ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পুদিনা পাতা

নানা রোগের মহৌষধ-পুষ্টিতে ভরা, রাখুন ইফতারিতে

প্রকাশিত: ০৬:১১, ২২ মে ২০১৮

নানা রোগের মহৌষধ-পুষ্টিতে ভরা, রাখুন ইফতারিতে

খোকন আহম্মেদ হীরা ॥ সারাদিন রোজা রেখে ইফতারিতে পুষ্টিকর খাবার খুবই জরুরী। তাই ইফতারির মেন্যুতে রাখতে পারেন ‘মহৌষধ’ হিসেবে খ্যাত পুদিনা পাতা। পৃথিবীতে এমন অনেক ধরনের উদ্ভিদ আছে যেগুলোতে প্রচুর ঔষধিগুণ রয়েছে। পুদিনা পাতা তার মধ্যে অন্যতম। সাধারণ আগাছা ধরনের এই গাছটির কাণ্ড ও পাতা বেশ নরম। ছোট গুল্ম জাতীয় এই গাছের পাতা ডিম্বাকার, পাতার কিনারা খাঁজকাটা ও সুগন্ধীযুক্ত হয়। পুদিনা পাতার মূল, পাতা, কা-সহ সমগ্র গাছই ঔষধিগুণে পরিপূর্ণ। হোমিও চিকিৎসক ডাঃ কাজী শিউলীর মতে, পুদিনা পাতায় বিভিন্ন ধরনের ঔষধি গুণাগুণের মধ্যে রয়েছে পেট ফাঁপা, সহজ কথায় পেটে বাতাস জমে যাওয়া। এ অবস্থার সৃষ্টি হলে নানারোগ হতে পারে। বদ হজমের ফলে পেটে বাতাস জমে এবং পেট ফাঁপে। সেক্ষেত্রে পুদিনার শরবত খেলে পেটে বাতাস জমা বন্ধ হবে। খাদ্যে রুচিও ফিরে আসবে। শিশুদের অতিসারে-পাতলা দাস্ত, সেই সঙ্গে পেট মোচড় দিয়ে ব্যথা, কোন কোন ক্ষেত্রে অল্প আম সংযুক্ত দাস্ত, বমি বমি ভাব, কিছুই খেতে চাচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে পুদিনা পাতার রস ৮ থেকে ১০ ফোঁটা অল্প একটু চিনি ও লবণ সহকারে এক ঘণ্টা পর পর কয়েকদিন খাওয়াতে হবে। রোগে ভোগার পর, পেটে বাতাস জমে ও কোষ্ঠবদ্ধতায় অরুচি আসে। এসব ক্ষেত্রে পুদিনার শরবত (পুদিনার রস দুই চা চামচ, সামান্য লবণ, কাগজি লেবুর রস ৮/১০ ফোঁটা, হাল্কা গরম পানি পোয়া খানিক একত্রে মিশিয়ে) সকাল ও বিকেল দুইবার পাঁচ থেকে সাত দিন খেলে অরুচি চলে যায়। পুদিনা পাতা বেটে পানিতে গুলে শরবত করা যায়। সেক্ষেত্রে কাঁচা পাতা ৮/১০ গ্রাম নিতে হবে। অনেক রোগে প্রস্রাব কম হয়। কিন্তু যে ক্ষেত্রে ঠা-া গরমের ফলে সাময়িকভাবে অল্প অল্প প্রস্রাব হতে থাকে, কোন কোন সময় দাহ হতে থাকে, সেক্ষেত্রে পুদিনা পাতা ৮/১০ গ্রাম বেটে তাতে সামান্য লবণ ও কাগজি লেবুর রস ঠা-া পানি মিশিয়ে শরবত করে দিনে ২/৩ বার খেতে হবে। ডাঃ কাজী শিউলী আরও বলেন, পুদিনায় রয়েছে মনোটারপিন নামক উপাদান। যা স্তন, লিভার এবং প্যানক্রিয়াসের ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। নিয়মিত খেলে ফুসফুস, কোলন এবং ত্বকের ক্যান্সার থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়। এছাড়া পিত্তে শ্লেষ্মার জ্বর, আমাশয়, অজীর্ণ, উদরশূল প্রভৃতিতে বমি হতে পারে। আবার রোদে ঘোরাফিরা করে ঠা-া পানি খেলে, খালি পেটে থেকে পরিশ্রম করলেও বমি হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে পুদিনার শরবতের সঙ্গে এক চা চামচ তেঁতুল মাড় ও চিনি মিশিয়ে ২/৩ বার করে কয়েকদিন খেতে হবে। ঘাম নিয়ন্ত্রণেও পুদিনা পাতার রয়েছে বিশেষ গুণ। যাদের শরীরে বেশি ঘাম হয় তারা পুদিনা পাতা ও গোলাপের পাপড়ি একসঙ্গে মিশিয়ে পানিতে ফুটিয়ে নিন। ঠা-া হলে সেই পানির সঙ্গে পাতি লেবুর রস মিশিয়ে ছেঁকে নিয়ে বোতলে করে ফ্রিজে রেখে দিন। গোসলের পর সারা শরীরে লাগান। পুদিনায় রোজমেরিক এসিড নামের এক ধরনের উপাদান থাকে। এটি প্রাকপ্রদাহী পদার্থ তৈরিতে বাধা দেয়। ফলে এ্যাজমা হয় না। এছাড়াও এ ঔষধি প্রোস্টসাইক্লিন তৈরিতে বাধা দেয়। তাতে শ্বাসনালী পরিষ্কার থাকে। লেবু পুদিনার শরবত ॥ গ্রীষ্ম মৌসুমে আবহাওয়ার তাপমাত্রা অনেক বেশি থাকে। সেইসঙ্গে চলছে রমজান মাস। তাই এই সময়ে ইফতারে একটু প্রশান্তি পেতে বেছে নিতে পারেন লেবু পুদিনার শরবত। উপকরণ-মাঝারি আকারের লেবু দুইটা, পুদিনা পাতা ১০ গ্রাম, পানি ২৫০ মিলিলিটার, চিনি দুই টেবিল চামচ ও বরফ কুচি। প্রস্তুত প্রণালী-প্রথমে লেবুর খোসা ফেলে টুকরো করে নেয়ার পর পুদিনা পাতা ধুয়ে কুচি করে কেটে ব্লেন্ডারে লেবু, পুদিনা পাতা, পানি, চিনি দিয়ে ভালভাবে ব্লেন্ড করার পর ছাকনি দিয়ে ছেঁকে গ্লাসে বরফ কুচি দিয়ে পরিবেশন করুন। রূপচর্চায় পুদিনা পাতা ॥ পুদিনা পাতার ঔষধি গুণাগুণ প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে রূপচর্চায়। পুদিনা পাতা ত্বকের বিভিন্ন এ্যালার্জি দূর করতে সাহায্য করে। পাশাপাশি উজ্জ্বল ও সুস্থ রাখে ত্বক। পুদিনা পাতা পেস্ট করে ত্বকে লাগিয়ে রাখুন। কিছুক্ষণ পর ঠা-া পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। নিয়মিত করলে দূর হবে ত্বকের বলিরেখা। পুদিনা পাতার পেস্ট ও গোলাপজল একসঙ্গে মিশিয়ে ব্রণের ওপর লাগান। কিছুক্ষণ পর ধুয়ে ফেলুন। এটি ব্রণ ও ব্রণের দাগ থেকে মুক্তি দেবে। ত্বক ঠা-া রাখতে পুদিনা পাতার রস ত্বকে লাগান। ২০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন। ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে নিয়মিত ব্যবহার করতে পারেন পুদিনা পাতা। পুদিনা পাতা পেস্ট করে ত্বকে লাগিয়ে রাখুন। শুকিয়ে গেলে ধুয়ে ফেলুন। লোমকূপ পরিষ্কার করতে পুদিনা পাতার রসের সঙ্গে মধু মিশিয়ে ত্বকে লাগান। বিশেষ করে যেখানে ব্ল্যাকহেডস বেশি থাকে সেখানে লাগান। পুদিনা পাতার চাটনি ॥ পুদিনা পাতার চাটনি আপনিও খুব সহজে তৈরি করতে পারেন। তাজা পুদিনা পাতার সু-ঘ্রাণের সঙ্গে ধনে পাতা মিশিয়ে তৈরি এই চাটনি আপনার মন ভাল করে দিতে পারে। তবে ধনে পাতা ছাড়াও তৈরি করতে পারেন। খিচুড়ি কিংবা পোলাওর সঙ্গে এই চাটনি খুবই ভাল লাগবে। টিক্কা আর কাবাবের সঙ্গেও অসাধারণ লাগে পুদিনা পাতার চাটনি। পুদিনা পাতা ১/৪কাপ, লবণ/বিট লবণ ১/২চা চামচ, তেঁতুলের মাড় এক চামচ, রসুনের কোয়া একটি, চিনি ২-৩ চামচ, সরিষার তেল/আস্ত সাদা সরিষা/ সরিষার গুঁড়া এক চা চামচ, কাঁচা মরিচ ২/৩টি। তেঁতুলের মাড় ছাড়া সব উপকরণ একসঙ্গে বেটে অথবা ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করে নিন। বাটা হলে চামচ দিয়ে তেঁতুলের মাড় মিশিয়ে নেয়ার পরেই হয়ে যাবে পুদিনা পাতার চাটনি। পুদিনা পাতার গুনাগুণ ॥ পুদিনা পাতার মূল, পাতা, কা-সহ সমগ্র গাছই ঔষধিগুণে পরিপূর্ণ। এর পাতা সুগন্ধি হিসেবে রান্নায় ব্যবহার করা হয়। মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে পুদিনা পাতা পানিতে মিশিয়ে কুলি করলে অনেক উপকার পাওয়া যায়। পুদিনা পাতা হজম শক্তি বাড়ায়। পুদিনা পাতার চা শরীরের ব্যথা দূর করতে সহযোগিতা করে। অনবরত হেঁচকি উঠলে পুদিনা পাতার সঙ্গে গোলমরিচ পিষে ছেঁকে নিয়ে রসটুকু পান করলে কিছুক্ষণের মধ্যেই হেঁচকি বন্ধ হয়ে যাবে। পুদিনা পাতা ত্বকের যে কোন সংক্রমণকে ঠেকাতে এ্যান্টিবায়োটিকের কাজ করে। পুদিনা পাতার রস তাৎক্ষণিক ব্যথানাশক উপাদান হিসেবে কাজ করে। পুদিনা পাতার রস চামড়ার ভেতর দিয়ে নার্ভে পৌঁছে নার্ভ শান্ত করতে সহায়তা করে। তাই মাথা ব্যথা বা জয়েন্টে ব্যথা উপশমে পুদিনা পাতা ব্যবহার করতে পারেন। মাথা ব্যথা হলে পুদিনা পাতার চা পান করতে পারেন। অথবা তাজা কিছু পুদিনা পাতা চিবিয়ে খেতে পারেন। জয়েন্টে ব্যথায় পুদিনা পাতা বেটে প্রলেপ দিতে পারেন। পুদিনা পাতার পেরিলেল এ্যালকোহল যা ফাইটোনিউরিয়েন্টসের একটি উপাদান দেহে ক্যান্সারের কোষ বৃদ্ধিতে বাধা প্রদান করে। পুদিনার তাজা পাতা পিষে মুখে লাগিয়ে কিছুক্ষণ পর যদি তা ধুয়ে ফেলা যায়, তাহলে মুখের তৈলাক্ত ভাব দূর হয়ে যায়। পুদিনার পাতা ভাল করে পিষে তার রস ভাল করে মাথায় ব্যবহার করলে যাদের চুলে উকুন আছে তারা বেশ উপকার পাবেন। মাইগ্রেনের ব্যথা দূর করতে নাকের কাছে টাটকা পুদিনা পাতা ধরুন। এর গন্ধ মাথা ব্যথা সারাতে খুবই উপকারি। গোলাপ, পুদিনা, আমলকি, বাঁধাকপি ও শসার নির্যাস একসঙ্গে মিশিয়ে মুখে লাগালে তা ত্বককে মসৃণ করে তোলে। পুদিনা পাতায় রয়েছে চমৎকার গুণাগুণ যা পেটের যেকোন সমস্যার সমাধান করতে পারে খুব দ্রুত। যারা পেটের ব্যথা কিংবা পেটের অন্যান্য সমস্যায় ভুগে থাকেন তারা খাবার পর এককাপ পুদিনা পাতার চা খাওয়ার অভ্যাস করুন। পুদিনা পাতা পুড়িয়ে ছাই দিয়ে মাজন বানিয়ে দাঁত মাজলে মাড়ি থাকবে সুস্থ, দাঁত হবে শক্ত ও মজবুত। মেয়েদের অনিয়মিত পিরিয়ডের যন্ত্রণা থেকে সেরে ওঠার জন্য পুদিনা পাতা বেশ উপকার করে। পুদিনা ত্বককে শীতল করে। খাবারের সঙ্গে নিয়মিত খেলে শরীরের ত্বক সতেজ হয় এবং সজীব ভাব বজায় থাকে। পুদিনা পাতার রস শ্বাস-প্রশ্বাসের নালী খুলে দেয়ার কাজে সহায়তা করে। ফলে যারা এ্যাজমা এবং কাশির সমস্যায় ভোগেন তাদের সমস্যা তাৎক্ষণিক