ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্যোগের ঝুঁকি প্রশমনে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ২১ মে ২০১৮

দুর্যোগের ঝুঁকি প্রশমনে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট

বাংলাদেশে বজ্রপাত নতুন কোন বিষয় নয়। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলগুলোর একটি। এ বছর বজ্রপাতের তা-ব যথারীতি শুরু হয়েছে। বন্যা এবং সাইক্লোনের মতো দুর্যোগের ক্ষেত্রে কিছু প্রস্তুতি নেয়ার সময় ও সুযোগ থাকলেও বজ্রপাতের বিষয়টি ভূমিকম্পের মতোই প্রাকৃতিক এবং অতি আকস্মিক একটি বিষয়। উন্নত দেশগুলোর কোন কোনটিতে উল্লেখযোগ্য হারে বজ্রপাত হলেও মানুষের মৃত্যুসংখ্যা আমাদের দেশের তুলনায় অতি নগণ্য। যদিও বজ্রপাত প্রকৃতির সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যগুলোর মধ্যে একটি। এটি মানুষের পরিচিত সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোর একটিও। সূর্যপৃষ্ঠের তাপমাত্রার প্রায় সমান মাত্রার স্ফুলিঙ্গ আর ভয়াবহ গর্জন বহুকাল ধরেই চলে আসছে। বজ্রপাতের এই ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনে বিজ্ঞানের আরেকটি চিরন্তন রহস্যের জন্ম দেয়, বজ্রপাতের কারণ কি? ছোটবেলায় এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা বেশিরভাগ সময় এ উত্তর পেয়েছি, মেঘে মেঘে সংঘর্ষের ফলাফল হলো এই বজ্রপাত। আসলে কি তাই? কেন? কোথায় বজ্রপাত হয়? বজ্রপাত হওয়ার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা জেনে আমরা যদি সতর্ক হতে পারি তবে বজ্রপাতে প্রাণহানি অনেক কমে যেতে পারে। আশার কথা মহাশূন্যে আমাদের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ কাজ শুরু করার পর ভাড়া করা স্যাটেলাইটের নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠে অর্থ সাশ্রয় করার পাশাপাশি আবহাওয়া, বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস, ভূতাত্ত্বিক জরিপ, ছবি তোলা, মানচিত্র তৈরি, জলবায়ু পরিবর্তনের সমীক্ষা ও দুর্যোগ মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হবে। সাধারণত উত্তপ্ত ও আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে বজ্রপাত বেশি হয়। উত্তপ্ত বায়ু যখন দ্রুতগতিতে ঠা-া হয়, তখন বজ্রমেঘের সৃষ্টি হয়। এই বজ্রমেঘের ভেতরে বাতাসের দ্রুতগতির আলোড়নের সৃষ্টি হয়। এর ফলে বাতাসের জলীয়বাষ্প একই সময়ে বৃষ্টিকণা, শিশিরবিন্দু ও তুষার কণায় পরিণত হয়। বৃষ্টিকণা ও তুষার কণার পারস্পরিক সংঘর্ষের ফলে তুষারের ইলেকট্রন চার্জ ধাক্কা খায়। ফলে স্থির বৈদ্যুতিক চার্জের সৃষ্টি হয়। এই চার্জ সঞ্চিত হয়ে তীব্র শব্দের বজ্রপাত সৃষ্টি করে। যখন বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ উচ্চ তাপমাত্রা সৃষ্টি করে, তখনই তীব্র শব্দের সৃষ্টি হয়। বাতাসের মধ্য দিয়ে দ্রুত প্রবাহিত বজ্রবিদ্যুত প্রায় ৩০ হাজার ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা উৎপন্ন করে। ফলে বায়ুর দ্রুত প্রসারণ হয় ও তীব্র শব্দের সৃষ্টি হয়। সংক্ষেপে বলতে গেলে বাতাসে উর্ধমুখী প্রবাহ যতই দ্রুততর হয়, বজ্রপাত তত বেশি মাত্রায় হয়ে থাকে। পজিটিভ ও নেগেটিভ মেঘ থেকে বিদ্যুত সঞ্চালনকালে বজ্রের সৃষ্টি হয়, তখন মেঘের ভেতরে থাকা অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন গ্যাসের সম্প্রসারণ ঘটে। এতে প্রচুর ঝলকানি দিয়ে পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ে বজ্র। তখন এর সামনে মানুষ বা পশুপাখি যাই পড়ে, তার নির্ঘাত মৃত্যু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল লাইটনিং সেফটি’ ইনস্টিটিউটের মতে প্রতিবছর সারাবিশ্বে বজ্রপাতে মৃত্যুর এক-চতুর্থাংশ ঘটে বাংলাদেশে। পানিচক্রের নিয়মে জলাধারের পানি বাষ্পীভূত হয়ে মেঘ আকারে আকাশে আশ্রয় নেয়। এই মেঘ-ই হল বজ্রপাতের ব্যাটারি। বজ্রপাতের জন্য দায়ী মেঘ বৈদ্যুতিক চার্জের আঁধারের মতো আচরণ করে। যার উপরের অংশ পজিটিভ এবং নিচের অংশ নেগেটিভ চার্জে রূপান্তরিত হতে থাকে। পানিচক্রে জলকণা যখন ক্রমশ উর্ধাকাশে উঠতে থাকে তখন তারা মেঘের নিচের দিকের বেশি ঘনীভূত বৃষ্টি বা তুষার কণার সঙ্গে সংঘর্ষের মুখোমুখি হয়। যার ফলে উপরের দিকে উঠতে থাকা অনেক বাষ্পকণা বেশ কিছু ইলেকট্রন হারায়। এই মুক্ত ইলেকট্রনগুলো মেঘের তলদেশে জমা হয় এবং ইলেকট্রন হারানো পজিটিভ চার্জে রুপান্তরিত বাষ্পকণা মেঘের একেবারে উপড় পৃষ্ঠে চলে যায়। যার ফলশ্রুতিতে মেঘগুলো শক্তিশালী ধারক বা ক্যাপাসিটার এর বৈশিষ্ট্য লাভ করে। মেঘের দুই স্তরে চার্জের তারতম্যের কারণে সেখানে শক্তিশালী বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি হয়। এই বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের শক্তি মেঘে সঞ্চিত চার্জের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। এভাবে বাষ্পকণা ও মেঘে সংঘর্ষ চলতে চলতে মেঘের উপরে এবং নিচে যথাক্রমে পজিটিভ ও নেগেটিভ চার্জের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে এতটাই শক্তিশালী বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি করে যে তার বিকর্ষণে পৃথিবীপৃষ্ঠে অবস্থানরত ইলেকট্রনগুলো ভূ-পৃষ্ঠের আরো গভীরে চলে যায়। ফলাফলস্বরূপ ওই নির্দিষ্ট এলাকার ভূপৃষ্ঠ শক্তিশালী পজিটিভ বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে পরিণত হয়। মেঘের বিপুল শক্তিশালী বিদ্যুতক্ষেত্র তার চারপাশের বাতাসের অপরিবাহী ধর্মকে নষ্ট করে দেয়। মেঘে অবস্থিত বিদ্যুতক্ষেত্র যখন যথেষ্ঠ শক্তিশালী হয় (প্রতি ইঞ্চিতে প্রায় ১০ হাজার ভোল্ট) তখন তার আশপাশের বাতাস পজিটিভ এবং নেগেটিভ চার্জে বিভক্ত হয়ে যায়। এই আয়নিত বাতাস প্লাজমা নামেও পরিচিত। বাতাস আয়নিত হয়ে মেঘ এবং ভূ-পৃষ্ঠের মধ্যে বিদ্যুত চলাচলের পথ বা শর্ট সার্কিট তৈরি করে দেয় এবং বজ্রপাত ঘটায়। আবহাওয়াবিদদের মতে চারভাবে বজ্রপাত হয়ে থাকে। প্রথমত, মেঘমালা থেকে ভূপৃষ্ঠে। দ্বিতীয়ত, মেঘমালার সঙ্গে মেঘমালার। তৃতীয়ত, একই মেঘের মধ্যে। চতুর্থত, মেঘমালা থেকে বায়ুম-লে। এর মধ্যে মেঘমালা থেকে ভূ-পৃষ্ঠে যে বজ্রপাত হয় সেটি সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর। তাতে মানুষ ও জীবজন্তুর প্রাণহানি ঘটে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের গবেষণায় বলা হয়েছে ‘ভূ-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় আট হাজার থেকে ১০ হাজার মিটার ওপরে উষ্ণ, আর্দ্র বাতাসের বড় একটি অংশ বাংলাদেশের ওপরের বায়ুম-লের স্তরটা দখল করে ফেলেছে। একই অংশে নিচের বায়ুম-লের স্তরটা ঠান্ডা। এই তাপমাত্রার সঙ্গে বজ্রপাত বৃদ্ধির একটা ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। আবহাওয়া ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে বজ্রপাত বাড়ছে। গাছপালা কমে যাওয়া ও অতিরিক্ত কার্বণনিঃসরণের কারণে মূলত এমনটি হচ্ছে। বজ্রপাত পরিবেশ বিপর্যয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এটা যে কোনো সময় ঘটতে পারে। তবে আবহওয়াবিদদের মতে, বেশি গাছপালা থাকলে বজ্র গাছের মধ্যে পড়লে জানমালের ক্ষতি কম হতো। জলবায়ু পরিবর্তন, অব্যাহতভাবে বড় বড় বৃক্ষ নিধনের পাশাপাশি পর্যাপ্ত গাছ লাগানো হচ্ছে না। তাই ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়াসহ বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। চলবে... লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×