে না পারে। রাজাকাররা পুরনো বাজার থেকে নিধনযজ্ঞ শুরু করে ক্রমশ পূর্ব দিকে মন্দিরাভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে। তারা পুরুষ এবং নারীদের আলাদা করে ফেলে। পুরুষদের ছোট ছোট লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি ছোড়ে। মহিলাদের কাছ থেকে স্বর্ণালঙ্কার, টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নিতে শারীরিকভাবে নিগ্রহ শুরু করে। যেসব পুরুষ গুলি খেয়ে আহত হয়ে ছটফট করছিল, হয় তাঁদের পুনরায় গুলি করা হয়, নতুবা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। আহত কিছু মানুষ পানি খেতে চেয়ে ছটফট করে। নদীতে নোঙর করা নৌকা লক্ষ্য করেও গুলি ছোড়ে রাজাকার বাহিনী। নৌকার ‘ছৈয়ের ভেতর থেকে মরা মানুষের হাত-পা ঝুলে থাকতে দেখি। পুরো ডাকরা গ্রাম-বাজার-মন্দির প্রাঙ্গণে মুহূর্তে ভরে যায় লাশের স্তূপে। সমগ্র এলাকাটি সেদিন পরিণত হয় এক মৃত্যুপুরীতে। নির্জন গোধূলিতে নেমে আসে শ্মশানের অন্ধকার। ঘটনাস্থলে আমি তখন দিশাহীন-ভীতসন্ত্রস্ত। আশ্রয় নিলাম এক গৃহস্থের পাগারের ঝোপে। মাথার ওপর একটা ঝাঁকড়া শেওড়াগাছ। নিচে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলাম রাজাকার বাহিনীর দানবীয় নিষ্ঠুরতা। বীভৎস হত্যাদৃশ্য দেখতে দেখতে আমার হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল। ভাবছিলাম, এর পরবর্তী পালা আমার। পালাবার সুযোগ আগেই নষ্ট করে ফেলেছি। মৃত্যুরূপী যমদূতরা যে কোন মুহূর্তে আমার সামনে এসে দাঁড়াতে পারে। অসহায় আমি ঝোঁপের আড়ালে মৃত্যুর অপেক্ষা করতে থাকি। কখন যে পেছন থেকে আমার এক স্কুলশিক্ষক দাদা আমার কাছে আশ্রয় নিয়েছে টের পাইনি। হঠাৎ তাকে দেখে আঁতকে উঠি। ‘নারায় তকবির-আল্লাহ আকবর’ মুহুর্মুহু স্লোগানে আমি আতঙ্কিত। জানি না মৃত্যু ঠিক কী রকম? যে কোন মুহূর্তে দেখা হয়ে যেতে পারে তার সঙ্গে। খুব কষ্ট হবে কী? কী করে মারবে আমাকে? গুলি করে, কুপিয়ে, নাকি বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়েই? মাথা তুলতেই দেখি, বকুলতলা নিবাসী রণজিত মহলীকে রামদা দিয়ে সপাটে এক কোপ মারে একজন ঘাতক। কোপটি লাগে তাঁর নাকের মাঝ বরাবর। নাক কেটে ছিটকে গিয়ে দাঁতগুলো বেরিয়ে এক বীভৎস দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছড়িয়ে পড়ে মাটিতে। ছটফট করতে করতে নিস্তেজ হয়ে যায় তাঁর দেহ। দেখলাম, বেতকাটা নিবাসী খগেন্দ্রনাথ ম-লকে উপড় করে শোয়ায়ে পিঠে গুলি করতে। পানি খেতে চেয়ে ছটফট করে। যন্ত্রণায় এক সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। পরের শিকার ডাকরা গ্রামের দয়াল চন্দ্র ম-ল। তার তলপেটে গুলি করে। গুলিতে তার অ-কোষ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এভাবে মৃত্যুর মিছিল চলতে থাকায় আমার অনুভূতি একসময় ভোঁতা হয়ে যায়। মৃত্যুর বীভৎসতা দেখতে দেখতে কখন যে মৃত্যুরূপী ঘাতক আমাদের সামনে চলে আসে টের পাই না। ঝোপের ভেতর থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে আদেশ দেয়। কাঁপতে কাঁপতে আমরা বেরিয়ে আসি, দেখি তাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ও বেয়নেট। কোঁচ ভর্তি সোনাদানা, টাকা-পয়সার সঙ্গে বন্দুকের গুলি। আমাদের দু’জনকে লাইন দাঁড় করায়। আমি থর থর করে কাঁপতে থাকি। ভাবছিলাম, যে কোন মুহূর্তে বন্দুকের গুলি আমার বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে বেরিয়ে যাবে। বন্দুকে টোটা পুরতে দেখলাম। আমার স্কুলশিক্ষক দাদা বললেন : - আমাদের মারবেন না। আমরা মুসলমান। - তোরা মোছলমান? তাহলি হিন্দুগো মতন এহানে পালায়ে আছিস ক্যান? দাদা বললেন : আমরা হিন্দুগো ইন্ডিয়ায় পার করে দিতি যাচ্ছিলাম। - দালাল? কত টাহা চুক্তি? - জনপ্রতি এক শ’। - তোরা যে মোছলমান তর প্রমাণ কী? - কলেমা পড়ব? - পড়। আমার শিক্ষক দাদা কলেমা ‘তৈয়ব’ পড়ে শোনালেন। - তোদের কাছে টাকা পয়সা যা আছে দিয়েদে। শিক্ষক দাদা কোমরে বাঁধা টাকার থলে বের করে দেন। ভয়ে আতঙ্কে আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। - কী হলো, তোর ডা দে। আমার ইতস্তত ভাব দেখে একজন টান মেরে আমার লুঙ্গি খুলে দেয়। কোমর থেকে বেয়নেট দিয়ে টাকার থলে কেটে নেয়। বলে : শুয়োরের বাচ্চা, টাকা দিবি না ভেবেছিলি? বলেই আমার পেট বরাবর ছুরি চালিয়ে দেয়। আমি পেট চেপে ধরি। ছুরি আমার হাতের মাংসপেশী কেটে ঢুকে যায়। কনুইয়ে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়। আমি জ্ঞান হারিয়ে সেখানেই মাটিতে পড়ে যাই। কতক্ষণ অজ্ঞান ছিলাম জানি না। যখন জ্ঞান ফেরে, দেখি চারদিক অন্ধকারে ভরে গেছে। ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরে ঝরে দুর্বল হয়ে পড়েছি। মাথা তুলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। রক্তের ঘ্রাণে ক্ষতস্থান পিঁপড়ায় ভরে গেছে। পিপাসায় বুক ফেটে যাচ্ছিল। অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালাম। যেখান থেকে হোক- এক ফোঁটা পানি দরকার। তেষ্টা মেটাতে না পারলে মারা যাব। এক শ’ গজ দূরে মিট মিট করে জ্বলছে একটা মাটির কুপি। সেটা লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলাম। পৌঁছে দেখি সেটাও একটা মৃত্যুপুরী। সে বাড়িতেও ছড়ানো ছিটানো লাশ। খোলা বারান্দায় মাটির দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ। পরনে ময়লা ধুতি। বুকের বাঁ পাশে গুলির গর্ত। সেই গর্ত বয়ে রক্তের ধারা গড়িয়ে উঠোন পর্যন্ত নেমে গেছে। দূরে-কাছে কাউকে দেখতে পেলাম না। কুপির আলো অনুসরণ করে রান্নাঘরে গেলাম। দেখলাম, অশীতিপর এক বৃদ্ধা সন্তান হারিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। আমি জল খেতে চাইলাম। কাঁসার গ্লাসে করে উনি আমাকে জল দিলেন। জল খেতে পেয়ে যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। এই অলৌকিক বেঁচে যাওয়া আমি, জীবন-মৃত্যুর এক সুতা ব্যবধানে দাঁড়িয়ে। তখন চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে এসেছে। দিনের আলো ছাড়া এই মৃত্যুপুরী থেকে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। টর্চের আলোয় অনুভব করছিলাম অজানা আগন্তুকের আগমন বার্তা। পদশব্দ কাছাকাছি হলেই নিশ্বাস বন্ধ করে ফেলি- যাতে তারা আমাকে মৃত ভেবে নেয়। পরে জেনেছি, রাতের আগন্তুকরা ঘাতক নয়- নিখোঁজদের খোঁজে আসা নিকট স্বজন। ছয় শ’র অধিক মানুষ হত্যা করে লুটপাট সেরে উল্লাস ধ্বনির মাঝে ঘাতকরা রাতেই ফিরে গেছে। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া অপমৃত্যুগুলো সারারাত আমাকে ঘুমুতে দিল না। এক সময় আঁধার কেটে সকাল হয়। জনপদজুড়ে নেমে আসে শ্মশানের নীরবতা। নদীতে ভেসে যাওয়া অসংখ্য লাশের কোন হদিস আর মেলেনি। তাদের সৎকার করবে কে? ডাঙ্গায় থাকা লাশগুলো দিনের পর দিন সেখানে পড়ে ছিল। দিনে দিনে সেগুলো পচে দুর্গন্ধ ছড়িয়েছে। ক’দিনবাদে শেয়াল-শকুনের খাবার হয়েছে। কঙ্কাল নিয়ে কুকুরে কাড়াকাড়ি করেছে। হাঁড়ের টুকরোয় মাংস খুঁজেছে কাক। আজও ভুলতে পারিনি সেদিনের সেই রক্তাক্ত স্মৃতি। ভুলতে পারি না, স্বামীর মরদেহের পাশে বিলাপরত স্ত্রীর করুণ মুখ। ছেলে হারানো বৃদ্ধা মাতার ফোঁপানো কান্নার আওয়াজ। বধ্যভূমি ডাকরার প্রতিটি ধূলিকণায় এখন একাত্তরের শহীদের করুণ দীর্ঘশ্বাস ঘুরে বেড়ায়। অসংখ্য বিধবা নারীর চোখের জলে এখনও সিক্ত হয়ে চলেছে এখানকার পবিত্র মাটি। ২১ মের শহীদদের স্মরণে বাগেরহাট-৩ (রামপাল-মংলা) আসনের সংসদ সদস্য তালুকদার আঃ খালেকের (বর্তমানে মেয়র খুলনা সিটিকর্পোরেশন) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এবং পৃষ্ঠপোষকতার একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। বধ্যভূমির স্মৃতিস্তম্ভে প্রতিবছর ২১ মে স্মরণসভা ও শহীদ স্মরণে আয়োজন করা হয় তিন দিনব্যাপী মহানাম যজ্ঞানুষ্ঠান। ভূমিদাতা প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের জমিতে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে সংগৃহীত শহীদদের নাম লিপিবদ্ধ করা সম্ভব হয়েছে। অনেক দেরি হলেও তালুকদার খালেকের কাছে এতদঞ্চলের সব শ্রেণীর মানুষ কৃতজ্ঞ। নতুন প্রজন্মে বেশিরভাগ সন্তান বধ্যভূমি ডাকরার তথ্যবহুল ঘটনা ভালভাবে জানে না। তাদের অনাগ্রহের কারণে স্মরণানুষ্ঠানটি ক্রমশ তাৎপর্য হারাতে বসেছে। এখনও অনেকে প্রশ্ন তোলেন, কেন আমরা রাজাকারদের ঘৃণা করার কথা বলি। কেন ঘাতকদের বিচারের মুখোমুখি করার কথা বলি। তাদের অবগতির জন্য জানাই, খান সেনাদের চেয়ে রাজাকাররাই এ দেশের ক্ষতি করেছে বেশি। ধর্মের জিগির তুলে এরা হত্যা করেছে নিরাপরাধ লাখ লাখ মানুষকে। এদের সহযোগিতায় পাক বাহিনী প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছে গিয়ে নির্বিচারে বর্বরতা চালাতে পেরেছে। চার লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির জন্য এরাই দায়ী। এরা যদি সহযোগিতা না করত তবে ত্রিশ লাখ লোক অন্তত শহীদ হতো না। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, রামপাল, বাগেরহাট
×