উপশমে পুদিনা পাতা বেশ কার্যকর। পুদিনা পাতা গরম পানিতে ফুটিয়ে সেই পানির ভাপ নিন। রোদে পোড়া ত্বকের জ্বালাপোড়া কমাতে পুদিনা পাতার রস ও এ্যালোভেরার রস একসঙ্গে মিশিয়ে ত্বকে লাগিয়ে ১৫ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন। দীর্ঘদিন রোগে ভুগলে বা কোষ্ঠকাঠিন্য থাকলে অনেক সময় অরুচি হয়। সেক্ষেত্রে পুদিনা পাতার রস দুই চা চামচ, কাগজি লেবুর রস ৮/১০ ফোঁটা ও লবণ হালকা গরম পানিতে মিশিয়ে সকাল বিকেল দুই বেলা পান করুন। এভাবে ৪/৫ দিন খেলেই অরুচি দূর হয়ে যাবে। কফ দূর করতে পুদিনা পাতার রস, তুলসী পাতার রস, আদার রস ও মধু একসঙ্গে মিশিয়ে খেলে অনেক উপকার পাওয়া যায়। সুস্থ হার্টের জন্য পুদিনা পাতা অনেক উপকারী। এটি রক্তে কলেস্টরেল জমতে বাধা প্রদান করে। ফলে হার্ট থাকে সুস্থ। পুদিনা পাতার সালাদ খেলে পেটে গ্যাস হয় না। পুদিনা পাতা মেয়েদের রক্তশূন্যতা পূরণ করে এবং মায়ের বুকে দুধ বাড়ায়। যারা প্রস্রাব সমস্যায় ভুগছেন তারা এক গ্লাস পানিতে কয়েক ফোঁটা পুদিনা পাতার রস, সামান্য লবণ ও অল্প চিনি দিয়ে শরবত খেয়ে দেখবেন প্রস্রাব পরিষ্কার হয়ে যাবে। যাদের বুক ধড়ফড় করে তারা পুদিনাপাতা খেলে বেশ উপকার পাবেন। পুদিনা পাতার রস উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। নিয়মিত পুদিনা পাতার রস খেলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। পাতলা পায়খানা হলে পুদিনা পাতা খেলে বেশ উপকার পাওয়া যায়। ক্লান্তি দূর করে পুদিনা পাতা ॥ পুদিনা পাতা খুবই উপকারী একটি উদ্ভিদ। আমাদের শরীরের নানা রোগ প্রতিরোধে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। পুদিনা পাতার ইংরেজী নাম ‘মিন্ট’। সালাদের বাটিতে এটি ভীষণ পরিচিত নাম। এ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও ভিটামিন ‘এ’ দ্বারা পরিপূর্ণ পুদিনা পাতা। এর দ্বারা ক্লান্তি ও অবসাদ দূর হয়। কৃমিনাশক হিসেবে কাজ করে পুদিনা পাতা। অতিরিক্ত জ্বর, বড় কোন অপারেশন, ডায়রিয়া, দীর্ঘদিন ধরে বমির পর বেশির ভাগ রোগীর মুখের স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। পুদিনা পাতা এক্ষেত্রে ফিরিয়ে আনবে মুখের স্বাদ। পিষে, ধনে পাতার মতো তরকারিতে ছিটিয়ে বা কাঁচা সালাদের সঙ্গে খাওয়া যায়। মাছ, মাংস বা সবজির খাবারে এই পাতা আনে বাড়তি স্বাদ এবং দেহের জন্য প্রয়োজনীয় লবণগুলোকে সরবরাহ করে রক্তের মধ্যে। দেহের জন্য ক্ষতিকর অণুজীবগুলো ধ্বংস করে। পুদিনাপাতা রান্নার চেয়ে কাঁচা খাওয়াটাই উত্তম। এতে পুষ্টিগুণ বজায় থাকে বেশি। সর্দি, হাঁচি, কাশি দূর করতেও এই পাতার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পুদিনা পাতা, তুলসী পাতা, কাঁচা আদা, মধু মিশিয়ে খেলে ঠা-া লাগা দ্রুত ভাল হবে।
×