ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ভোটের প্রস্তুতির মাস ॥ পুরো রমজানই কাজে লাগাতে চায় আওয়ামী লীগ

প্রকাশিত: ০৫:১১, ২১ মে ২০১৮

ভোটের প্রস্তুতির মাস ॥ পুরো রমজানই কাজে লাগাতে চায় আওয়ামী  লীগ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ চলতি রমজান মাসে দলীয় ভোট প্রস্তুতি জোরালো করতে চায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রমজান মাসজুড়েই ইফতার মাহফিল ও উঠোন বৈঠকের পাশাপাশি তিনশ’ নির্বাচনী এলাকায় অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দ্বন্দ্ব, গ্রুপিং নিরসন, নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব হ্রাস এবং সরকারের আট বছরের ব্যাপক উন্নয়ন-সাফল্যগুলো তুলে ধরে ভোটারদের মন জয় করতে চায় দলটি। এরই অংশ হিসেবে নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় বিভিন্ন কর্মসূচীতে ব্যস্ত থাকার জন্য দলের মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে দলটির নীতি-নির্ধারক পর্যায় থেকে। আগামী ডিসেম্বরেই অনুষ্ঠিত হতে পারে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। হাতে রয়েছে মাত্র সাড়ে সাত মাস। এই স্বল্পতম সময়ে নির্বাচনী প্রস্তুতির কাজে এতটুকু ঘাটতি রাখতে চায় না ক্ষমতাসীন দলটি। যেহেতু একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এটিই শেষ রজমান, তাই বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার স্থানীয় পর্যায়ে ইফতার মাহফিল আয়োজন কিছুটা বেশি হবে। এদিকে লক্ষ্য রেখেই রমজানের এই পুরো মাসকে তৃণমূলে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি, ভোটারদের ঘরে ঘরে গিয়ে দলের পক্ষে ভোট প্রার্থনা এবং তৃণমূলে নেতাকর্মীদের সঙ্গে সৃষ্ট দূরত্ব-দ্বন্দ্ব নিরসন করে দলকে ঐক্যের বাঁধনে বাঁধতে দলের এমপি-মন্ত্রী ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের অধিকাংশ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, এমপি ও নেতারা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় রমজানের প্রথম দিন থেকেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত ইফতার মাহফিলে অংশ নিচ্ছেন। এর মাধ্যমে নির্বাচনী এলাকায় নিজেদের অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করার পাশাপাশি সরকারের উন্নয়ন-সফলতাগুলো ভোটারদের সামনে তুলে ধরছেন তারা। আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ থাকলে নির্বাচনে দলটিকে হারানো যে কঠিন তা খুলনা সিটি নির্বাচন এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিল নির্বাচনে তারা প্রমাণ করেছে। এমন উদাহরণকে ধারণ করেই মন্ত্রী-এমপিরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় ছুটে গিয়ে নেতাকর্মীদের সঙ্গে সৃষ্ট দূরত্ব হ্রাস, সংগঠনকে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। জানা গেছে, শুধু নির্বাচনী প্রচার এবং দল গোছানোই নয়, জাতীয় নির্বাচনের বাকি কাজগুলোও রজমান মাসে এগিয়ে রাখতে চান আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকরা। এ লক্ষ্যে এই রমজান মাসেই আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কেন্দ্রভিত্তিক পোলিং এজেন্ট নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও শুরু করতে চায় ক্ষমতাসীনরা। নির্বাচন পরিচালনা কমিটির তত্ত্বাবধানে নির্বাচনে আগ পর্যন্ত প্রায় ১২ লাখ পোলিং এজেন্টকে প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা নিয়েছে দলটি। এ কারণে মন্ত্রী-এমপিদের নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে এই রমজান মাসে ভোট কেন্দ্রভিত্তিক পোলিং এজেন্টদের নাম চূড়ান্ত করে তা কেন্দ্রে পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ নির্বাচন পরিচালনা কমিটির একাধিক নেতা জানান, পোলিং এজেন্টদের প্রশিক্ষণ দেয়ার পরিকল্পনা অনেকটাই গুছিয়ে আনা হয়েছে। দিনক্ষণ চূড়ান্ত না হলেও চলতি রমজান মাসেই অথবা ঈদের পর পরই এ কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। দলের পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রথম পর্বে ৫ থেকে ৬শ’ জনকে পোলিং এজেন্ট হিসেবে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। পর্যায়ক্রমে বিভাগ, জেলা ও উপজেলায় কেন্দ্রভিত্তিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হবে। সাবেক সরকারী কর্মকর্তা ও দল সমর্থিত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা এ প্রশিক্ষণ দেবেন। এ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পোলিং এজেন্টদের নির্বাচনী আইন ও বিধিমালার পাশাপাশি সঠিকভাবে ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালনের বিষয়টি হাতেকলমে শেখানো হবে। নির্বাচন কমিশন থেকে আভাস পাওয়া গেছে, আগামী ডিসেম্বরের যে কোন দিনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করছে নির্বাচন কমিশন। আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড থেকেও ওই সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে এমনটা বলা হচ্ছে। মুখে যাই-ই বলুক, আগামী নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে জোট বেঁধে বিএনপি নির্বাচনে আসবে। এমনটা ধরে নিয়েই আগে থেকেই নির্বাচনী প্রস্তুতির কাজটা সম্পন্ন করতে চায় আওয়ামী লীগ। আর সেই প্রস্তুতিতে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে সারাদেশের তৃণমূলে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দল ও বিবাদ মিটিয়ে ফেলে দলকে ঐক্যবদ্ধ করা। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সর্বশেষ বৈঠকে বিভিন্ন নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধান এবং দলের মধ্যে সৃষ্ট কোন্দল-দ্বন্দ্ব নিরসনে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করে দেয়া হয়। দলের সভাপতিম-লীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত এই কমিটি একাধিক বৈঠক করে সারাদেশের কোথায় কোথায় সাংগঠনিক সমস্যা রয়েছে তার একটি তালিকাও প্রস্তুত করেছে। এছাড়া বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকরাও অভ্যন্তরীণ কোন্দলকেই প্রাধান্য দিয়ে তা নিরসনে কাজ করে যাচ্ছেন। কোন্দলযুক্ত অনেক জেলার নেতাদের ঢাকায় তলব করে তা নিরসনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। আর এ সমস্ত কাজের মূল ভূমিকায় রয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। আওয়ামী লীগ নীতি-নির্ধারক পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদের পর পরই সারাদেশে আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচারে নামবেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। এ লক্ষ্যে সভাপতিম-লী ও উপদেষ্টা পরিষদের বড় মাপের নেতাদের প্রধান করে সারাদেশে সাংগঠনিক সফরের জন্য সাংগঠনিক টিম গঠনেরও প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শুধু কেন্দ্রীয় নেতারাই নন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ঈদের পর সারাদেশে সরকারী সফরের পাশাপাশি সাংগঠনিক সফরের মাধ্যমে নৌকা মার্কার পক্ষে সারাদেশে জোয়ার তোলার চেষ্টা করবেন। গত ৩০ জানুয়ারি সিলেটে জনসভার মাধ্যমে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতির কাজ শুরু করে আওয়ামী লীগ। পর্যায়ক্রমে বরিশাল, রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম, ঠাকুরগাঁও ও চাঁদপুরে নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক জনসভা করেছে দলটি। এসব জনসভায় বর্তমান সরকারের উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সাফল্য অর্জনের বিস্তারিত তথ্য ওইসব এলাকার জনগণের মাঝে তুলে ধরে উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে নৌকা মার্কায় ভোট চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ঈদের পর বাকি বিভাগ ও গুরুত্বপূর্ণ জেলাগুলোতে সফরের মাধ্যমে নৌকা মার্কায় ভোট চাইবেন তিনি। দলের নেতারা মনে করেন, নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও ধীরে ধীরে এখন নির্বাচনী জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। রমজানে ইফতার আয়োজনের পাশাপাশি পোলিং এজেন্টদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচী শুরুর প্রস্তুতি এবং পাড়া-মহল্লায় কর্মিসভার মাধ্যমে দলকে ঐক্যবদ্ধ করার কর্মসূচী নির্বাচনী প্রস্তুতির পালে বাতাস আরও জোরালো হবে। সর্বস্তরের নেতাকর্মীকেও সাংগঠনিক কাজে সক্রিয় রাখা সম্ভব হবে। ফলে আসন কেন্দ্রিক তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের পাশাপাশি সমন্বয়ও তৈরি হবে। ইতোমধ্যেই একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি’ গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। এতে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এইচ টি ইমামকে কো-চেয়ারম্যান এবং সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে সদস্য সচিব মনোনীত করা হয়েছে। দলের উপদেষ্টা পরিষদ, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকদের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য করা হয়েছে। দলীয় সূত্র জানায়, নির্বাচন পরিচালনার অংশ হিসেবে জাতীয় নির্বাচন পরিচালনায় কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়েও কমিটি গঠনের পরিকল্পনা নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। বিভাগীয় পর্যায়ে এ কমিটিতে দলের একজন সভাপতিম-লীর সদস্যকে আহ্বায়ক, সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদককে যুগ্ম আহ্বায়ক এবং সাংগঠনিক সম্পাদককে সদস্য করা হবে। আগামী দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকেই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে বলে জানা গেছে।
×